শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

মনে রাখতে হবে যে, রাজবাড়ির “সম্মার্জন কর্তা” হলেও ঝাড়ুদার গোরম্ভ কিন্তু রাজার লোক। তাই গোরম্ভকে কী করে প্রসন্ন করা যায় সেই নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে শুরু করলেন দন্তিল। অনেক রকম চিন্তা-ভাবনা করেও কোনও রকম উপায়ান্তর না দেখে, শেষ পর্যন্ত একদিন দন্তিল সন্ধের দিকে সে গোরম্ভকে আলাদা করে বাড়িতে ডেকে, দু’খানি বেশ ভালো রকমের দামী বস্ত্র তাঁকে উপহার দিয়ে খুব সম্মান দেখিয়ে প্রায় হাত জোড় করে বললেন, “ভদ্র! মযা ন তদা ত্বং রাগবশান্নিঃসারিতঃ”—ওহে গোরম্ভ মশাই! ভাববেন না যে আপনার উপর কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশ বা রাগের জন্য আপনাকে সেদিন আমার বিবাহ উত্সবের রাত্রিতে বের করে দিয়েছিলাম। আসলে রাজা আর ব্রাহ্মণদের বসবার জন্য যেখানে আলাদা করে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, আপনি সেই অনুচিত স্থানে গিয়ে বসে পড়েছিলেন আর আমিও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কাজের চাপের মধ্যে থাকায় মেজাজ হারিয়ে আপনাকে অপমান করে ফেলেছি। “তৎক্ষম্যতাম্‌”— আপনার কাছে তাই আমি ক্ষমা ভিক্ষা করছি। আমাকে মাফ করবেন।

দন্তিলের মতো একজন উচ্চপদস্থ সম্মানীয় ব্যক্তি, সমাজে যাঁর প্রতিষ্ঠা আছে, সে যখন গোরম্ভের মতো এ রকম সামান্য একজন ঝাড়ুদারের কাছে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা ভিক্ষা করে, তখন সেই গোরম্ভের মতন মানুষজন কি তাঁকে ক্ষমা প্রদান না করে থাকতে পারে? আমি বলব বাস্তবটা আরও অন্যরকম হয়—সেই সামান্য মানুষটি তখন সেই উচ্চপদস্থ মানুষটিকে শুধু ক্ষমাই করেন না, তাঁর ভালো করার জন্য যাকে বলে জান-প্রাণ দিয়ে দেয়। পণ্ডিতরা বলেন—

সুপুরা স্যাত্কুনদিকা সুপুরো মুষিকাঞ্জলি।
সুসন্তুষ্টঃ কাপুরুষাঃ স্বল্পকেনাপি তুষ্যতি।।


অর্থাৎ যে নদীর জল কম সে নদী কুনদী—সামান্য জলেই সে নদী উপচে পড়ে পূর্ণ হয়ে যায়। মুষিক হল ইঁদুর; সেই মুষিক যদি দু’ হাত পেতে কিছু চায় তার ছোট হাত দুটি ভরে দিতে কতটুকুই বা দ্রব্য লাগে। নাম মাত্র দ্রব্যে মুষিকাঞ্জলি পূর্ণ হয়ে যায়। সেই রকমই যারা কাপুরুষ, বেশি কিছু করবার যাদের ক্ষমতা নেই, তাদের চাহিদাটাও এইরকমই—কুনদী বা মুষিকাঞ্জলিরই সমান। সামান্য কিছু পেলেই তারা তুষ্ট—বড় কিছু তারা ভাবতেও পারে না, চায়ও না; এমনকি দিলেও গ্রহণ করবার মতন ক্ষমতা তাদের থাকে না।

