শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

একটা ইঁদুর একবার এক ঘুমন্ত সিংহের নাকের কাছে চলে গিয়েছিল।
একদল পায়রা পড়েছিল শিকারীর জালে।
একটা খরগোশ কী একটা শব্দ শুনে দিকশূন্যপুরের দিকে দৌড় দিয়েছিল।
আর, একটা মাকড়সা গুহার দেওয়ালে তিন’পা উঠছিল, দু’পা পড়ছিল।
তারপর আবার উঠছিল পায়ে পায়ে।
খরগোশটা যখন দৌড়চ্ছিল, ইঁদুরটাও তার দলে ছিল।
সিংহটা পথ আটকে দাঁড়িয়ে তাদের এই ভীষণ মিশন রুখে দিয়েছিল। ওরে মূর্খের দল! জগৎটা পার হয়ে যাবি কোথায়?

পায়রাগুলো অবশ্য এসবের চক্করে ছিল না। তারা ভাবছিল, কী করা যায়। জালের মধ্যে একটা-দুটো ছটফটাচ্ছিল, হাতে ধরা সুতোয় বাঁধা বেলুনের মতো খানিক মাথা ঠুকছিল বাতাসে, অথবা ল্যাম্পপোস্টে কী ট্রামের তারে ঝুলে থাকা মচকানো ঘুড়ির মতো, নিজেকে মহাকাশে ছুঁড়ে দিতে চাইছিল বুঝি পশ্চিমের বাতাসে ভর করে।
ইঁদুরটা কোন্ মনের ভুলে, সিংহের নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে চটকে দিয়েছিল ঘুম। থাবার মধ্যে ছটফট করতে করতে বলেছিল, আর হবে না স্যর, খুব ভুল হয়ে গিয়েছে স্যর, এবারের মতো ছেড়ে দিন না স্যর…
সিংহ ছুটন্ত পশুর পালের পথ আটকে বলেছিল, মহামূর্খ তোমরা।
মাকড়সাটাও নিজেকে তেমনটাই ভাবছিল। ওই ওপরটায় না উঠতে পারলে তার জাল বোনার স্বপ্নটা সফল হবে কী করে?
সিংহটা যেদিন জালে পড়েছিল, ছোট্ট ইঁদুরের দাঁতের জোর কতো, বুঝেছিল বৈকি। ইঁদুরটাও বুঝেছিল কি?

পায়রাগুলো একটা দুটো করে উড়তে উড়তে সকলেই একসময় ডানা মেলতে চাইল, জালের ফাঁদে পড়া একদল বোকচন্দর জালসমেত কেমন করে শিকারীর নাগাল থেকে একেবারে দূরে আকাশে উড়তে লাগল অনন্ত বন্ধনমাঝে মহানন্দময় মুক্তির স্বাদে।
হনুমান বুঝে উঠতে পারেননি ঠিক কোথায় বিশল্যকরণী আছে। পুরো গন্ধমাদন পর্বতটাই ঘাড়ে করে এনে ফেলেছিলেন।
আর, “তেলমাখা বাঁশে উল্লাসে উঠেছে মাঙ্কি, সে ব্যাটা চড়ছে তেরো সেমি, পড়ছে চৌদ্দ কিমি…”
অঙ্ক মেলে না কেন? ফাঁদে পড়ে, জাল কেটে, জাল বুনে কী আন্তর্জালে যে বিপুল সমীকরণ আর সুদের ভার, তার মধ্যের জ্যামিতি, উপপাদ্য আর সিঁড়িভাঙা সরলগুলো ইঞ্চি আর কেজিতে মেপে নিতে এক জীবনে কতসময় লাগে?

জীবনের বেশিরভাগটাই কি এই অনন্তের ধারাপাত পড়তে পড়তে কাটে? কে বাঁচে, কে বাঁচায়, কে করে, কী করে, কেন-ই বা করে, কোথায়, কবে, কীভাবের জাঁতাকলে ক্যাবলামিতে ভরা নুইয়ে পড়া বিকালবেলার মতো দূরগামী ব্যথার মাঝে আধেকলীন হৃদয়ে রাতের অসীম নক্ষত্ররাজির সুর আর মহাসাগরের বিপুল কলতান কি শোনা যায়? ক্যাবলাদের চোখে যে ভুলের মায়াকাজল গভীর আলোর রবে চিকচিক করে, তা কি চোখে পড়ে না? হেতমগড় থেকে গোঁসাইবাগান জুড়ে এক অদ্ভুত আলোছায়া আর মায়াবী মনভোলানো ভুলের সাগরছেঁচা মানিকের ঝলকানি। একবার এক দৈত্যের বাগানে ঢুকে পড়েছিল সুকুমারমতি ছেলেমেয়ের দল।

