রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

এ বার বরকনের বিদায়ের সময় এসে গেল। বৈশাখের খর রোদের তাপ পড়তে না পড়তেই পতিগৃহে যাওয়ার আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আদরের নয়নের মণি সারদাকে বিদায় জানাতে শ্যামাসুন্দরী আর রামচন্দ্রের বুক ভেঙে যাচ্ছিল। অশ্রুসজল চোখে মা তাঁর মেয়েকে যতটুকু পারা যায় অলঙ্কারে সাজিয়ে দিলেন। সব শেষে কনকাঞ্জলির পর চোখের জলে ভেসে বিদায় জানালেন তাঁরা মেয়ে আর জামাইকে। আত্মীয় স্বজন, গ্রামবাসিরা সকলেই আজ অশ্রু ভারাক্রান্ত। কিন্তু ছোট সারদার চোখে জল নেই, সে যে সকলের মা।

এখান থেকে কামারপুকুর বেশি দূরের পথ নয়। তাহলেও সন্ধ্যা নামার আগেই সকলে বরপক্ষকে নির্দিষ্ট সময়ে রওনা করিয়ে দিলেন। বিদায়কালে শ্বশুরমশাইয়ের হাত ধরে ঠাকুর সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, ‘আপনারা কষ্ট পাচ্ছেন কেন? দেড়-দু’ মাইল হেঁটে জায়গা পালটালেই কিছুই যায় আসে না। মন যেখানে থাকে, সেখানেই তো সব’। এই একটা কথার স্পর্শে সকল বিয়োগ-ব্যথা যেন নিমেষে দূর হয়ে গেল। রামচন্দ্র জামাইয়ের মনের গভীরতায় সব দুঃখ ভুলে তাঁদের আনন্দের সঙ্গে বিদায় জানালেন।
যথাকালে বরবধূকে নিয়ে ঠাকুরের মেজদা রামেশ্বর কামারপুকুরে ফিরে এলেন। মা চন্দ্রমণি টুকঠুকে বউমা পেয়ে খুবই খুশি। বিদ্যারূপিণী নববধূর মুখ দেখে মনে স্বস্তি পেলেন। তাঁর আশা, ‘গদাই এ বার সংসারী হবে’। বরবধূকে দেখার জন্য প্রতিবেশি এবং আত্মীয় পরিজনের সমাগমে আজ সম্পূর্ণ কামারপুকুর আনন্দমুখর হয়ে উঠল। মা পরে তাঁর ভক্তদের কাছে স্মৃতিচারণ করেছিলেন, ‘সুজ্যুর বাপ কোলে করে আমাকে কামারপুকুর নিয়ে গিয়েছিল’।

এই সুজ্যু হলেন সারদা মায়ের খুড়তুতো ভাই সূর্যনারায়ণ। তাঁর বাবা মায়ের সেজকাকা ঈশ্বর মুখুজ্যে। জমিদার ধর্মদাস লাহা বধূ দেখে বললেন, ‘এই মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে’? মা চন্দ্রমণি সানন্দে বধূবরণ করে ঘরে তুললেন। প্রীতিভোজের দিন বউকে সাজানোর জন্য লাহাবাবুদের কাছ থেকে কিছু গয়না চেয়ে এনে বউমাকে সাজালেন। শুভ কাজ যথাযথ ভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর এ বার গয়না ফেরত দেবার পালা। কিন্তু কন্যাসম বালিকা বধূর অঙ্গ থেকে কোন প্রাণে মা চন্দ্রমণি সেগুলি খোলেন। তিনি তো গয়না পরানোর সময় বালিকার খুশি মুখখানি দেখেছিলেন। সে অঙ্গ থেকে আর গয়না খুলতেই চায় না। গয়না পরেই সারদা ঘুমিয়ে পড়লেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৯: গাধা পিটিয়ে ঘোড়া

এ দিকে দু’ দিনের জন্য গয়নাগুলো চেয়ে আনা হয়েছে, চন্দ্রমণি ভেবে পান না কী করবেন। শেষে মায়ের মনের কষ্ট হৃদয়ঙ্গম করতে মাতৃভক্ত পুত্রের দেরি হল না। মাকে আশ্বস্ত করে ঠাকুর বললেন, সেই কাজ তিনিই করে দেবেন। রাত্রে ঠাকুর নিজেই ঘুমে-কাদা সারদার অঙ্গ থেকে গয়নাগুলো এক এক করে খুলে ফেললেন। কিন্তু বিপদ ঘটল সকাল হতেই। ঘুম থেকে উঠে গায়ে গয়না নেই দেখে কান্না জুড়ে দিল বালিকা বধূটি। তাঁকে কোলে বসিয়ে চোখের জলে সান্ত্বনা দিয়ে চন্দ্রমণি বললেন— মা, গদাই তোমাকে এর চেয়েও ভালো ভালো গয়না পরে কত গড়িয়ে দেবে।