দন্তিলের কাছ থেকে পাওয়া বহুমূল্য বস্ত্রখণ্ড দুটি গোরম্ভের কাছে ছিল “স্বর্গরাজ্যোপমম্‌”—স্বর্গতুল্য। সেগুলি পেয়ে পরম তুষ্ট হয়ে সে দন্তিলকে বলল, “ভোঃ শ্রেষ্ঠিন্‌! ক্ষান্তং মযা তে তৎ। তদস্য সম্মানস্য কৃতে পশ্য মে বুদ্ধিপ্রভাবং রাজপ্রসাদং চ”—ওহে শেঠজি আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম। মানেটা হল যে, সব ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গিয়েছে সেসব নিয়ে আর বেশি ভাবতে হবে না। আজ যে সম্মানটা আপনি আমায় দিলেন তার পরিবর্তে আপনি এবার শুধু দেখুন আমার বুদ্ধির খেলাটা। আবার যাতে আপনার উপর রাজকৃপা বর্ষণ হয় সে ব্যবস্থা আমিই করব। এই বলে খুব প্রসন্ন চিত্তে সেই গোরম্ভ সেখান থেকে চলে গেল।

আসলে দুষ্ট লোকের মানসিকতাটা অনেকটা দাঁড়িপাল্লা সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পঞ্চতন্ত্রকার বলছেন—

স্তোকেনোন্নতিমাযাতি স্তোকেনাযাত্যধোগতিম্।
অহো! সুসদৃশী চেষ্টা তুলাযষ্টে খলস্য চ।। (মিত্রভেদ, ১৬১)

মানেটা হল, তুলাযন্ত্র বা দাঁড়িপাল্লা যেমন সামান্য ওজনের তারতম্যে উপর-নীচ হয়, দুষ্টের মনও তাই। সামান্য কিছু পেলে যেমন তারা রুষ্ট হয়, তেমনই সামান্য কিছু পেলেই আবার তুষ্টও হয় তারা। আসলে সকল মানুষেরই যে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ীই আসন গ্রহণ করা উচিত, সেটা বোধহীনেরা বোঝে না বলেই তাদের কপালেও ওই গোরম্ভের মতনই গলাধাক্কা জোটে আর তাতেই তারা রুষ্ট হয়ে বিপর্যয় ঘটায়। আবার তাদেরকে সামান্য কিছু উপঢৌকন দিলেই তুষ্ট হতেও সময় লাগে না তাদের দুর্জনের চরিত্রই এমন—“তুলাযষ্টি”র মতো, এখনই ভালো তো পরমুহূর্তেই খারাপ।

পরেরদিন ঠিক আগের মতোই রাজা যখন সকাল বেলায় আধো ঘুমের মধ্যে আছেন, রাজার বিছানার আশপাশ দিয়ে ঝাড়ু দিতে দিতে রাজবাড়ির “সম্মার্জনকর্তা” সেই গোরম্ভ ঠিক কায়দা করে, রাজা যাতে শুনতে পায় সেভাবে বলল— “অহো! অবিবেকোঽস্মদ্ভূপতেঃ যত্পুরিষোত্সর্গমাচরংশ্চির্মটীভক্ষণং করোতি”—আমাদের বোধবুদ্ধিহীন রাজার কথা আর কি বলব? সে তো পায়খানা করতে করতে “চির্মটী” মানে কাঁকড়ি খায়। কাঁকড়ি অনেকটা শসার মতন একটা ফল। রাজা নাকি মলত্যাগ করতে করতে শসার মতো কাঁকড়ি চিবিয়ে খায়।

আধঘুমের মধ্যে রাজা গোরম্ভের কথা শুনেই হতচকিত আর সেইসঙ্গে ততোধিক বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল—“রে রে গোরম্ভ! কিমপ্রস্তুতং লপসি? গৃহকর্মকরং মত্বা ত্বাং ন ব্যাপদযামি। কিং ত্বযা কদাচিদহমেবংবিধং কর্ম সমাচরন্দৃষ্টঃ?”—ওরে বেটা গোরম্ভ! কী সব পাগলের মতো বকছিস? শুধু বাড়িতে কাজ করিস বলে তোকে আমি মারছি না। আমাকে দেখেছিস কি কোনওদিন এ ভাবে কখনও কাঁকড়ি চিবিয়ে খেতে?

