বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

আচার্য আপোদ ধৌম্যের তিনজন শিষ্যের একজন বেদ। শিষ্যের প্রতি গুরু ধৌম্যের আদেশানুসারে শিষ্য বেদ সেবাপরায়ণ হয়ে কিছুকাল গুরুগৃহে অবস্থান করলেন। সেখানে তাঁর অবস্থান ছিল ভারবাহী বলদের মতো। গুরুর আজ্ঞানুবর্তী হয়ে শীত, গ্রীষ্মের প্রতিকূলতা এবং ক্ষুধাতৃষ্ণা সহ্য করে গুরুর অবিরোধিতায় বাধ্যতাস্বীকারেই ছিল তাঁর গুরুর প্রতি আনুগত্যের নজির। গুরু আপোদ ধৌম্য শিষ্য বেদের এই আনুগত্য ও নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হলেন। সন্তুষ্ট ঋষি আশীর্বাদ করলেন শিষ্যকে, প্রার্থিত সাফল্য লাভ করো। এটি সেই কষ্টের পরীক্ষা।

তৎপরিতোষাচ্চ শ্রেয়ঃ সর্বজ্ঞতাং চাবাপ। এষা তস্যাপি পরীক্ষা বেদস্য

উপাধ্যায়ের অনুমতি নিয়ে গার্হস্থাশ্রমে প্রবেশ করে, সংসারী হলেন বেদ। এখন তিনি একজন গুরু। গুরু বেদের তিনটি শিষ্য। দু’জন ক্ষত্রিয় রাজপুত্র। একজন হস্তিনাপুরের রাজার পুত্র এবং অপরজন পৌষ্য রাজা। তৃতীয়জন ব্রাহ্মণকুমার। উতঙ্ক তাঁর নাম। গুরুগৃহবাসের নিদারুণ কষ্টকর অভিজ্ঞতা ভুলে যাননি ঋষি বেদ। তাই শিষ্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন তিনি। তিনি শিষ্যদের কখনও কোনও কাজ বা গুরুপরিচর্যার আদেশ দিতেন না। দুঃখাভিজ্ঞো হি গুরুকুলবাসস্য শিষ্যান্ পরিক্লেশেন যোজয়িতুং নেয়েষ।

শিষ্যদের কষ্ট দিতে চাইতেন না গুরু বেদ। একদা তিনি যাজনকর্মের উদ্দেশ্যে দেশান্তরে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে ঘরগৃহস্থালি দেখভালের দায়িত্ব দিলেন শিষ্য উতঙ্ককে। ভো উতঙ্ক! যৎকিঞ্চিদস্মদ্গৃহে পরিহীয়তে তদিচ্ছাম্যহমপরিহীয়মানং ভবতা ক্রিয়মাণমিতি। স এবং প্রতিসন্দিশ্যোতঙ্কং বেদঃ প্রবাসং জগাম। ওহে উতঙ্ক আমার গৃহের যা কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি সবকিছু সামলানোর দায় তোমার—এমন আদেশ দিয়ে গুরু বেদ প্রবাসে গেলেন।

ইতিমধ্যে আচার্য বেদের অনুপস্থিতিতে ঋতুমতী হলেন তাঁর স্ত্রী। প্রচলিত বিশ্বাস—ঋতুমতী হওয়ার পরেই গর্ভধারণের প্রশস্তকাল। তাই গুরুর আশ্রমস্থ অন্যান্য মহিলারা বললেন, উপাধ্যায়ানী তে ঋতুমতী, উপাধ্যায়শ্চ প্রোষিতঃ, অস্যা যথায়মৃতুর্বন্ধ্যো ন ভবতি, তথা ক্রিয়তাম্; এষা বিষীদতি, ইতি। আচার্যানী ঋতুমতী হয়েছেন, উপাধ্যায় রয়েছেন প্রবাসে। আচার্যানীর এই অবস্থা যাতে নিষ্ফল না হয় তার ব্যবস্থা নাও। আশঙ্কায় উনি বিষণ্ণ অবস্থায় রয়েছেন। উতঙ্ক এই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। এই গর্হিত কাজ তিনি করতে পারবেন না। গুরু মশাই এই অকাজের নির্দেশ দিয়ে যাননিতো।