স্বার্থপর দৈত্য এসে তাদের বাগানের আর অধিকারের গণ্ডীটা বুঝিয়ে দিয়েছিল খানিক। যা তোমার নয় কোনওভাবেই, তাকে আপন করে নিতে চাওয়ায় মহাপুরুষত্ব আছে বটে, আছে কাঁটার মুকুট-ও, সেই কণ্টকদীর্ণ পথ “ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া”…ক্ষুরধার, সঙ্কটাকীর্ণ, নির্বিকল্প। তবুও আগুনের দিকে পতঙ্গ, নতুনের দিকে অপরিণামদর্শী, বিপদের দিকে ক্যাবলারা ছুটে যায় বুঝি বার বার। পথের দাবিতেই হয়তো বা। তাদের নির্ভেজাল ক্যাবলামি আর স্বার্থবুদ্ধির অভাব তাদের ছুটিয়ে মারে এমনই যে, “খেয়াতরী তোমাকে বহিতে পারে না, সাঁতার দিয়া তোমাকে পদ্মা পার হইতে হয়; তাই ত দেশের রাজপথ তোমার কাছে রুদ্ধ, দুর্গম পাহাড়-পর্বত তোমাকে ডিঙাইয়া চলিতে হয়—কোন্ বিস্মৃত অতীতে তোমারই জন্য তো প্রথম শৃঙ্খল রচিত হইয়াছিল, কারাগার ত শুধু তোমাকে মনে করিয়াই প্রথম নির্মিত হইয়াছিল—সেই ত তোমার গৌরব!”…

সেই স্বার্থপর দৈত্য তার চারপাশে এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে রাখল। তাকে পার করে কোনও লালকমল-নীলকমল কী বিশুপাগল বা নন্দিনী, ঢুকতে পায় না। শীতের বাতাস, বরফ আর কুয়াশায় সেই সাজানো বাগানের পাতাগুলো শিরশিরিয়ে ওঠে। সব খোয়াবার সেই সকালে তখন শুধুই শূন্যতা, উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষ্যাপা মাতনে কাঙাল সেই দৈত্য তখন তার সকল নিয়ে বসে আছে সর্বনাশের আশায়। একদিন পাখি ডাকল। ধেয়ে এল বসন্তবায়। ফুল ফুটল বাগান জুড়ে। গাছে গাছে ফুলের মতো শিশুরা বসে, শুধু একটি ছোট্ট শিশু বাদে। কি করছে সে? কলকাতার যিশুর মতো চোখে চোখ রেখে বলবে কি, “ওহে নিষ্ঠুর দৈত্য! দেখো দেখো! কালকে আপন মানের ঘরে বন্দি সেই তুমিই আজ প্রাতে মালা হাতে কাকে বরণ করতে এসেছো? সেই দখিনপবনের কিংশুকরাগে অলক্তকরক্তিম রোদনভরা জাগ্রত বসন্তকে? পারবে তো সেই মাতাল সমীরণের ভার বহন করতে?”
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১১: দাদা অঙ্ক কী কঠিন!

কলকাতার পথ-হেঁশেল: যাদবপুর—যদুকুল ও চপস্টিকস

প্রথম আলো, পর্ব-১: বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি জানেন?

বলল বুঝি সে? না, কিচ্ছুটিই বলল না। দৈত্য তাকে বসিয়ে দিল রিক্ত তুষারশুভ্র নির্জীব বৃক্ষশাখায়। তখনই ছুটে এল প্রাণ। শ্যামল উচ্ছ্বাসে বনতল বুঝি ফুলে ফুলে ঢেকে গেল।
ভেঙে পড়ল সব কঠিন আবরণ। এবার বুঝি মারের সাগর পাড়ি দিতে হবে। যত্ন করে এঘর ধুয়ে মুছে জাগতে হবে তার প্রতীক্ষায়।
বাচ্চাটাকে আর কোনওদিন দেখতে না পেয়ে ব্যাকুল হল দৈত্য।