গোরম্ভ কাঁচুমাঁচু মুখ করে সেই একই কথা বলল— “দেব! দ্যুতাসক্তস্য রাত্রিজাগরণেন সম্মার্জনং কুর্বাণস্য মম বলান্নিদ্রা সমাযাতা। তযাধিষ্ঠিতেন মযা কিঞ্চিজ্জল্পিতং তন্ন বেদ্মি”—হে রাজন রাত্রি জেগে জুয়া খেলে সকাল-সকাল এই ঝাড়ু-পোছার কাজ করতে করতে কখন যে ঘুমে একটু চোখ লেগে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি। তাই ঘুমের মধ্যে কী বলতে কী বলে ফেলেছি জানি না— “তত্প্রসাদং করোতু স্বামী নিদ্রাপরবশস্য”। তাই হে রাজন ঘুমের মধ্যে অপরাধ করে ফেলেছি, আপনি প্রসন্ন হোন। আমাকে ক্ষমা করুন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৭: অশিক্ষিত বা মূর্খ-ব্যক্তি রাজসেবক হলে সর্বত্রই সবার আগে তাকে সম্মান করতে হয়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭০: অন্য বাইশে শ্রাবণ

রাজা তখন ভাবলেন আমি যেখানে জন্মান্তরেও কখনও মলত্যাগ করতে করতে কাঁকড়ি চিবিয়ে খাইনি, সেখানে এই মাতালটা যা খুশি তাই বলে যাচ্ছে। দন্তিলের সম্পর্কেও, তারমানে এ যা যা বলেছে সেটার মধ্যেও যে বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই আমি এখন নিশ্চিত। এই মাতালের কথা বিশ্বাস করে দন্তিলের উপর অযথা সন্দেহ করে সে বেচারাকে অকারণে রাজকীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করাটা আমার উচিত হয়নি। সে না থাকায় রাজকারবারের পাশাপাশি পৌরজনপদ কার্যেও খুবই শিথিলতা এসেছে, আজই তার একটা প্রতিবিধান করতে হবে।

এ ভাবে অনেক রকম কথা চিন্তা করে রাজা দন্তিলকে ডেকে নিজের অঙ্গের বস্ত্র ও আভরণ প্রদান করে পুনরায় তাঁকে স্বকার্যে পুনর্নিযুক্ত করলেন।
 

তৃতীয় কাহিনি সমাপ্ত

দমনকের এই কাহিনির মর্মার্থ বুঝে সঞ্জীবক বললেন— “ভদ্র এবমেবৈতৎ। যদ্ভবতাভিহিতং তদেব মযা কর্তব্যম্‌।” সবই বুঝলাম মহাশয়। তাই হবে, আপনি যেমনটা বলবেন সেইটাই আমি করব।

দমনক নিশ্চিত হয়ে বৃষ-সঞ্জীবককে নিয়ে পিঙ্গলকের কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, হে রাজন! সঞ্জীবককে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে এখানে আমি এনেছি, এ বার আপনার যা উচিত মনে হয় তাই করুন।

সঞ্জীবকও সিংহ-পিঙ্গলককে সাদরে প্রণাম করে সবিনয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। পিঙ্গলক তখন তাঁর ভয়ঙ্কর বজ্রের মতো নখে সজ্জিত ডানহাতের থাবাখানি উঠিয়ে সুপুষ্ট সঞ্জীবককে অভয় দিয়ে অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করে বললেন, “অপি শিবং ভবতঃ?” সব কিছু মঙ্গলময় তো? কিভাবে আপনি এই বিজন বনে একা এসে উপস্থিত হলেন? আপনার বৃত্তান্ত শুনতে আমি নিতান্তই আগ্রহী।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩২: আটার চেয়ে ময়দা ঢের গুণ ভালো?