ন ময়া স্ত্রীণাং বচনাদিদমকার্য্যং করণীয়ম্। ন হ্যহমুপাধ্যায়েন সন্দিষ্টঃ অকার্য্যমপি ত্বয়া কার্য্যম্ ইতি।

আচার্য বেদ যথাকালে ফিরে এলেন। শিষ্য উতঙ্কের কাছে সেই বৃত্তান্ত শুনে প্রীত হলেন। সন্তুষ্টচিত্তে উতঙ্ককে কাম্যবস্তুলাভের আশীর্বাদ করে বিদায় দিলেন তাঁকে। উতঙ্ক গুরুদক্ষিণাদানে ইচ্ছুক হয়ে বললেন, যশ্চাধর্ম্মেণ বৈ ব্রূয়াদ্ যশ্চাধর্ম্মেণ পৃচ্ছতি। তয়োরন্যতরঃ প্রৈতি বিদ্বেষং চাধিগচ্ছতি।। অধার্মিক (গুরু) যিনি গুরুদক্ষিণা কামনা করেন না এবং সেই শিষ্য যিনি গুরুদক্ষিণা না দিয়েই গুরুর কাছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুমতিপ্রার্থী হন—এঁদের দু’ জনের মধ্যে একজন অধার্মিক মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং অপরজন বিদ্বেষভাজন হন। তাই শিষ্য উতঙ্ক গুরুদক্ষিণা দিতে অভিলাষী।

বারবার গুরুর প্রার্থিত দক্ষিণাদানের জন্যে অনুরোধ জানালেন উতঙ্ক। শেষে গুরু বললেন, তদ্ গচ্ছৈনাং প্রবিশ্যোপাধ্যায়ানীং পৃচ্ছ, কিমুপহরামীতি। এষা যদ্ ব্রবীতি তদুপহরস্ব ইতি। অন্তঃপুরে প্রবেশ করে উপাধ্যায়ানীকে জিজ্ঞাসা কর, উনি যা বলবেন সেটিই দিয়ো। গুরুপত্নী বললেন ওই যে পৌষ্যরাজার ক্ষত্রিয়া স্ত্রী যে কানের দুলজোড়া পড়েছিলেন সেই দুটিই ভিক্ষা করে নিয়ে এসো। গচ্ছ পৌষ্যং প্রতি রাজানম্, কুণ্ডলে ভিক্ষিতুং তস্য ক্ষত্রিয়য়া পিনদ্ধে। কারণ হল, সেইদিন থেকে চতুর্থ দিনে সেই দুলজোড়া পরিধান করে গুরুপত্নী পুণ্যব্রতপালনের অঙ্গ হিসেবে ব্রাহ্মণদের ভোজ্যদ্রব্য পরিবেশন করবেন। তৎ সম্পাদয়স্ব। এবং হি কুর্ব্বতঃ শ্রেয়ো ভবিতা, অন্যথা কুতঃ শ্রেয় ইতি।।