এরপরে আবারও কোনও এক দূর ভবিষ্যতে, এমন শীতের সকালে সেই শিশুকে দেখতে পাবে সে। তার হাতে পায়ে রক্তক্ষত অমানিশার খদ্যোতের মতো জ্বলছে। প্রেমের আঘাতে দীর্ণ সেই শিশু তার ক্ষুদ্র হাত বাড়িয়ে দেবে। নেমে আসবে অকাল বসন্তের পারিজাত, নেমে আসবে নন্দনকানন। শূন্য করে ভরে দেওয়া যার খেলা, তার আপন খেলার সঙ্গী হবে সেই দৈত্য।
অনন্ত আলয় যাঁর, তাঁর আনন্দভবনের দ্বার থেকে শোনা যাবে আনন্দগান।

বেড়া ভাঙা অথবা ডিঙোনোতেই কি ক্যাবলামি? নাকি বেড়ার ঘেরাটোপের নিরাপদ যাপন-ই ক্যাবলামির প্রথম পাঠ? অচলায়তন ভাঙাতেই সার্থকতা নাকি গড়ে তোলাতেই? নির্বিঘ্ন যাপনের আকাঙ্ক্ষা, ‘দুধেভাতে মাছেভাতে’ থাকার বাসনা কি একটা নিষ্প্রাণ শীতল তাসের দেশটুকুই গড়তে পারে? সঙ্গে চলার সহিষ্ণুতাই কি ক্যাবলামি নাকি সঙ্গত্যাগের সাহসটুকুও? বিরোধ আর প্রতিবাদের শিক্ষায় দীক্ষিত না হলেই কি ক্যাবলা হতে হয় নাকি বাঁধ ভেঙে দিলেই? যারা বাঁধ গড়ে দেয় আবার তারাও কি ক্যাবলামির বশীভূত? চেনা ছকের মাপা গণ্ডীর ভিতরে বসে চাপা কান্নার উদযাপনেই ক্যাবলামি নাকি ছকভাঙায়? প্রশ্ন করতে না পারাটাই ক্যাবলামি নাকি চোখে চোখ রেখে বলতে পারাটাই? লজ্জায় চোখ তুলতে না পারলেই ক্যাবলামি নাকি তা পারলেই তাকে দাগিয়ে দেওয়াটাই? খরগোশ ক্যাবলা ছিল নাকি কচ্ছপটা? বাঘের স্বাধীনতাটুকুই ক্যাবলামি নাকি কুকুরের অধীনতাটাই? বেঁধে বেঁধে থাকাই কি আজ ক্যাবলামি নাকি নিজেকে অদ্বিতীয় অপরিহার্য ভাবাই? দিশাহীন নির্বোধ স্বতোত্সার আবেগ ক্যাবলামি নাকি মেপে চেপে চলার বুদ্ধিটাই? নির্ভেজাল নিছক কিংকর্তব্যবিমূঢ় ক্যাবলামি কি সামাজিক জীবমাত্রের-ই জীবনখাতার প্রতি পাতায় লেখা থাকে? ক্যাবলারা সত্যিই সামাজিক নাকি খাপছাড়া অসামাজিক? খাপছাড়া হলেই কি অসামাজিক হতে হয়? সামাজিক হতে পারাটাই কি সার্থকতা? ক্যাবলামি পায়ের বাঁধন নাকি হাতের অস্ত্র? ক্যাবলা হতে পারলে লাভ না ক্ষতি? ক্যাবলা না হলে কতটা লাভ? ক্যাবলারা কি আদতেই বোকা আর নির্বোধ?

নিজেকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা স্বার্থপর আত্মমুগ্ধতার মাদকতা থেকে কখনও যদি পাষাণপুরীর দৈত্য মুক্তি পায়, তবে জীবন কখনও মুচকি হেসে ওঠে। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা পাওয়ার, আপন থেকে বাইরে আসার সেই অবসর… সোনায় মোড়া পাষাণপুরী থেকে একছুট্টে বেরিয়ে অনন্ত মহাকাশের নিচে দাঁড়ানোর।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৩: কানে ব্যথা? তেল দেবেন কি?

