শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ভক্তিমূলক নাটক রচনায় গিরিশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার উপরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ ধন্য তিনি। সেই কারণে তিনি একটি অসাধারণ ভক্তি ও জ্ঞানমূলক নাটক রচনা করলেন। সে নাটকের নাম ‘করমেতি বাঈ’। এই নাটকটি প্রথম অভিনীত হল ১৮৯৫ সালের ১৮ মে মিনার্ভা থিয়েটারে। প্রথম অভিনয় রজনীতে যেসব শিল্পীর অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শ্রীমতি কুসুমকুমারী (শ্রীকৃষ্ণ), সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (দানি বাবু বলে যিনি পরিচিত, অলক এর চরিত্রে ),হরি ভূষণ ভট্টাচার্য (আগম বাগিস), অক্ষয় কুমার চক্রবর্তী (টুকরো), নীলমণি ঘোষ (দেমো), তিনকড়ি দাসী (করমেতি বাঈ)।
গিরিশচন্দ্র এই নাটকের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন ‘ভক্তমাল’ গ্রন্থ থেকে। গিরিশচন্দ্র তাঁর অসামান্য প্রতিভা বলে এই ভক্তিরসাত্মক উপাখ্যান অবলম্বন করে একদিকে সরস ভক্তি তত্ত্ব এবং অন্যদিকে কঠোর বৈদান্তিক তত্ত্বের সংঘাতে একটি অত্যন্ত সুন্দর হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী নাটক সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। গিরিশচন্দ্রের রচনাগুণে সবকটি চরিত্রই পরিস্ফুটিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৪০: গিরিশচন্দ্রের অন্যতম সেরা গীতিনাট্য ‘স্বপ্নের ফুল’

দশভুজা: রোজ একশোরও বেশি বাচ্চা তাদের দাদির হাতের রান্না খেয়ে যায়

তবে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সে ক্ষেত্রে সর্বদাই যে সাফল্যমন্ডিত হয়েছিলেন, এমনটি বলার উপায় এই নাটকে কেন্দ্র করে হয়নি। যে উদীয়মান অভিনেতার চন্ড, ম্যাকবেথ ও মুকুল মুঞ্জরা নাটকে রঘুদেবজি, ম্যাকবেথ ও মুকুলের ভূমিকাভিনয়ে নাট্য প্রতিভার বীজ এবং জনায় প্রবীরের ভূমিকায় অঙ্কুর দেখা দিয়েছিল বর্তমান এই নাটকে আলোকের ভূমিকাভিনয়ে সেই প্রতিভাধর শিল্পীকে আমরা পেলাম। তিনি হচ্ছেন সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, গিরিশচন্দ্র ঘোষের পুত্র (দানি বাবু নামে যাঁর পরিচিতি) এই ভূমিকায় প্রাণস্পর্শী অভিনয়ে দর্শকদের পরম প্রীতিভাজন হয়েছিলেন। আগমবাগিস, টুকরো, ডেমো ও অম্বিকার অভিনয় রঙ্গমঞ্চ প্রবল হাস্যরসে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৩: কোন কাননের ফুল ‘শ্যামলী’

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ

তবু এই নাটকটি যে তেমনভাবে মঞ্চ সাফল্য পায়নি তার দুটি কারণ পরবর্তীকালে সমালোচকরা আবিষ্কার করেছেন। যার প্রথমটি হল যে, নামভূমিকার চরিত্রে তিনকড়ি দাসী অভিনয় করেছিলেন তাঁর অভিনয়ে ভক্তিরসের পূর্ণবিকাশ হয়নি। এই তিনকড়ি দাসী কিন্তু লেডি ম্যাকবেথ ও জনার ভূমিকায় আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এখানে তাঁর প্রতিভার ঠিক পূর্ণ অভিব্যক্তি দর্শকেরা পাননি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত

লেডি ম্যাকবেথ ভূমিকা কঠোর বাস্তবের চিত্র, জনার মাতৃ চরিত্র বাস্তবের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এখানে প্রথম থেকেই একটি স্বপ্নাচ্ছন্ন ভাব এবং সেই স্বপ্ন যেখানে বাস্তবে পরিণত হয়েছে সেখানে কল্পনার চরম বিকাশ। এমন চরিত্রের অভিনয় তিনকড়ি দাসীর ধাতুগত নয়। চেষ্টার অভাব না হলেও মূল অভিনেত্রীর এই প্রধান ত্রুটিতেই নাটকটি সাধারণের কাছে তৃপ্তিদায়ক হয়ে ওঠেনি।
দ্বিতীয় কারণটি হল উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে মীরাবাঈ প্রমুখের চরিত্র চিত্রে অভ্যস্ত কিন্তু বঙ্গদেশে সতীত্ব এবং স্বামী ভক্তির ধারণা ভিন্নরূপ। যে দেশে স্বামীকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবের থেকেও উঁচুতে স্হান দেওয়া হয়, সে দেশের স্বামীর বদলে শ্যামের প্রতি আকর্ষণ সাধারণের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়নি। ফলে এত সুন্দর নাটক মঞ্চ সাফল্য লাভে বঞ্চিত হয়েছে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content