রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গাতীরে ভবতারিণী মন্দিরে, দ্বাদশ শিবমন্দির সংলগ্ন শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে পাঠশালা বসেছে। হৃদয় মন স্নিগ্ধকরা ভারী মনোরম পরিবেশ। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে কথামৃতকার শ্রীম অতি মনোজ্ঞ বর্ণনা দিয়েছেন এই মনোরম পরিবেশের।

“উদ্যানের দক্ষিণ প্রান্ত হইতে উত্তরে বকুলতলা ও পঞ্চবটী পর্যন্ত গঙ্গার ধার দিয়া পথ গিয়াছে। সেই পথের দুই পার্শ্বে পুষ্পবৃক্ষ। আবার কুঠির দক্ষিণ পার্শ্ব দিয়া পূর্ব-পশ্চিমে যে পথ গিয়াছে তাহারও দুই পার্শ্বে পুষ্পবৃক্ষ। গাজিতলা হইতে গোশালা পর্যন্ত কুঠি ও হাঁসপুকুরের পূর্বদিকে যে ভূমিখণ্ড, তাহার মধ্যেও নানা জাতীয় পুস্পবৃক্ষ, ফলের বৃক্ষ ও একটি পুস্করিণী আছে।”
“অতি প্রত্যূষে পূর্বদিক রক্তিমবর্ণ হইতে না হইতে যখন মঙ্গলারতির সুমধুর শব্দ হইতে থাকে ও সানাইয়ে প্রভাতী রাগরাগিনী বাজিতে থাকে, তখন হইতেই মা কালীর বাগানে পুষ্পচয়ন আরম্ভ হয়। গঙ্গাতীরে পঞ্চবটীর সম্মুখে বিল্ববৃক্ষ ও সৌরভপূর্ণ গুলচি ফুলের গাছ। মল্লিকা, মাধবী ও গুলচি ফুল শ্রীরামকৃষ্ণ বড় ভালোবাসিতেন। মাধবীলতা শ্রীবৃন্দাবনধাম হইতে আনিয়া তিনি পুঁতিয়া দিয়াছেন। হাঁসপুকুর ও কুঠির পূর্বদিকে যে ভূমিখণ্ড তন্মধ্যে পুকুরের ধারে চম্পক বৃক্ষ। কিয়দদূরে ঝুমকাজবা, গোলাপ ও কাঞ্চনপুষ্প। বেড়ার উপরে অপরাজিতা, নিকটে জুঁই কোথাও বা শেফালিকা। দ্বাদশ মন্দিরের পশ্চিম গায়ে বরাবর শ্বেতকরবী, রক্তকরবী, গোলাপ, জুঁই, বেল। ক্কচিৎ বা ধুস্তরপুষ্প… মহাদেবের পূজা হইবে। মাঝে মাঝে তুলসী… উচ্চ ইস্টক নির্মিত মঞ্চের উপর রোপণ করা হইয়াছে। নহবতের দক্ষিণ দিকে বেল, জুঁই, গন্ধরাজ, গোলাপ। বাঁধাঘাটের অনতিদূরে পদ্মকরবী ও কোকিলাক্ষ। পরমহংসদেবের ঘরের পাশে দুই-একটি কৃষ্ণচূড়ার বৃক্ষ ও আশে-পাশে বেল, জুঁই, গন্ধরাজ, গোলাপ, মল্লিকা, জবা, শ্বেতকরবী, আবার পঞ্চমুখী জবা, চিন জাতীয় জবা।…
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭০: অন্য বাইশে শ্রাবণ

“কালীবাড়ি আনন্দ-নিকেতন হইয়াছে। রাধাকান্ত, ভবতারিণী ও মহাদেবের নিত্যপূজা, ভোগরাগাদি ও অতিথিসেবা। একদিকে ভাগীরথীর বহুদূর পর্যন্ত পবিত্র দর্শন। আবার সৌরভাকুল সুন্দর নানাবর্ণরঞ্জিত কুসুমবিশিষ্ট মনোহর পুস্পদ্যান। তাহাতে আবার একজন চেতনমানুষ অহর্নিশি ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা হইয়া আছেন। অনন্দময়ীর নিত্য উৎসব।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত ১-১-১, শ্রীম, আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম আনন্দ সংস্করণ-১৯৮৩, পৃ: ১১-১২)

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিবিধ প্রবন্ধে, পত্রাবলীতে, আলাপচারিতায় ও বিবিধ প্রসঙ্গে প্রকৃতির মধ্যে যে শিক্ষার কথা বারবার বলেছেন, সেই আদর্শ প্রকৃতিকে জগন্মাতা যেন দক্ষিণেশ্বরে নামিয়ে এনেছিলেন অতুলনীয় ভাবী শিক্ষক শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের জন্য। জগন্মাতার এই আনন্দকাননে, শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দ-পাঠশালায়, আগেও অনেক বালক-বালিকা থেকে বৃদ্ধ বৃদ্ধারা শিক্ষা নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তার সঠিক ইতিহাস ও পাঠের বর্ণনা আমরা তেমনভাবে পাই না, যেমন পাই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯: সুন্দরবনের লুপ্ত নদী আদিগঙ্গা

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

কথামৃতে আমরা দেখি কথামৃতকার শ্রীম, যাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণ ‘মাস্টার’ বলেও সস্নেহ সম্বোধন করতেন, প্রথম প্রবেশ করছেন শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দ-পাঠশালায়। এই সেই ‘মাস্টার’ যিনি ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম অনুরাগী ছাত্র, যিনি পরবর্তীকালে সিটি, রিপন, মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যাপক হয়েছিলেন। কেমন ছাত্র ছিলেন তিনি?