এই ইচ্ছাপূরণ করো। এতেই তোমার মঙ্গল, নাহলে কল্যাণ হবে কি করে? পথে দেখা হল বৃষপৃষ্ঠে আরোহণকারী এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বললেন, ভো উতঙ্ক! এতৎ পুরীষমস্য ঋষভস্য ভক্ষয়স্ব ইতি। ওহে উতঙ্ক, এই বৃষবিষ্ঠা ভক্ষণ কর। অনিচ্ছুক উতঙ্ককে উপাধ্যায়ের দৃষ্টান্ত মনে করিয়ে দিলেন সেই ব্যক্তি — মা বিচারয়, উপাধ্যায়েনাপি তে ভক্ষিতং পূর্ব্বম্, ইতি।। ওহে অত ভেবো না, তোমার আচার্যও পূর্বে এটি ভক্ষণ করেছিলেন। আর কোনও সংশয় নেই। নিঃসংকোচে বৃষের মূত্র ও বিষ্ঠা ভক্ষণ করলেন উতঙ্ক। এরপর দাঁড়িয়ে আচমন করে, পরিশুদ্ধ হয়ে হাজির হলেন পৌষ্য রাজদরবারে। জানালেন প্রার্থী হয়ে এসেছেন। অর্থী ভবন্তমুপাগতোঽস্মি, ইতি। গুরুর প্রয়োজনে ক্ষত্রিয়া রাজমহিষীর কুণ্ডলদুটির কামনায় এসেছেন। পৌষ্য রাজাও একদা সহাধ্যায়ী উতঙ্ককে ঢালাও অনুমতি দিলেন। প্রবিশ্যান্তঃপুরং ক্ষত্রিয়া যাচ্যতাম্, ইতি।। অন্তঃপুরে যান, ক্ষত্রিয়ার কাছে প্রার্থনা করুন। অন্তঃপুরে ক্ষত্রিয়ার সাক্ষাৎ পেলেন না উতঙ্ক। রাজা জানতে পেরে বললেন, অপবিত্র অবস্থায় আছেন এমন ব্যক্তির কাছে ক্ষত্রিয়া দৃশ্যমানা হন না। উতঙ্ক স্মরণ করলেন তাঁর আচমনে হয়তো ত্রুটি আছে। উতঙ্ক আবারও উপবেশন করে যথাযথভাবে আচমন সম্পন্ন করবার পর, রাজার ক্ষত্রিয়া স্ত্রীর দেখা পেয়ে আর্জি জানালেন। সন্তুষ্টচিত্তে রাজমহিষী তাঁর কানের দুলজোড়া দান করলেন উতঙ্ককে, তবে সতর্ক করে দিলেন, এতে কুণ্ডলে তক্ষকো নাগরাজঃ সুভৃশং প্রার্থয়তি, অপ্রমত্তো নেতুমর্হসি ইতি।। এই কুণ্ডলজোড়া নাগরাজ তক্ষকেরও ভারি পছন্দের, সাবধানে নিয়ে যাবেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২০: অহল্যার শাপমুক্তি ও কিছু প্রশ্ন

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৫: ইলিশ নামটির মধ্যে আমাদের আবেগ ও আস্বাদ দুটোই জড়িয়ে আছে

উতঙ্ক, রানিকে আশ্বস্ত করে, বিদায় নিতে হাজির হলেন পৌষ্যরাজার কাছে। পৌষ্যরাজা একদা সতীর্থ এবং সৎপাত্র, উতঙ্ককে, ভোজনে আপ্যায়িত করতে চাইলেন। উতঙ্কের তাড়া আছে, হাতে সময় মাত্র চারদিন। যেমন অন্ন প্রস্তুত আছে তেমন অবস্থাতেই তিনি সেই ভোজ্য গ্রহণ করতে চাইলেন। পৌষ্যরাজা সাত তাড়াতাড়ি অন্ন পরিবেশনের ব্যবস্থা করলেন। দেখা গেল শীতল অন্নে পড়ে আছে একগাছা চুল। উতঙ্কের জাত্যাভিমানে হয়তো আঘাত লাগল। তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন— যেহেতু অপবিত্র অন্ন দিয়েছ আমায়, অন্ধত্ব গ্রাস করবে তোমায়। যস্মান্মে অশুচ্যন্নং দদাসি, তস্মাদন্ধো ভবিষ্যসি, ইতি।। রাজাও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি হয়তো নিজের ব্যবহারে আন্তরিক ছিলেন তাই তিনিও প্রত্যভিশাপ দিলেন, যস্মাৎ ত্বমপ্যদুষ্টমন্নং দূষয়সি, তস্মাত্ত্বমনপত্যো ভবিষ্যসি, ইতি।। তুমি আমার পরিবেশিত দূষণমুক্ত অন্নে দোষারোপ করেছ তাই তুমিও নির্বংশ হবে।

এমন প্রত্যভিশাপ অযৌক্তিক বিবেচনা করে অন্ন পরীক্ষা করে সত্যতা যাচাই করা হল। পৌষ্যরাজা উতঙ্কর কাছে ক্ষমা চেয়ে শাপ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানালেন। একদিনের অন্ধত্বের পর আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন রাজা— এই আশ্বাস দিলেন উতঙ্ক। প্রত্যুপকারে শাপ পরিহারের অনুরোধে পৌষ্য রাজা জানালেন, সেটি সম্ভব নয়। ব্রাহ্মণের হৃদয় মাখনের মতো সহজে গলে যায় আর ক্ষত্রিয় সেটির বিপরীত। ক্ষত্রিয়ের বাক্য মাখনের মতো বিগলিত হয় সহজেই, হৃদয় কিন্তু তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার। তাই ক্ষত্রিয়ত্বহেতু এই অভিশাপ প্রত্যাহারে আমি অক্ষম। তদেবং গতে ন শক্তোঽহং তীক্ষ্ণহৃদয়ত্বাত্তং শাপমন্যথা কর্ত্তুম,গম্যতাম্ ইতি বেদশিষ্য উতঙ্ক জানালেন, দুষ্টে চান্নে নৈষ মম শাপো ভবিষ্যতি অভিশাপের কারণ অন্ন। সেটি দূষণমুক্ত নয়, দূষণযুক্ত প্রমাণিত হয়েছে। তাই রাজার শাপ ফলবে না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ