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-২: ভারতের স্থাপত্যশৈলীতে ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিব মন্দিরের অবদান অপরিসীম

নিজের মধ্যে আর চারপাশে জমিয়ে রাখা পাষাণভার ডিঙিয়ে সবুজ মাঠে নামার মতো ক্যাবলামিগুলোর নগদে-পয়সায় দাম না থাকাই রীতি। তবুও কেউ কেউ মাঠে নামে। সীমার মাঝেই অসীম আনন্দের যে মহা পার্থিব আয়োজন, তার সাজানো বাগানে রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ-শব্দের যে মায়াকানন রচিত হয় তাতে ক্রমাগত ছুটে চলায় কিংবা স্বপনসঞ্চারিণী স্বর্ণহরিণীর অক্লান্ত সন্ধানে অথবা হিরণ্যগর্ভ সত্যের অপার আকাঙ্ক্ষাতেই যে অনায়াস ক্যাবলামির অনন্ত সম্ভাবনা আর আহ্বান তাকে মেপে ফেলে নোটবুকে টুকে নেওয়ায় যে অকারণ নিষ্ফল আয়াস তাও এক অদ্ভুত ক্যাবলামি বটে!

দীর্ঘ জীবনপথ পার হতে হতে দু’ পাশের চলমান পরিবর্তন, ছায়াঘন মেদুর বীথি, রথের চাকার ঘর্ঘর, সরে সরে যাওয়া মানুষ, জগৎ, কালখণ্ড, আদর্শ, বোধ, “সম্ভবামি যুগে যুগে”র বিশ্বাস, ছায়ার মতো থাকা না থাকার পেণ্ডুলাম ধ্বনি পার করতে করতে স্টেশন আসে, যায়, আবার আসে, আবারও যায়, ক্যাবলামি আর তার অনুসারী শিল্পের জগতেও কি বিপ্লব আসে না? নাকি চাঁদ সূর্যের মতো এক শাশ্বত অটল ধ্রুবতারা হয়ে তারা ধিকধিক করতে থাকে? ক্যাবলামিগুলো তার সারল্য আর বোকামি ছেড়ে কি কখনও নির্ভেজাল স্বার্থে ভর করে বাতাসে গা ভাসায়?

আমরা বরং এসব ছেড়ে একটু গঞ্জের বাজারের দিকে তাকাই।
“লোকজন ভিড় করে এল। একজন বলতে লাগল, “উনি ‘বাঃ বাঃ’ বলে কাকে যেন বাহবা দিচ্ছিলেন এইমাত্র। তবে পড়লেন কেন?”
অন্যজন বলল, “উনি এত জোরে সাইকেল চালিয়েছিলেন যে, নিজের এলেম দেখে নিজেকে নিজেই বাহবা দিচ্ছিলেন।”
একটা বাচ্চা ছেলে তার বাবাকে জিগ্যেস করল, “সাইকেলটাও কি অজ্ঞান হয়ে গেছে বাবা?”…”
আসল ব্যাপার অন্যরকম। বেজায় গোলমেলে আর ভয়ানক রকমের বেয়াড়া ধরণের।
“হরিহরবাবু সাইকেলে চেপে তিস্তাঘাটে গিয়েছিলেন। সন্ধের মুখে ফিরবার সময় গঞ্জের উত্তর দিকের শাল-জঙ্গলের মধ্যে বাতাস শুকে বাঘের গন্ধ পেলেন। এত জোরে সাইকেল চালিয়েছিলেন যে, দু’-চাকার গাড়িখানা শেষমেশ চাকায় ভর দেওয়া ছেড়ে যেন পাখনায় ভর করল। বাজারের কাছে এসে “বাঃ…বাঃ” বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন সাইকেলসুদ্ধ।”

ডাকাত, পুলিস, ভূত আর বাঘ এখানে একসঙ্গে দৌড়োদৌড়ি করে, ডনবৈঠক দেয়। ভয় কখনও কালো শালের মতো জাপটে ধরে, কখনও ভয়ের ইচ্ছা হলেও ভয় আসে না। এই যেমন শ্রুতিধর অঙ্কের স্যর করালীবাবু হঠাৎ করেই সিগন্যাল না পাওয়া ট্রেনের মতো থমকে দাঁড়ান, আচমকা পাওয়ার কাটে থমকানো পাড়ার মতো নিভে যান একেবারে…
… “সময় নেই, করালীবাবু বুরুনের কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব চেঁচিয়ে কথাটা বলতে গিয়েই বিস্ময়ে থ’ হয়ে গেলেন। কথাটা তাঁর একদম মনে নেই! বেমালুম ভুলে গিয়েছেন।
ঘ্রা-ড়া-ড়া-ড়া-ড়া–হু-উ-ম! আবার ডাকল বাঘটা। এবার খুব কাছেই। পায়ের শব্দটাও এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে।
আরও পড়ুন:

যত মত, তত পথ, পর্ব-১: শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দ-পাঠশালা