সারদার ছোটকাকা নীলমাধব এসেছেন মেয়ে কেমন আছে দেখতে। তিনিও কান্না থামাতে পারেন না। গয়না খুলে নেওয়ার কথা জানতে পেরে তিনি রেগে গিয়ে সেদিনই মেয়েকে নিয়ে জয়রামবাটি চলে যান। আকস্মিক এই ঘটনায় ঠাকুরের পরিবারে সকলেই বিচলিত ও দুঃখিত হয়ে পড়ে। ঠাকুর এতে একটুও বিচলিত না হয়ে হেসে বলেন, ওরা যাই বলুক আর করুক না, যাবে কোথায়? বিয়ে তো আর ফিরবে না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৭: স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ‘সাগরিকা’

কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৪: রাজ পরিবারের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক ও ব্রাহ্মবাদ

মায়ের আগ্রহে ঠাকুর বিয়ের পর দু’বছরের বেশি কামারপুকুরে ছিলেন। এরপর ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে একবছর পর ভাগনে হৃদয়কে নিয়ে ফিরে আসেন ও তাকে নিয়ে দ্বিতীয় বার শ্বশুরালয়ে যান। সারদার তখন সাত বছর বয়স। কী আশ্চর্য! কেউ তাঁকে শিখিয়ে দেয়নি, বালিকা সারদাই সেদিন জল এনে স্বামীর পা ধূয়ে দেন। পাখা এনে বাতাস করেন।

এ ভাবেই সারদা মায়ের স্বামীসেবার সূচনা হল। ভাগনে হৃদয়কে দেখে সারদা বাড়ির নিভৃত কোণে লুকিয়ে পড়েন। কোথা থেকে হৃদয় তাঁকে খুঁজে বার করে অনেকগুলো পদ্মফুল এনে তাঁর পাদপূজা করে। লজ্জায় ও ভয়ে সারদা তখন সংকুচিত হয়ে গিয়েছিলেন। কয়েক দিন সেখানে থেকে ঠাকুর পত্নীর সঙ্গে জোড়ে কামারপুকুর ফিরে আসেন। এর অল্পদিন পরেই ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে চলে যান। সেখানে গিয়ে আবার সাধনায় ডুবে সংসারের কথা ভুলে যান।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৬: কাউকে অপদস্ত করতে হলে তাঁকে নারীঘটিত বিষয়ে জড়িয়ে দিতে হয়

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৮: হৃদয়ে আমার দিয়েছে ঢেউ, ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ

এ দিকে সারদা পিতার গৃহে ফিরে এসে খোলা প্রকৃতির কোলে বড় হতে লাগলেন। তারপর তের বছর বয়সে সারদা একবার কামারপুকুর আসেন এবং মাসখানেক থাকেন। তাঁর স্বামী তখন দক্ষিণেশ্বরে। পাঁচ-ছ’মাস বাদে কিসের যেন টানে তিনি আবার যান শ্বশুরগৃহে। ঠাকুর তখনও দক্ষিণেশ্বরে। সেবার তিনি দেড় মাস এখানে থাকেন।

এই সময়ের একটি ঘটনার কথা মা সারদা যখন পরবর্তীকালে কোয়াল পাড়ায় ছিলেন, তখন দুজন ভক্ত সাধুকে বলেছিলেন। ১৩২২ সালে ভাদ্রমাসে একদিন আরতির পর দু’ জন সাধু তাঁকে প্রণাম করতে বাড়ির ভিতরে যান। মা সারদা তখন উঠোনে বসেছিলেন আর কথাচ্ছলে তাঁদের বলেছিলেন, ‘আমার তের বছর বয়সের সময় কামারপুকুরে গিয়েছিলুম। হালদার পুকুরে নাইতে যাব, ভয় হত। খিড়কির ছোট দরজাটি দিয়ে বেরিয়ে ভাবচি, নতুন বৌ, কী করে একলা নাইতে যাই। ভাবতে ভাবতে দেখি কী, আটটি মেয়েমানুষ এল। আমিও রাস্তায় নামলুম। নামবার পরেই তারা চারজন আমার আগে, চারজন আমার পিছনে হয়ে, আমাকে মাঝে নিয়ে হালদার পুকুরের ঘাটে চলল। আমি স্নান কললুম, তারাও কললে। পরে আবার সেরকম করে বাড়ি ফিরে এল। ওই সময়টায় আমি যতদিন ওখানে ছিলুম, রোজ এইরকম হতো। অনেকদিন মনে করেছি, মেয়েগুলি কারা, আমার স্নানের সময় রোজই আসে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারিনি’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content