রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

।।উইংসের আড়ালে।।

ভোরবেলায় দরজা ধাক্কানোর শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসে শিবানী। ভয়ে ভয়ে দরজা খুললো। অবাক হয়ে দেখল দরজা আসলাম দাঁড়িয়ে। খবর না পাঠালে কখনও আসলাম আসে না। আসলাম একটা খাম দিল। বলল আগের দিন রাতেই একজন এটা শিবানীজির নাম করে দিয়ে গিয়েছে। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল তাই আসলাম আর আসেনি। জরুরি কিছু হবে হয়তো সেই জন্য সকাল সকাল দিতে এসেছে। আসলামকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজাটা বন্ধ করে খামটা খুলে ফেলল শিবানী। একটা ছোট কাগজ। হোটেলের প্যাড। তাতে রুম নম্বর ফোন নম্বর আর নাম লেখা। নাম দেখে শিবানী চমকে উঠল। সিংহানিয়া। এই হাতের লেখা তার খুব চেনা। তারমানে সিংহানিয়াজি এখন বম্বেতে। তার মানে কি মা কালী মুখ তুলে চাইলেন? মায়ের ছবিতে মাথা ছুঁইয়ে দ্রুত তৈরি হয়ে নিল। জুহুতারা রোডে হোটেলে পৌঁছতে হবে। বহুদিন পর ট্যাক্সি নিল শিবানী। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে সিংহানিয়াজির কাছে পৌঁছতে হবে। বাঁচতে হবে তাকে।

এগ্রিমেন্টের পাঁচ হাজার টাকা আর মাসের বাড়িভাড়া দিয়ে সিংহানিয়া শিবানীকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল। শিবানী গিয়ে উঠলো রিজেন্টপার্কের সেই পুরনো ফ্ল্যাটে। আগে শুনেছিল বাড়িটা নাকি ভাড়া যার ভাড়া সিংহানিয়া মেটায়। ভুল শুনেছিল। বাড়িটার মালিক সিংহানিয়া নিজে। তবে বেনামে কেনা। সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ বহুকষ্টে জমানো বা ধারের টাকায় কেনা বাড়ি জমি সম্পত্তি নিজের নামে না হওয়া পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় দু’ চোখের পাতা এক করতে পারে না। অথচ পয়সাওয়ালা ক্ষমতাবান মানুষজন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্য লোকের নামে জমি বাড়ি গাড়ি সম্পত্তি করে রাখে। টাকার জোরে ক্ষমতার জোরে সে সম্পত্তি মার যাবার কোন সম্ভাবনাই নেই।

শিবানী ভাবতে থাকে সিংহানিয়া কি সত্যি সত্যি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছে। এই যে এত কিছু করল সেকি শুধু ভালোবাসার মানুষের জন্য। বম্বেতে সিংহানিয়াজির হিন্দি ছবির সত্ব কেনাবেচার ব্যাপারে দিন সাতেকের কাজ ছিল। এর মধ্যে শিবানী চালের বাকি টাকা মিটিয়ে দিয়ে জুহুর হোটেলে সিংহানিয়ার সঙ্গেই থাকতে শুরু করলো। ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না তাই শিবানীকে প্লেনে চাপিয়ে কলকাতা নিয়ে এল সিংহানিয়া। জীবনের সেই প্রথম প্লেনে চড়া। আনন্দে চোখে জল এসে গিয়েছিল। কলকাতার দমদম এয়ারপোর্টে নেমে শিবানীকে নিয়ে প্রথমে অফিসে গেল। সেখান থেকে কাজের একটা লোক আর শিবানীকে বাড়ির চাবি দিয়ে ট্যাক্সিতে রিজেন্ট পার্কের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। অনেকদিন বন্ধ পড়ে আছে ঝাড়াপোঁছা ধোওয়াধুয়ির কাজ তো করতে হবে। আবার শুরু হল সেই পুরনো রুটিন। এদিক সেদিক কলকাতার বাইরে হোটেল রিসর্ট। শিবানী তখনও জানেনা সিংহানিয়া ঠিক কী চাইছে? একদিন সিংহানিয়া নিজেই বলল—

—শিবানী কলকাতার ছবিতে একটা দুটো ড্যান্স সিকোয়েন্সে নেচে তোমার চলবে না। বম্বের ক্যারিয়ারটা বলবার মতো কিছু হয়নি। ছবিতে সাইড রোলে এস্টাবলিশ হতে অনেক সময় লেগে যাবে। এখন কলকাতায় কিছু নাটক হচ্ছে তাতে ক্যাবারে ড্যান্স থাকছে। আমি একটা প্রোডাকশনে টাকা লাগিয়েছি। মানুষজন ভিড় করে দেখতে আসছে। মোটামুটি ভালো পয়সা পাওয়া যাচ্ছে। তুমি এটা শুরু কর সেই সঙ্গে নাটকের ছোট ছোট রোলে অভিনয় করার চেষ্টা করো। এখনও তোমার চেহারা চটক যথেষ্ট ভালো। মনে হয় নাটকে তুমি টিকে যাবে।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৩০: ক্যামেরা স্টেডি হতেই শিবানী আউট অফ ফ্রেম!

