সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


স্কেচ: লেখক।

আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস আর ইন্টারন্যাশনাল ম্যাঁও ডে-র দূরত্ব কত? বড়জোর দু’দিন মাত্র। আগস্টের প্রথম রবিবারে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা জানুন, কদিন পরেই বন্ধু খুঁজে পান, ম্যাঁও বলে রুমাল নাড়ুন। বেড়ালের তালব্য-শ আর হযবরল নিয়ে একটা ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস আঁকলে দেখা যাবে রুমালটা কখন বদলে গিয়ে “দিব্যি মোটা সোটা লাল টক্‌টকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্‌ প্যাট্‌ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে”। আগস্টের ছয় আর নয় তারিখ যে নয়ছয়-টা হয়েছিল তা জগতের ইতিহাসে জানা যায়। তারপরে জাপানের সমুদ্রে অনেক সুনামি এসেছে, তা বলে “আমরা কি বন্ধু হতে পারি না?”

এখানে চাট্টি কথা আছে। আদা আর কাঁচকলায়, সাপে আর নেউলে, ওলে আর তেঁতুলে, শিবাজি আর আফজল খাঁয়ে, আমে আর আমড়ায় যেরকম সখ্যতা তেমন বন্ধুত্ব আর উদবিড়াল, বনবিড়াল, মেছোবিড়াল, গেছোবিড়ালরা কি এই দুটো দিনে এনটাইটেলড? ‘ক্যাটালগ’ দেখতে হবে। যাকগে! বঙ্কিমবাবুর ‘বিড়াল’ সোজাসুজি বাঁকা কথা বলেছিল। চেয়ে না পেলে ‘কাড়িয়া লইয়া” খাবে বলে বেশ ইয়ে করেছিল। তো এই বিড়াল-ই আমাদের পুষি ক্যাট। কবি বলেছেন, “পুষি বেড়াল খুশি বেড়াল তুমিও পোষো আমিও পুষি”…
এই মার্জারগণ মনের যতো খাদ আর ফাটল মার্জ আর হিল করতে পটু। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় দু’পায়ে হেঁটে, ফ্রক থেকে স্যুট, বারমুডা থেকে কিমোনো পরে হৃদয় চুরি করছে। হ্যাঁ, এদের জাতীয় বৃত্তি হল না বলে নেওয়া। সে মন থেকে দুধ, মাছ থেকে শাক, সবটাতেই এরা সাবলীল। মাছ নিয়ে ধরা পড়লে চটপট শাক দিয়ে ঢেকে এরা বন্ধু হবে। দোষ থাকলেও দোস্তিতে এদের জুড়ি নেই। কবি আরও বলেছেন, “কুণ্ডুবাবুর গুণ্ডাবেড়াল করলে কারা চুরি, কলকাতাতে জন্মায়নি সেই বেড়ালের জুড়ি”… তো কবি তারপর কী লিখেছিলেন মনে নেই ধ্যাত্। যাকগে! ভাজা মাছ উল্টে খেতে না পারা বাঘের মাসিরা খুব শৌখিন। নরম বালিশ থেকে কোল, ভাজা থেকে ঝোল, অম্বল সব এদের থাবায়। ‘আমার বোনপোর বিশাল ক্ষ্যামতা’ বলে আপনার মনের দখল নিয়ে ‘বিল্লিসোনা’ হতে এদের সময় লাগে… জাস্ট সাড়ে তিন সেকেন্ড।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৮: হৃদয়ে আমার দিয়েছে ঢেউ, ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭০: অন্য বাইশে শ্রাবণ

তারপর বেড়াল তপস্বী, ব্যাটা চোর, ‘দূর হ লক্ষ্মীছাড়ি বেড়ালনী’ হয়ে ‘ব্রেকাপ’। ওতু হয়ে ওতপাত আর আরশোলা হৃদয় নিয়ে উত্পাতের খেলাটা বাদ দিলে মার্জার খুব মজার আসলে। মজন্তালী হয়ে মজাতে ওস্তাদ। ব্রেকাপ হলে ‘বোনপোকে বলে দেব’ বলেও যদি কাজ না হয়, তাহলে পায়ে পায়ে এসে, মনের বেড়া ডিঙিয়ে ‘মিনিবেড়াল’ হয়ে মনের ম্যাক্সিমাম জায়গায় জাঁকিয়ে বসে পড়তে… দেড় সেকেন্ড সাড়ে তিন ‘মিনি’সেকেন্ড। মিত্রভেদের পরে মিত্রলাভ। ক্যাটবেরি দিন। গলায় ঘন্টি বাঁধুন। ছি ছি বলে বেহায়া, ভিজে বেড়াল, ধান্ধাবাজ, জোচ্চোর বলবেন? কবি বলেছেন, ”যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু।” কবি আরও বলেছেন, “খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আআআআআআআআআআআমার মনের ভিতরে।” কবি নাকি এসব-ও বলেছেন যে, “বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছো ঈশ্বর?” কখনও সে অভিমানিনী রাধা, কখনও ”চুড়োবাঁধা এক মিনসে” কেষ্টা ব্যাটা।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১: ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দির এক অনন্যসাধারণ কোচ স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ

পরিযায়ী মন, পর্ব-১: পরিযায়ীর বিপর্যয়

লেজে খেলাতে বিলাত-ফেরত বিলাই ক্যাট থেকে তুলোর বল কিটেন একাই একশো। ইঁদুর, প্রজাপতি থেকে তার পোষা দুপেয়েগুলোকে “ভ্রূপল্লবে ডাক” দিতে বিল্লিসোনারা ওস্তাদ। আর ওস্তাদের মার শেষরাতে। তাই প্রথমরাতে বেড়াল মারা… শুধুই কথার কথা বটে।

জুতোর খোল থেকে বেডরোল, লেপ থেকে ল্যাপটপ, চেয়ারের আণ্ডার থেকে দশকর্ম ভাণ্ডার, পুজোপ্যাণ্ডেল থেকে ব্যাণ্ডেল, দিল্লির ক্যাবিনেট থেকে আপনার ওয়ার্ডরোব, মস্কো থেকে পণ্ডিচেরি অথবা ভোলগা থেকে গঙ্গা পর্যন্ত যার অবাধ যাতায়াত তাকেই উপনিষদ “পরমাত্মা” বলেছিলেন বোধহয়। আপনার যদি মনে হয় বিড়াল খুবই আত্মবাদী, আত্মকেন্দ্রিক, অহংকারী, তাহলে আপনি একদম ঠিক ভাবছেন। সাহেবরা কী বলেছেন দেখুন! সেলফিস। ফিস ছাড়া বিল্লির জীবনে আছেটা কী?

আপনার মনের সোনামনা মেরিলিন মনরো অথবা মোনালিসা হয়ে একটা কেমনতরো হেসে, ভালবেসে ইঁদুর ধরতে অথবা দিল্লির সিংহাসন বুঝে নিতে বিল্লিদের সময় লাগে… যাক বাদ দিন। কবি বলেছেন… যাইহোক, এটাও বাদ।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৭: প্রবাল প্রাচীর আমাদের ভবিষ্যতের ওষুধের ভাণ্ডার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮: সুন্দরবনের নিশ্চিহ্ন প্রাণী

তবে হ্যাঁ, কবি বলেছিলেন বটে “ত্বমসি মম জীবনং, ত্বমসি মম ভূষণং/ ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম।।” এমন বন্ধু আর কে আছে? শুধু রাস্তাটা মানুষের মতো চলতে জানলেই জমতো। তার বদলে কেবল সাঁত্ করে এপার-ওপার, এমন করলে দোস্তি থেকে কুস্তিতে পৌঁছতে সময় লাগবে… জ্যামজট না থাকলে… চোখের নিমেষেই। সে যাই হোক, বেড়াল বড়ো অভিমানী, এতটাই যে, কাঁঠালের আঠার মতো লেগে থাকে পায়ে পায়ে। ক্যাটক্যাট করে কথা শোনান, তবুও সে মিউমিউ করে বলবে “দেখ, আমি চোর বটে, কিন্তু আমি কি সাধ করিয়া চোর হইয়াছি? খাইতে পাইলে কে চোর হয়? দেখ, যাঁহারা বড় বড় সাধু, চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাহারা অনেকে চোরের অপেক্ষাও অধার্ম্মিক। তাঁহাদের চুরি করিবার প্রয়োজন নাই বলিয়াই চুরি করেন না। কিন্তু তাঁহাদের প্রয়োজনাতীত ধন থাকিতেও চোরের প্রতি যে মুখ তুলিয়া চাহেন না, ইহাতেই চোরে চুরি করে।” অতএব, বন্ধু চল! আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতের আঙুল ধরো। লেজে পা না পড়লে কাশী ছেড়ে মাছে-ভাতে “তোর টিমে তোর পাশে” এরা আছে সর্বদাই।

আসলে, বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না, আর সেই আনন্দে চুপচাপ চারিদিকে ঝোপঝাড়গুলো/ আয় ভাই গান গাই আয় ভাই হুলো”…
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content