সঞ্জীবক তখন কীভাবে বর্ধমান-বণিকের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হল—সে সব কথাই পিঙ্গলকের কাছে নিবেদন করল। সব শুনে পিঙ্গলক সাদরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন— “বযস্য ন ভেতব্যম্‌”, ভয় পাবেন না বন্ধু। আপনি আমার এই “ভুজপঞ্জর”-এর দ্বারা সবসময়ে সুরক্ষিত থাকবেন। কিন্তু অবশ্যই আপনি আমার পাশে পাশেই থাকবেন সব সময়ে। কারণ হিংস্র জন্তুজানোয়ারে ভরা এ বনে বড় বড় প্রাণীরাই থাকতে পারে না সেক্ষেত্রে আপনি তো সামান্য একজন তৃণভোজী মাত্র।

এই বলে সিংহ পিঙ্গলক নিশ্চিন্ত হয়ে যমুনাকচ্ছে নেমে প্রাণ ভরে তৃষ্ণা মিটিয়ে জলপান করে সেই বনেই প্রবেশ করলেন। তারপর থেকে করটক আর দমনকের উপর রাজ্যভার অর্পণ করে নিশ্চিতে বৃষ-সঞ্জীবকের সঙ্গে সুভাষিত আলাপে দিন কাটাতে লাগলেন। বলা ভালো সঞ্জীবকের মতো এমন এক সাধুসঙ্গ লাভ করে পিঙ্গলক তাঁর সঙ্গে রাত্রিদিন ধর্ম আলোচনায় নিমগ্ন হয়ে গেলেন। আসলে এই ধরণে সাধুসঙ্গ ক্বচিৎকদাচিৎ-ই মানুষের কপালে জোটে আর পিঙ্গলক সেই সুযোগটা নিয়ে দিনরাত সঞ্জীবকের সঙ্গে সুন্দর আলোচনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন।

এ ভাবে বহুশাস্ত্রসমুদ্রে অবগাহন করে উত্পন্ন বুদ্ধিপ্রভাবে সঞ্জীবকও কিছুদিনের মধ্যেই সেই মূঢ়মতি সিংহ-পিঙ্গলককে এমনই ধৈর্যবান করে তুললো যে তাঁকে তাঁর নিজস্ব হিংস্র অরণ্য ধর্মটাকেই ভুলিয়ে দিয়ে পরস্পরকে সহযোগিতামূলক দয়া, করুণা প্রভৃতি গ্রামধর্মে নিযুক্ত করলেন। ব্যাপারটা তখন এমন হতে শুরু করলো যে, প্রতিদিনই পিঙ্গলক ও সঞ্জীবক দু’ জনে মিলে একান্তে সারাক্ষণ কথা বলতেন কিন্তু অন্যান্য কোনও প্রাণীকে সেখানে আসতে দিতেন না, তারা সকলে দূরে দাঁড়িয়ে থাকত। এমনকি সেখানে করটক-দমনকেরও প্রবেশের অধিকার ছিল না।

কিন্তু সে সিংহ পরাক্রম ভুলে যাওয়ায় শিকার-টিকার করা ছেড়ে দিলো আর তাঁর সমস্ত সহচর প্রাণীরা এবং দুই শেয়াল সকলেই খিদেয় বনের একদিনে চুপ করে বসে থাকতে শুরু করল।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৯: তা বলে কি প্রেম দেব না!