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১০: সুন্দরবনের রক্ষয়িত্রী বনবিবি

“ভিখারীর পছন্দ অপছন্দ থাকতে নেই”—এই ইংরেজি আপ্তবাক্য বম্বেতে প্রায়ই শুনতে হতো। “মিস ক্যুইন (বম্বে)” নাম দিয়ে মুখে ওড়না ঢাকা উন্মুক্ত পোশাকে লাস্যময়ী কাট-আউট লাগানো হল সারকারিনা থিয়েটারে। কাগজেও ছবি ছাপা হতো। তবে সঙ্গে আরও মিস এ-বি-সি-ডি-ই-এফ-জে’র থাকত সাদাকালো ছবি। কাউকেই আলাদা করে চেনা যেত না। সবাই প্রায় একই রকম। নাটকে পাকাপাকিভাবে কাজ শুরু করার পর বাড়ি থেকে মাকে ফোন করেছিল। ল্যান্ডলাইনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল সিংহানিয়া। মা বলেছিল বনানীর বিয়ে ঠিক হচ্ছে। শিবানী মাকে বলেছিল তার কোনও পরিচয় দেবার দরকার নেই। বলে দিও বম্বেতে সিনেমায় কাজকর্ম করে তোমাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। বনানীর বিয়ে হয়ে যাক। তারপর একদিন আমি এসে তোমার আর বাবার সঙ্গে দেখা করে যাব। আমি যে কলকাতায় এসেছি এটা বাবাকেও বলার দরকার নেই। বনুকে তো নয়ই। মেয়ের যন্ত্রণা মেয়ের অভিমান মা শুভ্রা বুঝতে পারেন। কিন্তু বুঝতে পেরেও কিছু করার থাকে না তাঁর। মা হবার অনেক জ্বালা।

নাচ দিয়ে শুরু করলেও শিবানী মনে প্রানে অভিনয় শেখার চেষ্টা করছিল। আসলে সে তো অভিনেত্রী হতেই চেয়েছিল ভেবেছিল নাচটা তাকে বাড়তি সুবিধে দেবে। একেবারে নর্তকী হয়ে বেঁচে থাকতে চায়নি। বম্বেতে তো ছাপ লেগে গিয়েছিল। এখানে যখন সুযোগ পেয়েছে তখন চেষ্টা তাকে করতেই হবে। পরিচালকের কথা খুব মানতো। নাচের সিন হয়ে গেলেও উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে রাতের পর রাত পার্ট শুনতে শুনতে সংলাপ প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। আচমকা একদিন সুযোগ এসে গেল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৩: কানে ব্যথা? তেল দেবেন কি?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭: গৃহিণী সারদার প্রথম দক্ষিণেশ্বর আগমন

নাটকের অভিনেত্রীরা সকলে শুধু পেশাদার মঞ্চে নাটকটাই করতো না, বৃহস্পতি শনি রবি ছুটির দিন বাদ দিয়ে অন্য দলের নাটক করতো, টুকটাক সিনেমার শুটিং, কখনো গ্রুপ থিয়েটারের কোনও শো—কোনওটাই বাদ দিত না। মিত্রা দাস বলে একটি মেয়ে বর্ধমানের শো করতে গিয়েছিল। বুধবার রাতে শো বৃহস্পতিবার ভোরবেলা কলকাতা পৌঁছে যাবে সন্ধেবেলা শো। হিসেব ঠিকই ছিল। কিন্তু হাইওয়ের এক্সিডেন্টে অনেকে টুকটাক চোট লাগলেও ড্রাইভার এর ঠিক পিছনের সিটে বসে থাকা মিত্রা দাসের পা ভাঙলো। বৃহস্পতিবার দুপুরবেলা খবরটা এলো। এইসব শোতে মূল চরিত্রে প্রক্সি থাকতো কিন্তু মিত্রার চরিত্র এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ নয় যে তার কামাই হবে। তাও একজন দু’ জন থাকে। কিন্তু সেদিন এমন কপাল খারাপ তারাও কেউ আসেনি। ডিরেক্টর লক্ষ্য করেছিল শিবানী প্রায় সকলের চরিত্র খুব ভালো করে খেয়াল করে। হঠাৎ তার মনে হল এই মেয়েটাকে ট্রাই করা যেতে পারে। ঠিক করে করতে পারলে মিত্রার জায়গায় একে দিয়ে করিয়ে নেবে। কারণ মিত্রা প্রায় মাসখানেক শো করতে পারবে না। একেই বলে কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। শিবানী নাচের দৃশ্য ইন্টারভ্যালের আগে আর মিত্রা ঢোকে ইন্টারভালের পরে দুই নম্বর সিনে। নাচের দৃশ্যের শিবানীর মুখে একটা কালো কাপড় থাকে। সেদিন ডিরেক্টরলাইট-এর ছেলেটিকে বলে দিলেন—

