রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। মুম্বই চাল। সংগৃহীত।

।। সিনেমায় নামা বা মঞ্চে ওঠা।।

দাদুর বাড়িতে কোনও অনাদরে ছিল না বাবলি। কিন্তু তার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা ছিল। বাবা মারা গিয়েছেন। দাদু যতদিন আছেন তার মধ্যে একটা ভালো বিয়েটা হয়ে গেলে ঠিক আছে। না হলে তারপর কী হবে এই দুশ্চিন্তা বাবলির মায়ের ছিল। তাই বিয়ের সম্বন্ধটা সুজাতার ছেলে প্রণয়কান্তির সঙ্গে এবং বসুন্ধরা ভিলায় শুনে আর দ্বিতীয়বার ভাবেননি। বাবলি প্রনয়কান্তের স্ত্রী হয়ে বসুন্ধরা ভিলায় দ্বিতীয়বার পা রাখল। তারপরে বাবলির জীবনে ছন্দপতন কীভাবে ঘটল সেটা আবার পরে জানা যাবে।

কিন্তু চুঁচুড়ার শিবানী সেনের জীবনের তারপরের গল্পটা সিনেমার মতো পরপর ঘটে যাওয়া যাকে সিনেমা বোদ্ধারা মন্তাজ বলেন। তবে জীবনের গ্রাফটা শুধুই উত্তরণ নয়, উত্তরণ আরও উত্তরণ তারপর অবতরণ। তারপর আবার উত্তরণ অবতরণ হয়ে প্রায় সরলরেখায় জীবন যুদ্ধে চলতে থাকা।

নেতাজিনগরের সেই চিলতে ঘর থেকে রিজেন্ট পার্কের ছোট্ট দু-কামরার ফ্ল্যাটে উঠে গেল শিবানী আর তার দুঃসম্পর্কের বয়স্কাপিসি। কিছুদিন বাদে শিবানী পিসিমাকে বলল, শুটিংয়ের কাজে তাকে এ বার বম্বেতে গিয়ে থাকতে হবে প্রায় মাস চার-পাঁচ। বম্বেতে থাকা খাওয়ার খরচা অনেক বেশি, যা রোজগার হবে তাতে কলকাতা বোম্বে দু’ জায়গার বাড়িভাড়া ঘরখরচা সেটা টানতে পারবে না। পিসিমা বয়স্কা সংসারে দেনা পাওনায় যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তাই বাকি কথাগুলো আর বলতে হয়নি। নিজের একটা ব্যাগ নিয়ে ফিরে গেলেন। পিসিমা চলে যাওয়া আর বম্বে যাওয়ার আগের সময়টা তিনচার মাস। উইকেন্ডে সিংহানিয়ার দামি গাড়ি শিবানীকে তুলে নিয়ে যেত।

হোটেলে বা কোনও বাগান বাড়িতে সময় কাটিয়ে আবার কলকাতা। অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে খোঁজ নিলে বলতো বম্বের শুটিংয়ের ব্যাপারে রিহার্সাল হয়। তারপর যাহোক বোম্বে যাওয়া হল। বম্বে মেলে ভিটি স্টেশনে পৌঁছবার পর আসল ধাক্কা এল। হাতে একটা ঠিকানা আছে। ব্যাস। স্টেশন থেকে মাস্টারজিকে ফোন করেছিল। অফিসের ফোন নম্বর। তিন তিনবার চেষ্টার পর যে ফোন তুলল সে বলল মাস্টারজি শুটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। তাকে যে ঠিকানা দেওয়া আছে সেখানে গিয়ে আসলাম বলে একজনকে খুঁজে নিতে। সে ঘর দেখিয়ে দেবে। মাস্টারজি তাকে বেটি বেটি বলে সম্বোধন করতেন ভেবেছিল তিনি নিজে আসবেন বা কাউকে পাঠাবেন ভিটি স্টেশন থেকে তাকে নিয়ে যেতে। খুব বেশি আশা করে ফেলেছিল। মায়ানগরী মুম্বই (তখন অবশ্য বোম্বাই) আসল রূঢ় কঠিন চেহারাটা একটু একটু করে স্পষ্ট হতে লাগলো।

বম্বেতে তাকে ভারসোভা এলাকায় থাকার জায়গা দেওয়া হয়েছিল। বম্বেতে এই একটা মস্ত অসুবিধে। জায়গার নাম শুনলে ঝাঁ চকচকে বলে মনে হয়। সমুদ্রের ধারের মেনরোড দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে যা পড়ে সেগুলোও সাজানোগোছানো ঝকঝকে। কিন্তু সেখানে মধ্যবিত্ত কারও পক্ষে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। ইয়ারি রোড শুনলেও বেশ ভালো লাগে। সিনেমার পত্র-পত্রিকায় ভিড় করা অনেক নামজাদা চিত্রতারকার ঝকমকে বাড়িঘর এসব অঞ্চলে। শিবানীর থাকার জায়গা ছিল সমুদ্রের ধারের ঝকঝকে ভারসোভা রোড থেকে ইয়ারি রোড-আরামনগর লেন হয়ে গলি তস্য গলিতে একটা টানা-বারান্দার সার সার এক কামরার ঘরের একটা। বম্বেতে যাকে চাল বলে।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-২৭: উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নাম, টাকা, গ্ল্যামারের নেশায় নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করল শিবানী