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন

করালীবাবু নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলছেন রাগে। কথাটা কিছুতেই মনে পড়ছে না যে…হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা শব্দ ছিল…অঙ্ক…আর একটা যে কী যেন…তেরো…তেরো…হ্যাঁ…।
ওদিকে আর একটা দরজা। সেই দরজার লোহার হুড়কো খোলার শব্দ হচ্ছে।
করালীবাবুর হাতের খামচায় একগোছা চুল তাঁর মাথা থেকে উপড়ে এল। …তেরো..তেরো..তেরো… নামতার সুরে… বুরুন…বুরুন…বুরুন…”

একে একে এগিয়ে আসছে নররক্তপিপাসু ডাকাত আর বাঘ। পিছন দিকে ফিরে টেনে দৌড় দেওয়ার উপায় বন্ধ। চৌব্বাচ্চার অঙ্কে ক্রমাগত বেরিয়ে যাওয়া জল হঠাৎ করে অদৃশ্য, লাঠি থেকে বাঁদরটা নেমে দারুণ আক্রোশ মুখ ভ্যাংচাচ্ছে, শেষ ডাউনের ট্রেন চলে গেছে, প্রচণ্ড তেষ্টা, সামনে ঠান্ডা জল হাতে কে যেন বক্তৃতা দিচ্ছে, জলগুলো বাতাসে ভেসে ভেসে তেলমাখা বাঁশের দিকে যাচ্ছে, বিরিঞ্চিবাবার সামনে বসে কেউ হাসি চাপছে, ভাবছে, পিছনে রয়্যাল বেঙ্গল তাড়া করেছে, কানে গঙ্গাফড়িং আর নাকে গুবরে পোকা কুরেকুরে খেয়ে নিচ্ছে আর বিরিঞ্চিবাবা বলে চলেছেন, “ষড়ৈশ্বর্য সস্তায় হয় না বাপু, কঠোর সাধনা চাই।

মূলাধারচক্রে ঠেলা দিয়ে কুলকুণ্ডলিনীকে আজ্ঞাচক্রে আনতে হবে, তারপর তাকে সহস্রার পদ্মে তুলতে হবে। সহস্রারই হচ্ছেন সূর্য। এই সূর্যকে পিছু হটাতে হবে। সূর্যবিজ্ঞান আরম্ভ না হ’লে কালস্তম্ভ করা যায় না। তাতে বিস্তর খরচ—তোমার কম্ম নয়। তুমি আপাতত কিছুদিন মার্তণ্ডমন্ত্র জপ কর। ঠিক দুপপুর বেলা সূর্যের দিকে চেয়ে একশ—আটবার বলবে—মার্তণ্ড—মার্তণ্ড—মার্তণ্ড, —খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু খবরদার, চোখের পাতা না নড়ে, জিব জড়িয়ে না যায়— তা হ’লেই মরবে।”

পরীক্ষা এগিয়ে এলে অনেকের কী একটা যেন হয়, অনেক ভ্রমণপিপাসু বাসে উঠে পরের স্টপের আগেই যেমন একটা পলিথিন কী ঠোঙা, যাহোক কিছু হাতড়ে খোঁজে অথবা সাগরের তীরে ক্ষ্যাপা একটা লোক কী তার হারানো মানিক খুঁজে ফেরে… আর বিপদের গন্ধে ভেবলে যাওয়া অঙ্কের ভয়ানক স্যার করালীবাবু ‘সর্বনাশে সমুত্পন্নে’ কী করেন?

“বাঘটা ডাকল–ঘ্র-ড়-ড়-অ…
কী সাংঘাতিক রক্ত-জল-করা ডাক!
করালীবাবু অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। যেতেনই, তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে পুরো বাক্যটা মনে পড়ে গেল।
সঙ্গে-সঙ্গে করালীবাবু পাঠশালার সর্দার-পোড়োর মতো বিকট সুরে চেঁচাতে লাগলেন, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি…”
অঙ্কে তেরো পেয়েই হিসেব মেলাবেন নাকি ঐ তেলমাখা বাঁশের আহাম্মক বাঁদর হয়ে করালীবাবুর মতোই নামতা মুখস্থ করতে করতে ভোরটুকু ছিনিয়ে আনবেন? ‘আদ্যানাথের মেসোর’ ঠিকানায় জানাতে ভুলবেন না।

ঋণ স্বীকার:
সেলফিস জায়েন্ট: অস্কার ওয়াইল্ড
বিরিঞ্চিবাবা: রাজশেখর বসু
গোঁসাইবাগানের ভূত: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content