—শিবানীর মুখটা ডার্ক রাখিস বডিতে লাইট ফেলবি। ইন্টারভেলের পরে সেকেন্ড সিনে মিত্রার জায়গায় আজ ওর এন্ট্রি আছে।
আরও পড়ুন:

পাখি সব করে রব, পর্ব-২: দুর্লভ পরিযায়ী পাখি ল্যাপউইং

পরিযায়ী মন, বর্ণময় ইংল্যান্ড: লন্ডনের অন্যতম আকর্ষণ বাকিংহাম প্রাসাদের রক্ষী বদল অনুষ্ঠান

পোস্টারে আলো লিখে পাশে যিনি আলোক নির্দেশক, স্বাভাবিকভাবেই তার নাম জ্বলজ্বল করে। কিন্তু তিনি তো আর ঘেমে-নেয়ে প্রতিদিন মঞ্চের ওপরে পাখির চোখ রেখে মাসের পর মাস কন্ট্রোল বোর্ড থেকে আলো নিয়ন্ত্রণ করে ম্যাজিকটা বানান না। বানায় ওই অচেনা-অজানা-অনামী ছেলেগুলো।

পর্দার অন্তরালে কী কী পরিবর্তন পরিমার্জন রদবদল হতে থাকে সেটা নাটকের মজে থাকা মশগুল দর্শক বুঝতেই পারেন না। সেদিনও পারলেন না। আর এতদিন নজরের আড়ালে থাকা মিত্রার অতটুকু একটা সাধারণ চরিত্রকে অভিনয় গুনে একেবারে অন্যরকম করে মঞ্চে নিয়ে এলো শিবানী। প্রথম দিন প্রক্সি দিতে এসে বারবার হাততালিতে ভরিয়ে দিল প্রেক্ষাগৃহ। শিবানী এটাই চেয়েছিল সিনেমার ক্ষেত্রে। পারেনি। নাটক এসে পারল। শিবানী বুঝল যে এতদিন সে ভুল রাস্তায় ঘুরপাক খেয়েছে। মিত্রা যে একমাস অভিনয় করতে পারেনি শিবানী তখন প্রতি রাতে বিরতির প্রথমে নাচ সামলে বিরতির পরে মিত্রার চরিত্রে প্রক্সি দিয়েছে। নাটকের ডিরেক্টর পরিমল নাগ শিবানীকে ডেকে বললেন—

—শিবানী তুই কি নাচ ছেড়ে অভিনয়টাই করবি?

—আমি পারবো তো।

—পারছিস তো। মিত্রার জায়গায় লোকে তো তোকে নিয়ে নিয়েছে।

—আর মিত্রা ফিরে এলে?

—ফিরে এলে কী

—তখন কি হবে?

—তুই-ই করবি।

—আর মিত্রা? না না পরিমলদা নাচ ছেড়ে আমি সত্যি সত্যি অভিনয় করতে চাই। আপনাদের মতো গুরুর কাছে খুব ভালো করে অভিনয় শিখতে চাই। কিন্তু এই নতুন রাস্তায় পা দেবার আগে আমি কারও কাজ কেড়ে নিতে পারব না। কারও চোখের জল ফেলে আমার ভালো হবে না।—চলবে।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৩২

দুপুরের শোয়ের শেষে ব্যাকস্টেজের পিছনের দরজাটা খুলে দেওয়া হত। তখন আর হলে এসি কোথায়। একটা শোয়ের পর সব দরজা খুলে ফ্যান চালিয়ে দেওয়া হত। দুপুরের শোয়ের শেষে মেকআপ রুম থেকে হেঁটে বাইরেটা যাবার সময় স্টেজ ম্যানেজার একজনকে শিবানীর সামনে এসে দাঁড় করিয়ে দিল। চমকে উঠলো শিবানী। এক ধাক্কায় বেশ অনেকগুলো বছর পেছনে চলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে ইন্দ্র। টালিগঞ্জের প্রথম ছবির সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ডান্স ডিরেক্টর ইন্দ্র রায়।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content