আসলে রাজার কাছে মানুষ আসেই এই পরাক্রমের আকর্ষণে। কারণ ধর্মের অনুসন্ধান করলে মানুষ তো ধার্মিকের কাছে যেতো। তাই রাজা পরাক্রম ভুলে ধার্মিক হয়ে গেলে সে কুলীন কিংবা জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ হলেও তাঁর উপজীবিরা তাঁকে ত্যাগ করে চলে যায়। রাজার সম্পদের মূলই হল পরাক্রম; পরাক্রমহীন রাজা হীনসম্পদ হন এবং রাজকর্মচারীদের প্রয়োজনীয় রাজবৃত্তিটুকুও পর্যন্ত তখন সঠিক সময়ে দিতে পারেন না সে রাজা। তাই ফুল-ফল ফোটার সম্ভাবনা না থাকায় পাতা ছাড়া গাছকে যেমন ভাবে পাখিরা ছেড়ে চলে যায় তেমনই ভাবে, পরাক্রমের অভাবে সঠিক সময়ে বৃত্তি প্রদান করতে না পারা রাজাকেও তাঁর রাজকর্মচারীরা ছেড়ে চলে যান। অপরদিকে যে রাজা সঠিক সময়ে ভরণ-পোষণ করেন আবার সময়ে বেতনটিও দেন, সে রাজা শত ভর্ত্সনা করলেও সেবকেরা তাঁকে ছেড়ে চলে যায় না। এইটাই সেবকের ধর্ম।

পাঠকদের শুধু বলব, এই পরাক্রমী রাজার ধর্মভাবনায় তৃণজীবী হয়ে যাওয়ার রূপকটা কোথাও কি আপনাকে পরাক্রমী মৌর্য সম্রাট অশোকের অহিংস-বৌদ্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে মনে করাচ্ছে? পিঙ্গলক সিংহের হঠাৎ করে বৃষ-সঞ্জীবকের সংস্পর্শে এসে পরাক্রম ভুলে দয়া-করুণা প্রভৃতি সাধুজনের মতো আচরণ করাটা যে রাজকার্যের ক্ষেত্রে কতটা বিপজ্জনক, পঞ্চতন্ত্রকার প্রচ্ছন্নভাবে রাজার ছেলেদের হয়তো সেইটাই বোঝাতে চেয়েছেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক রাজা যদি সহসা অহিংস বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে রাজ্যজয়ের ইচ্ছা ভুলে ক্ষমাধর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন তাহলে যে রাজ্যপাট থাকবে না। এইটাই হয়তো শিশু রাজপুত্রদের মনের মধ্যে ঢোকাতে চেয়েছেন পঞ্চতন্ত্রকার।

ব্যাপারটা সে আমলের প্রেক্ষিতে বিচার করলে আপনার বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না। পঞ্চতন্ত্র যে আমলে রচিত, মানে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক থেকে খ্রিষ্টিয় ২য় শতক, সে সময়টাতে ভারতভূমিতে বৌদ্ধধর্ম যথেষ্ট পরিমাণে রাজা-পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের ফলস্বরূপ ব্রাহ্মণ্যধর্মের মাহাত্ম্য সে সময় বেশ কিছুটা ম্লান হয়ে যায়, যা পুনরায় গুপ্ত আমলে গিয়ে রাজধর্মের মর্যাদা পায়। তাই যে সময়ে পঞ্চতন্ত্র রচিত হয়েছিল, সে সময়ে অহিংস-বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল সমাজে প্রবল। উত্সাহী পাঠক-পাঠিকাদের অনুরোধ করবো এই সময়ের সামাজিক ইতিহাসটা একটু অনুসন্ধান করে দেখলেই আপনি যথার্থ একটি চিত্রটি পেয়ে যাবেন।

আসলে পরাক্রম ভুলে ক্ষমাশীল এবং অহিংস হয়ে গেলে, সিংহ রাজাকেও যে তাঁর অনুচরেরা ছেড়ে চলে যায়, এই তত্ত্বটাই পঞ্চতন্ত্রকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন শিশুমনে। রাজাকে পরাক্রমীই হতে হয়, বিজিগীষু হতে হয়, রাজকার্য ভুলে রাজা যদি অহিংস হয়ে ধর্মের বাণী প্রচার করে ঘুরে বেড়ান তবে তাঁর রাজ্যপাট আর কিছুই থাকে না।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content