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৯: যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু

চুঁচুড়ার বাড়ি থেকে নেতাজি নগরের এক কামরার ছোট ঘর। সেখান থেকে ছবির দৌলতে সদর স্ট্রিটের হোটেলে তোফা ব্যবস্থা।সেখান থেকে ফেরার পরে রিজেন্ট পার্কের দু’ কামরার ফ্ল্যাট। বম্বের রুপোলি হাতছানি। অনেক স্বপ্ন নিয়ে সেখানে পৌঁছে নোংরা ঘিঞ্জি চাল। আসলাম বলে ছেলেটা রাস্তার একটা দোকানে দাঁড়িয়ে শিবানীকে খেয়ে নিতে বলেছিল। প্রথম দিন খাবার জোগাড় করতে অসুবিধা হতে পারে। গোল পাউরুটির মধ্যে সবুজ রঙের সস মাখিয়ে আলুর বড়া ভেঙে দেওয়া। বম্বের বিখ্যাত ‘বড়াপাও’ আর চায়ের গ্লাসের অর্ধেক চা, যার নাম কাটিং চায়ে।

রাত্তির বেলাতেও সেরকম দুটো বড়াপাও খবরের কাগজে মুড়ে বাড়িতে থুড়ি থাকার কামরায় নিয়ে গিয়েছিল। তেলের ছোপ-লাগা খবরের কাগজ উলটেপালটে পাঠোদ্ধার করতে পারেনি। মারাঠি ভাষার কাগজ। পাশের চা-ওলা একটা চ্যাপ্টা বোতল গরমজলে ধুয়ে তাতে চা দিয়েছিল। বোতল দেখে শিবানী চিনতে পেরেছিল। উইকেন্ডে সিংহানিয়ার সঙ্গে যাবার সময় এই ধরনের বোতল তারা নিয়ে গিয়েছে। সিঙ্গানিয়াকে খুশি করতে এক দুবার গলায় জিভে জ্বালা ধরানো হোমিওপ্যাথিক ওষুধের গন্ধওলা তরলে চুমুক দিতে হয়েছে। তবে কি আশ্চর্য! যে মদ খেয়ে পুরুষ মানুষ লটর পটর করে সেটা এক দু’ গ্লাস খেয়ে ফেলেও শিবানীর কক্ষনো এতোটুকু মাথাও ঘোরেনি। নেশা কি আদতে হয়? নাকি মানুষ আসলে নেশা হওয়ায় আসক্ত, বেলাগাম হতে চায়!
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৬: ঈল মাছের এই রহস্য নিশ্চয়ই একদিন উদঘাটন হবে

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৮: ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম এবং ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস

গোরেগাঁও ইস্টে আরে মিল্ককলোনিতে বিখ্যাত ফিল্মসিটি স্টুডিয়ো। সেখানেই মাস্টারজির অফিস। প্রথমদিন বলে মাস্টারজি ট্যাক্সি নিতে বলেছিলেন। বোম্বে আসতে হবে বলেই সিংহানিয়ার কাছে হিন্দির তালিম নিয়েছিল শিবানী। কাজ চালানো হিন্দি বলতে পারে। তখনও বম্বে। রাস্তার নাম দোকানের সাইনবোর্ড বাসের নম্বর গন্তব্য ইংরিজিতে। ১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসে শিবসেনা সরকারের দাবি মেনে বম্বে ‘মুম্বই’ হয়ে গেল। পালটে গেল শহরের কসমোপলিটন চরিত্র। শিবানী বম্বের বেবিট্যাক্সি নিয়ে ফিল্মসিটি যাচ্ছিল। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জায়গার নাম জানতে জানতে যাচ্ছিল। তার থাকার জায়গা- জানাশোনা তো নিশ্চয়ই দরকার। ইংরেজিতে কিছু কিছু রাস্তার নাম, দোকানের সাইনবোর্ড আর ট্যাক্সি ড্রাইভারের বিবরণী আন্ধেরি ওয়েস্ট, যোগেশ্বরী ওয়েস্ট, গোরেগাঁও ওয়েস্ট ট্রেন লাইন টপকে গোরেগাঁও ইস্ট।

— ইয়ে ইস্ট ওয়েস্ট কেয়া হোতা হ্যায় ভাইসাব?

— সিম্পল হ্যায়। ট্রেন তো বম্বে কা লাইফ লাইন হ্যায় না। স্টেশন কি ওয়েস্ট বাজুমে সমুন্দার হ্যায়, জো স্টেশন হ্যায় ওহিচ জায়গা কা নাম হ্যায়। আন্ধেরি ওয়েস্ট, যোগেশ্বরী ওয়েস্ট, গোরেগাঁও ওয়েস্ট। স্টেশন কি ইস্ট বাজু বোলে তো আন্ধেরি ইস্ট যোগেশ্বরী ইস্ট, গোরেগাঁও ইস্ট। সিম্পল হ্যায়। জাদা দিমাক মচমচ করনেকা নাই!