এন্ট্রান্সে এই ‘মাস্টার’ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন, এফএ পরীক্ষায় অঙ্কের একটা খাতা জমা না দিয়েই পঞ্চম স্থান পান। বিএ পরীক্ষায় অধিকার করেন তৃতীয় স্থান। এমন একজন মেধাবী ও কৃতী ছাত্র প্রথম প্রবেশ করছেন শ্রীরাকৃষ্ণের পাঠশালায়। তাঁকে তো ভঙ্গী দিয়ে, কথার মারপ্যাঁচে বা বুজরুকিতে ভোলানো যাবে না। তাঁর কী অনুভূতি? শুনি তাঁর নিজের স্বীকারোক্তি—
“গঙ্গাতীরে দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়ি। মা-কালীর মন্দির। বসন্তকাল, ইংরাজী ১৮৮২ খৃস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস। …সন্ধ্যা হয় হয়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে মাস্টার আসিয়া উপস্থিত। এই প্রথম দর্শন। দেখিলেন, একঘর লোক নিস্তব্ধ হইয়া তাঁহার কথামৃত পান করিতেছেন। ঠাকুর তক্তপোষে বসিয়া পূর্বাস্য হইয়া সহাস্যবদনে হরিকথা কহিতেছেন। ভক্তেরা মেঝেয় বসিয়া আছেন। “মাস্টার দাঁড়াইয়া অবাক হইয়া দেখিতেছেন। তাঁহার বোধ হইল যেন সাক্ষাৎ শুকদেব ভগবৎ কথা কহিতেছেন, আর সর্বতীর্থের সমাগম হইয়াছে। অথবা যেন শ্রীচৈতন্য পুরীক্ষেত্রে রামানন্দ স্বরূপাদি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন ও ভগবানের নাম গুণকীর্তন করিতেছেন।” (ঐ, পৃ: ১৩)
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩২: আটার চেয়ে ময়দা ঢের গুণ ভালো?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৪: কোন সকালে মুক্তির অপেক্ষায় ‘ত্রিযামা’

শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দ-পাঠশালায় মাস্টার আনন্দ-মৌতাতে বাঁধা পড়ে গেলেন। জীবনে আর ফিরতে পারেননি। তাঁর মন-প্রাণ-হৃদয়-আত্মা সব অধিকার করে নিলেন এই আনন্দ-পাঠশালার গুরুমশায় আনন্দময় শ্রীরামকৃষ্ণ। ময়ূরের উদাহরণ দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, তাঁর পাঠশালায় এলে ছাত্রদের কি অবস্থা হয়—”দেখ, একটা ময়ূরকে বেলা চারটার সময় আফিম খাইয়ে দিছিল। তার পরদিন ঠিক চারটার সময় ময়ূরটা উপস্থিত—আফিমের মৌতাত ধরেছিল, ঠিক সময়ে আফিম খেতে এসেছে।” (ঐ, পৃ: ২৭)

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, শ্রীরামকৃষ্ণের পাঠশালা না বলে, কেন শ্রীরামকৃষ্ণের বিদ্যালয় বলছি না? আসলে, বিদ্যালয়ে ছাত্র কিছু শিখে আসে, কেউ কেউ অনেক উঁচু শ্রেণিতে ভর্তি হয়, কিন্তু পাঠশালায় শিখতে হয় একেবারে প্রথম থেকে। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এসে সকলেই বুঝতে পেরেছেন তাঁদের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের সব শিক্ষা প্রায় মাঠে মারা গিয়েছে। এমনকি মাস্টারের মতো কৃতী ও মেধাবী ছাত্রও বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের সব গণ্ডি পেরিয়েও বুঝতে পারেন তাঁকে নতুন করে এই পাঠশালায় আবার সব শিখতে হবে। তাই মাত্র দ্বিতীয় দর্শনের সময়েই শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলে তিনি হার মেনে স্বীকার করেন, “ঠাকুরের সহিত তাঁহার এই প্রথম ও শেষ তর্ক।” (কথামৃত, ১ম খণ্ড, ১ম অধ্যায়, ৩য় পরিচ্ছেদ)
* সুসময় রায় চৌধুরী (Susamay Roy Chowdhury) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইরাজি সাহিত্যে সাম্মানিক ও সাংবাদিকতায় এমএ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ: ১. শিক্ষায় জীবন গঠন ও আনন্দলাভ—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ, ২. শ্রীরামকৃষ্ণ-আলোয় সবার জীবন, ৩. শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান—প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। আরও কয়েকটি খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায়।

প্রকাশিতব্য: ১. জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য—ঈশ্বরলাভ, ২. কে তুমি শ্রীরামকৃষ্ণ?, ৩. কে তুমি বিবেকানন্দ?, ৪. জন্মানতরবাদ—ভারতীয় শাস্ত্র ও ঋষি, মহামানবেরা।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content