শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


চাঁপা ফুলের গাছ। ছবি: সংগৃহীত।

সেই ছোট্ট বেলায় সাত ভাই চাঁপা আর এক বোন পারুলের গল্পকথা আমারা খুব শুনতে ভালোবাসতাম। আজ আমি পাঠকদের সেই সুগন্ধে মাতানো চাঁপার গল্প বলবো, তবে সেটা অন্য স্বাদের। ভারতের ইতিহাসে চাঁপা হল অতি পবিত্র একটি ফুলের গাছ। ভালোবাসার দেবতা শ্রীকৃষ্ণ এবং কামদেবের প্রিয় ফুল চাঁপা নাকি মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। সম্রাট তাঁর রচনায় বিভিন্ন রঙের চাঁপা ফুল এবং গাছের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম—এমনকি মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছেও এই গাছকে অমরত্বের প্রতিক হিসাবে মানা হয়। বৌদ্ধ এবং মুসলিম ধর্মের লোকেরা কবরের উপরে পবিত্র এই গাছকে রোপন করেন। অনেক সময় হিন্দুরা যখন কোনও পবিত্র দেহকে সমাধিস্থ করেন, তখন তার ওপরও চাঁপা গাছ রোপন করেন। এই গাছের একটি বৈশিষ্ট্য হল যে, গাছটিকে মাটি থেকে শিকড় সমেত তুলে ফেললেও সেই গাছ সহজে মারা যায় না। ওই গাছে ফুলও ফোঁটে। তাই অমরত্বের প্রতীক হিসেবে এই গাছ সকল ধর্মের কাছেই অত্যন্ত পবিত্র। অনেক মন্দির, মসজিদ এবং মনেস্ট্রির আশেপাশে চাঁপা গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এই গাছের ফুল দেবতার পুজোয় অর্পণ করা হয়।

পবিত্র এই গাছের নামকরণ নিয়েও একটি কাহিনি আছে। সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি বিজ্ঞানী চার্লস প্লুমিয়ার এবং চাঁপা গাছকে কেন্দ্র করে একটি গল্পকথা প্রচলিত আছে। বিজ্ঞানীর প্রতিবেশী এক গ্রামবাসী বিজ্ঞানীকে বলেন, তিনি কি এমন কোনও গাছের সন্ধান দিতে পারবেন, যা মন্দিরে এবং কবরস্থানে উভয় জায়গাতেই জন্মায় এবং যার পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল সাদা ফুল, তার আত্মহারা সুগন্ধ সকল প্রাণীকেই মুগ্ধ করবে। কথাটি শোনা মাত্রই বিজ্ঞানী সেই গাছের অন্বেষণে বিভিন্ন দেশ-বিদেশ ঘুরতে শুরু করলেন। অবশেষে পৌঁছলেন আমাদের এই ভারতে। এখানকার লোকজনের কাছে খবর পেয়ে তিনি মন্দিরে ভরা দাক্ষিণাত্যে এসে পৌঁছলেন।
দাক্ষিণাত্যের এক গ্রামবাসী বিজ্ঞানীর কৌতুহল মেটানোর জন্য একটি মন্দিরকে নির্দেশ করে বলেন যে, পূর্ণিমার মধ্যরাতে মন্দির চত্বরে অপেক্ষা করবেন। এক সময় একটি সুমিষ্ট গন্ধ ভেসে আসবে। সেই গন্ধকে অনুসন্ধান করতে করতে আপনি ওই গাছকে খুঁজে পাবেন। যদি ওই গাছকে আলিঙ্গন করে ঝাঁকাতে থাকেন তবে ওই গাছ থেকে স্বর্ণমুদ্রা ঝরতে থাকবে। ঠিক পূর্ণিমারাত্রে বিজ্ঞানী মন্দিরের উদ্যানে পৌঁছে গেলেন। স্থানীয় বাসিন্দার নির্দেশ মতো সেই গাছকে ঝাঁকাতেই প্রচুর সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত এবং পূর্ণ চাঁদের জোৎস্নায় স্বর্ণমুদ্রার মতো চকচকে ফুল ঝরে পড়ল তাঁর সারা শরীরে। পার্থিব স্বর্ণমুদ্রার চিন্তা ভুলে বিজ্ঞানীর শরীর ও মন এক অভূতপূর্ব স্বর্গীয় অনুভূতিতে পূর্ণ হল। তাই বিজ্ঞানী নিজের নাম অনুসারে এই গাছের নামকরণ করলেন প্লুমেরিয়া (Plumeria)‌।
 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: Plumeria sp.
● ফুলের ধরণ: এই গাছের লাল ফুল (Plumeria rubra) এবং সাদা (Plumeria alba) ফুল সহ প্রায় ত্রিশটি প্রজাতি আছে।
● বাংলা নাম: চাঁপা।
● ইংরেজি নাম: টেম্পেল ট্রি।
● সংস্কৃত নাম: কৃষ্ণচাঁপা।
● গোত্র: অ্যাপোসায়ানেসি (Apocynaceae)।
● গাছের প্রকৃতি: চাঁপা গাছ হল বহুবর্ষজীবী, দ্বিবীজপত্রী, মাঝারি উচ্চতাবিশিষ্ট বৃক্ষ জাতীয়, সপুষ্পক উদ্ভিদ। দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এই গাছ উচ্চতায় ৬ থেকে ১০ ফুট (২০”-২৫”) হয়ে থাকে। গাছের উপরের অংশে শাখাপ্রশাখাগুলি সজ্জিত থাকে। গাছের মূল কাণ্ডে সাদা বর্ণের তরুক্ষীর বা ল্যাটিক্স উপস্থিত থাকে। এই গাছের সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত ফুলগুলি হলুদ আভাযুক্ত সাদা ঘন্টাকৃতি হয়ে থাকে। ভারতীয় জলবায়ুতে এই গাছের ফুল ফোটার সময় হল মার্চ থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত।
● গাছের বিস্তৃতি: এই গাছের আদি উৎপত্তিস্থল উত্তর আমেরিকা। বর্তমানে এই গাছ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার হিমালয় পাদদেশের দেশগুলিতে লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ইত্যাদি রাজ্য-সহ পূর্ব ভারত, উত্তর ভারতেও এই গাছ পরিলক্ষিত হয়।

আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: সুস্থ থাকতে ভরসা থাকুক সপ্তপর্ণী বা ছাতিমে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪: শুভ পরিণয়বেলা

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

চাপা গাছের বলকলে বাছালে উপস্থিত থাকে এল্লামাইসিন (Allamicin), প্লুমেরিসিন (Plumericin); ফুল থেকে যে তেল পাওয়া যায় তাতে থাকে ৪৫ শতাংশ বেনজাইল স্যালিসাইলেট, ১৭ শতাংশ বেনজাইল বেনজোয়েট এবং স্টেরয়েড, অ্যালক্যালয়েড, গ্লাইকোসাইড, ট্যানিন, ফ্ল্যাভনয়েডস, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি যৌগ। এছাড়াও অন্য প্রজাতির চাপা ফুলের নির্যাসে পাওয়া যায় পামিটিক অ্যাসিড, লিনোলেইক অ্যাসিড, মেরিস্টিক অ্যাসিড। এই গাছের সবুজ পাতায় উপস্থিত থাকে টারপিনয়েডস, রেসিনিক অ্যাসিড, স্টেরল, প্লুমিরাইড।

আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৩০: কারণে-অকারণে পুরুষত্বের কাঠামো পরিবর্তন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩০: প্রচুর প্রোটিন, তাই যতখুশি ডাল খান?

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

 

ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ দূর করতে

আধুনিক মাইক্রোবায়োলজির যুগান্তকারী গবেষণায় জানা গিয়েছে, চাঁপা গাছ থেকে পাওয়া মিথাইল নির্যাস নানান ধরনের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি ব্যাকটেরিয়ার বিজ্ঞানসম্মত নাম দেওয়া হল—ব্যাসিলাস সাবটিলিস (Bacillus subtitles), স্টেফাইলোকক্কাস এরিয়াস (Staphylccoccus aureus), এসচেরিয়া কোলাই(E.Coli), সিউডোমোনাস (Psrudomonas sp.), মাইক্রোকক্কাস লুটিয়াস (Micrococcus luteus), সালমোনেলা টাইফিমিউরিয়াম (Salmonella typhimurium)।
 

ক্ষত ও কুষ্ঠ রোগ দূরীকরণে

সবুজ পাতায় উপস্থিত নানান ধরনের রাসায়নিক যৌগ (স্টেরল, টারপিনয়েড, প্লুমিরাইড, রেসিমিক অ্যাসিড) মানবদেহের ক্ষত এবং কুষ্ঠ রোগ সারাতে ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ

মেক্সিকোর অধিবাসীরা চাঁপা ফুলের নির্যাস থেকে ডায়াবেটিস রোগের ওষুধ তৈরি করেন। চাঁপা গাছে ফুলের মধ্যে প্রচুর স্টেরয়েড, অ্যালকালয়েডস, ফ্ল্যাভোনয়েড, ট্যানিন থাকে যা ডায়বেটিস রোগ উপশমের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা নেয়।

আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র: তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম…

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২৪: রাত্রির রং রহস্যময়

 

ক্যানসার ও টিউমার প্রতিরোধ

চাপা গাছের সাদা ফুলের নির্যাস থেকে যে মিথানল নিষ্কাশিত হয় তা অ্যান্টিটিউমারাস এবং অ্যান্টিক্যানসারাস এজেন্ট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
 

হারপিস নিরাময়

চাঁপা গাছের তরুক্ষীর অর্থাৎ ল্যা টেক্স থেকে যেসকল অ্যালকালয়েড পাওয়া যায় তা হারপিস ভাইরাস প্রতিরোধ করে।
 

কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণ

চাঁপা গাছের ছাল নিষ্কাশিত জৈব-রাসায়নিক পদার্থ কার্ডিওটনিক হিসাবে অর্থাৎ হার্টের অসুখ প্রতিশোধক হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
 

মূত্রনালিতে সংক্রমণ প্রতিরোধে

সিউডোমোনাস অরিজিনোসা নামক ব্যাকটেরিয়া রেচনতন্ত্রে সংক্রমণ সৃষ্টি করে। এই ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে চাপা গাছের মিথ্যা নির্যাস ব্যবহার করা হয়।
 

এডস প্রতিরোধে

বর্তমান বিজ্ঞানের যুগান্তকারী গবেষণার ফলে জানা গিয়েছে, চাঁপা গাছ থেকে নিষ্কাশিত নির্যাসে উপস্থিত থাকে ফলভোপ্লুমিরিন (Fulvoplumierin) নামক যৌগ। এটি আরএনএ ভাইরাস এইচআইভি-র (গ্রোথ) বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে পারে।

এছাড়াও, মিষ্টি গন্ধের জন্য চাঁপা গাছের ফুল থেকে নিষ্কাশিত নানান জৈব রাসায়নিক পদার্থ বর্তমানে আরোমাথ্যেরাপিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content