ফিল্মসিটি স্টুডিয়োতে গিয়ে মাস্টারজির নাম বলায় ছেড়ে দিল। বিশাল জায়গা। কয়েকটা ইন্দ্রপুরী টেকনিসিয়ান এনটি ওয়ান ঢুকে যাবে। শিবানীর গায়ে শিহরণ দিচ্ছে। মেরা গাঁও মেরা দেশ, হাতি মেরে সাথী, আন্দাজ, কটি পতঙ্গ, ক্যারাভ্যান, মেরে আপনে, আনন্দ কত কত ছবি না জানি এখানে হয়েছে। দেবানন্দ, ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্না, শশী কাপুর, শাম্মি কাপুর, রাজ কাপুর, জিতেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন, মালা সিনহা, তনুজা, আশা পারেখ, মুমতাজ, হেমা মালিনী, জয়া ভাদুড়ি কত কত স্টারেরা না জানি ঘোরে ফেরে এখানে। শিবানী তখন জানত না যে বোম্বেতে ফিল্ম সিটি ছাড়াও আরও অন্তত সাত-আটখানা নামী স্টুডিয়ো রয়েছে।

মাস্টারজির সঙ্গে দেখা হল। প্রথমেই তিনি শুনিয়ে দিলেন আপ্ত বাক্য।

— দেখো বম্বইচ মে খানে রহনে কা কোই লাফডা নেহি হোগি। অপনে অপনে তকদির কে হিসাব সে সব বরাব্বর মিলেগি। হ্যাঁ, বিচ বিচ মে ওয়হ আপকি ধিরজ কি কড়ক জাঁচ করতি হ্যায়। বস ওয়হিচ আপকো সামহালনা হোগা।
আরও পড়ুন:

অজানার সন্ধানে: এই ভূতুড়ে দ্বীপে তিনিই একমাত্র মহিলা, দিন কাটে দাগি অপরাধীদের সঙ্গে, ‘দ্বীপের রানি’র কেন এমন সিদ্ধান্ত?

দশভুজা: রোজ একশোরও বেশি বাচ্চা তাদের দাদির হাতের রান্না খেয়ে যায়

শিবানী বুঝতে পারে তার বাংলা তর্জমা। বম্বেতে তোমার খাওয়া থাকার ঝঞ্ঝাট নেই। যে যার ভাগ্যের পাওনা অনুযায়ী সব পেয়ে যাবে। তবে মাঝেমধ্যে এ শহর তোমার ধৈর্যের, তোমার সহ্যক্ষমতার পরীক্ষা নেবে। সেটা তোমায় সামলাতে হবে।

সেই থেকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে চলেছে শিবানী। এর মাঝে কয়েকটা বছর কেটে গিয়েছে। অনেকটা বদলে গিয়েছে শিবানী। ঠকতে ঠকতে ধাক্কা খেতে খেতে একা একা লড়াই করতে শিখেছে। লোককে ঠকাতে শিখেছে। চুঁচুড়ার সঙ্গে সেরকম আর যোগাযোগ নেই। মাঝেমধ্যে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। বনানী বিএ পাশ করে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে ডাক পেয়ে বিডিও অফিসে চাকরি পেয়েছে। চাকরি করতে করতেই প্রাইভেটে এমএ পরীক্ষা পাস করেছে। বনানীর ইচ্ছে স্কুল টিচার হবার। তাই একটা বিএড ট্রেনিং এর চেষ্টা করছে।

মা বলেছিল বড় মেয়ে শিবানীর বিয়ে না দিয়ে তিনি ছোট মেয়ের বিয়ে দেবেন না। শিবানী জানিয়ে দিয়েছে, সে এখনই বিয়ে-থা কিছু করবে না। বম্বেতে এখনও এমন বেশি কিছু করে উঠতে পারেনি, যাতে মা-বাবাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে পারে। নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াইটুকু সে করতে পারছে বম্বেতে। বনানী এখন তাদের সংসারে সন্তানের দায়িত্ব পালন করছে। তবে ওর বিয়ের জন্য বেশি অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।—চলবে।

চিত্র সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-২৯

আমরা কেজি থেকে বন্ধু প্রায় পিজি পর্যন্ত। প্রায় বলছি এই কারণে যে, থার্ড ইয়ারের পর আমার আর অর্কর প্রেম হবার কথা শুনে দিগন্ত নিজেকে আমাদের জীবন থেকে সরিয়ে নিল। ভালোই করেছিল, প্রেমিক বর হল। সেই তখন প্রায়োরিটি, সেই তখন প্রেফারেন্স। সেই বা কেন প্রেমিকার কেজি ফ্রেন্ডশিপকে পাত্তা দেবে। আমার ড্যায়াগনোস করতে ভুল হয়েছিল। ম্যারেজ এক্সপায়ার্ড। ।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content