এরপর আবারও বাঁধা। পথে এক নগ্ন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হল উতঙ্কের। বার বার সন্ন্যাসীটির সঙ্গে দেখা হতে লাগল। উতঙ্ক দুলজোড়া মাটিতে রেখে পুকুরে স্নানাহ্নিক করতে গেলেন। ফিরে এসে দেখলেন দুলজোড়া নিয়ে সেই সন্ন্যাসী উধাও। উতঙ্ক ধাওয়া করে চোরটিকে যখন প্রায় ধরে ফেলেছেন তখন সেই চোররূপী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তক্ষকরূপ ধারণ করে ভূভাগে একটি গর্তে প্রবেশ করে পাতালে নাগলোকে স্বগৃহে আশ্রয় নিলেন। সেই গহ্বরে পথ প্রশস্ত করতে বজ্র দিয়ে সাহায্য করলেন ইন্দ্র। উতঙ্ক সেই গর্তপথে পাতালে প্রবেশ করে নাগলোকের সীমাহীন বিস্তৃতি দেখে দিশাহারা হয়ে নাগেদের স্তুতি শুরু করলেন। তাও কুণ্ডলদুটির হদিশ পেলেন না। তখন মনে প্রবল উদ্বেগ নিয়ে দেখলেন, তাঁতের ওপর দুটি কাঠি নিয়ে বয়নরত দুই রমণীকে। তাঁতটিতে রয়েছে কতগুলো সাদা ও কালো সুতো। একটি চাকায় বারোখানি কাঠ লাগান রয়েছে। ছয়টি বালক ঘূর্ণনকাজে নিযুক্ত।একজন সুপুরুষ ব্যক্তি এবং একটি ঘোড়াও রয়েছে সেখানে। উতঙ্ক এই দৃশ্যটির মধ্যে কালচক্রের আবর্তনের নিত্যতা স্মরণ করলেন। মন্ত্রোচ্চারণের মতো নিষ্ঠায় স্তবরূপে উতঙ্ক তা বিবৃত করলেন।

ত্রীণ্যর্পিতান্যত্র শতানি মধ্যে ষষ্টিশ্চ নিত্যং চরতি ধ্রুবেঽস্মিন্। চক্রে চতুর্বিংশতিপর্ব্বযোগে ষড্ বৈ কুমারাঃ পরিবর্ত্তয়ন্তি।। তন্ত্রঞ্চেদং বিশ্বরূপে যুবত্যৌ বয়স্তন্তূস্থ সততং বর্ত্তয়ন্ত্যৌ। কৃষ্ণান্ সিতাংশ্চৈব বিবর্ত্তয়ন্ত্যৌ ভূতান্যজস্রং ভুবনানি চৈব।। তাঁতটির চক্র, ঘূর্ণায়মান সংবৎসররূপ কাল। সাদা ও কালো সুতো যথাক্রমে দিন ও রাত্রি।এদের সংখ্যা তিনশত ষাট।এই ঘূর্ণায়মান কালচক্রের আবর্তন নিত্য অর্থাৎ চিরন্তন। ঋতুরূপ ছয় কুমার ঘুরিয়ে চলেছেন কালচক্র। দ্বাদশমাস চক্রটির অরপঙক্তি।

এই কলচক্রের সঙ্গে বারটি পূর্ণিমা ও বারটি অমাবস্যার রয়েছে সংযোগ।উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণ দুই নারী। এনারা কালচক্রের আবর্তনে অংশ নিয়ে বিশ্বচরাচরের প্রাণীবৃন্দে ও ভুবনসমূহে পরিবর্তিত রূপদান করে চলেছেন। কালরূপ বস্ত্রবয়নে রত এই দৃশ্যে যাঁরা আছেন প্রত্যেককে স্তুতি করলেন উতঙ্ক।

এরপর তিনি অশ্বারূঢ় ব্যক্তিকে ইন্দ্ররূপে চিহ্নিত করে সুন্দর পদবন্ধে তাঁকেও স্তুতি করলেন। স্তবে তুষ্ট ইন্দ্র উতঙ্ককে অনুগৃহীত করতে চাইলেন। উতঙ্ক প্রার্থনা জানালেন, নাগা মে বশমীয়ুঃ। নাগকুল আমার বশীভূত হোক।পুরুষটি অশ্বের গুহ্যদ্বারে ফুৎকার করতে আদেশ করলেন। ফুৎকারমাত্র অশ্বটির সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার দিয়ে ধূমের সঙ্গে অগ্নিশিখা বহির্গত হয়ে, নাগলোক পরিব্যাপ্ত হল। সমাচ্ছন্ন ধূমকুণ্ডলি থেকে উত্থিত অগ্নিতেজের উত্তাপ সহ্য করতে পারলেন না নাগরাজ তক্ষক। বিষণ্ণ ও বিভ্রান্ত তক্ষক দুলজোড়া নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে বললেন, ইমে কুণ্ডলে গৃহ্ণাতু ভবান্,ইতি।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৭: বিপৎকালে দেখতে পাই, রাখাল ছাড়া বন্ধু নাই…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪: শুভ পরিণয়বেলা

মহাশয়, কুণ্ডলদুটি গ্রহণ করুন। কার্যোদ্ধারের পর গুরুগৃহে প্রত্যাবর্তন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সেই দিনই গুরুপত্নীর ব্রতোদযাপনের পুণ্য তিথি। সেই অশ্বারোহী পুরুষ বললেন, ওই অশ্বটিতে আরোহণ করে উতঙ্ক নিমেষে পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে। উতঙ্ককে অভিশাপ দিতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন গুরুপত্নী। উতঙ্ক সংগৃহীত দুলজোড়া দিলেন গুরুপত্নীকে।গুরু এবং গুরুপত্নীর আশীর্বাদধন্য উতঙ্ক নাগরাজ তক্ষকের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার মানসিকতায় কালবিলম্ব না করে প্রস্থান করলেন হস্তিনাপুরের রাজা জনমেজয়ের উদ্দেশ্যে। কারণ, তিনি জানতেন জনমেজয়ের পিতার মৃত্যুর হয়েছিল তক্ষকের দংশনে। সেই তথ্য জানিয়ে জনমেজয়ের কানে বিষ ঢেলে প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে তোলাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। নিজের সামর্থ্যের অভাব। রাজার উদ্যোগে, রাজার ও তাঁর নিজের একই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। উতঙ্কের মনে জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুনে।উতঙ্ক সফল হয়েছিলেন। জনমেজয় অচিরেই সর্পমারণযজ্ঞে ব্রতী হলেন।

ঋষি আপোদ ধৌম্যের শিষ্য বেদের ছাত্রাবস্থায় গুরুর আজ্ঞাপালনে শ্রম ছিল তাঁর কায়িক শ্রম,শারীরিক শক্তিক্ষয়ে গুরুসেবা। এই গুরুসেবায় কোন খাদ ছিল না। তিনি গুরুগৃহের কষ্টকর অভিজ্ঞতা মনে রেখেছেন। শিষ্য উতঙ্ককে কষ্টকর গুরুসেবায় নিযুক্ত করেননি। পরিবর্তে স্ত্রীর প্রার্থনাপূরণেই গুরুদক্ষিণাদান সম্পূর্ন হবে— মনে করেছেন। কায়িকশ্রমদান— শিষ্যের সহিষ্ণুতা,অধ্যবসায়, কার্যোদ্ধারে একনিষ্ঠতার পরীক্ষণ। সে বিষয়ে শিষ্য বেদ নিঃসন্দেহে সফল হয়েছেন। স্ত্রীর বৈষয়িক আকাঙ্খাপূরণেই গুরুদক্ষিণাদান সম্পন্ন হবে মনে রেখে উতঙ্ককে তিনি স্বভার্যার সাধ্যের বাইরের সাধ পূরণে উদ্যোগ নিতে প্রকারান্তরে বাধ্য করেছেন।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

এই গুরুস্ত্রীর আবদার তথা আকাঙ্খাপূরণে উতঙ্কের যে উদ্বেগ, শ্রম, প্রচেষ্টা তা কায়িক ও মানসিক শ্রমের একটি চরম অবস্থা, বলা যেতে পারে, যা বেদকৃত কায়িক শ্রমের থেকেও হয়তো বেশি। কারণ, উতঙ্কের কার্যোদ্ধারে প্রতিবন্ধকতা ছিল বাহ্যিক, শারীরিক নয়। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিজের আয়ত্তাধীন। উতঙ্ক গুরুকে সন্তুষ্ট করে তাঁর আশীর্বাদ লাভ করেলেন সত্যিই কিন্তু বুকে বয়ে আনলেন আত্মক্ষয়ী প্রতিহিংসার আগুন। গুরুদক্ষিণা যখন বস্তুনিষ্ঠ হয় অর্থাৎ ম্যাটেরিয়ালিস্টিক হয়ে ওঠে তখন মনে হয় তাঁর অবমূল্যায়ন ঘটে।
গুরুদক্ষিণাদানে গুরু ও শিষ্য উভয়েই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন। গুরু তুষ্ট হন শিষ্যের সাফল্যে, আর শিষ্য আনত কৃতজ্ঞতায় গুরুকে তুষ্ট করে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। গুরু বেদ তুষ্ট হয়েছিলেন কিন্তু শিষ্যের কী অনুভূতি হল দক্ষিণাদানের শেষে? শিষ্য উতঙ্ক বুকভরা প্রতিহিংসাস্পৃহা নিয়ে ফিরে গেলেন লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে। হয়তো ওই দুলজোড়া সংগ্রহ করতে না গেলে এই পরিস্থিতির শিকার হতেননা উতঙ্ক।

ঘটনা পরম্পরায় প্রমাণিত হয়েছে অবস্থাবিশেষে অভিশাপ প্রত্যাহার সহজ হতে পারে, যদিও সবটাই নির্ভর করে শাপদাতার মানসিকতার ওপর। উতঙ্ক পৌষ্যরাজার প্রতি শাপ প্রত্যাহার করেছেন, পৌষ্যরাজা উতঙ্কের প্রতি অভিশাপ অন্যায্য জেনেও নির্বংশ হওয়ার মতো গুরুতর অভিশাপ ফিরিয়ে নিতে পারবেন না জানিয়েছেন। ক্রোধ এবং ক্ষমার দুয়ের দ্বন্দ্বে ক্ষমা অনেক নমনীয়। এটি হয়তো প্রমাণিত সত্য। ক্ষমায় হৃদয় দ্রবীভূত হয়, সাবলীল হয় সম্পর্ক, ক্রোধে কিন্তু তা হয় না। বাহুবল থেকে মনোবল অনেক বেশি শক্তির আধার—এটি বোধ হয় আরও একবার জানা গেল। এ বিষয়ে পৌষ্য রাজা পরাজিত হলেন, উতঙ্কের মহত্ত্বের কাছে।

উতঙ্করা আজও আছেন। ছাত্রকুলের প্রতিভূ উতঙ্ক। গুরুনির্দিষ্ট লক্ষ্যপূরণে দিশাহারা হয়ে ভেসে যান তাঁরা কালস্রোতে। পথে অতলগহ্বরে পতন, ছদ্ম নাগবেশী প্রতিবন্ধকতা ছড়ানো রয়েছে সর্বত্র। সাফল্য হাতছাড়া হয়, পথে বিভ্রান্তি, প্রতিযোগীদের গুপ্ত আক্রমণ। আবার ভাগ্য অনুকূল হলে, সহায়তার হাত বাড়িয়ে রয়েছেন কোথাও কোন সুজন। না হলে দুর্বিষহ অভিশপ্ত জীবন। সাফল্য অনিশ্চিত, তবু অপরিসীম প্রচেষ্টায় কি না হয়, তার অনন্য উদাহরণ উতঙ্ক। সাদা আর কালো সুতোয় কালচক্রের আবর্তনে বিশ্বতাঁতে নিয়ত বয়ন হচ্ছে যে বস্ত্রটি তাতে লেখা থাকবে উতঙ্কদের কীর্তিকাহিনি, আবহমান জীবনে নিরন্তর তাঁদের যাত্রা, যুগান্তরেও সেই পথটি কিন্তু চিরন্তন।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content