![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/07/sarada-maa-1.jpg)
শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা।
অল্পদিনের মধ্যে দু’ পক্ষের বিবাহের কথা স্থির হয়ে গেল। কিন্তু অভাবের সংসারে শুধু মুখের কথায় তো আর বিয়ে হয় না। সেকালের প্রথা অনুসারে খুব বেশি না হোক, কন্যাপক্ষের কাছে তিনশো টাকা পণ চাইলেন চন্দ্রমণি। পণ? না বলা যায় পুজোর দক্ষিণা! তখনকার দিনের হিসাবে সে টাকা কম নয়। কন্যাপক্ষ সেই টাকাই পণ দিলেন। তাঁদের আদরের সারুর বিয়েতে কোনও কার্পণ্য করা হবে না। মেয়ের বিয়ে তো একবারই হবে। রামচন্দ্র ও শ্যামাসুন্দরী মনে মনে ভাবেন আর আনন্দিত হন, কী আশ্চর্য, এ যে অলৌকিক বিবাহ। নয় তো, সারদার রাশি-নাম কেনই বা হবে ঠাকুরমণি। সব যে পূর্বেই নির্দিষ্ট হয়ে আছে। শ্যামাসুন্দরীর গৃহলক্ষ্মী চন্দ্রমণির ঘরের নারায়ণের জন্য উৎসর্গিতা হয়েই এসেছেন।
তখন ১২৬৬ সালের বৈশাখ মাসের শেষভাগ। পরবর্তীকালে বিবাহ প্রসঙ্গে সারদা মা বলতেন, ‘খেজুরের দিনে আমার বিয়ে হয়েছিল, মাস মনে নেই। যখন কামারপুকুর গেলুম তখন সেখানে খেজুর কুড়িয়েছি’। বৈশাখে প্রখর দাহে যখন অন্য গ্রামের মাঠঘাঠ কাঠফাটা, পুকুর শুকিয়ে যায়। তখন জয়রামবাটির পুণ্যপুকুরের জল টলটল করছে, ‘যেন ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’। শীতল বাতাসে রাখাল বালক ঘুমিয়ে পড়ে গাছের তলায়, দূরে গরুর পাল নিশ্চিন্তে জাবর কাটে। গ্রামের সকলে বিশ্বাস করে যে আগে এমন ছিল না। সারদার জন্মের পরই যেন এখানে লক্ষ্মীশ্রী ছেয়ে গিয়েছে।
সেই ছোট সারুর আজ বিয়ে। সকাল থেকে উলুধ্বনি আর শাঁখের শব্দে মুখরিত সারা গ্রাম। জয়রামবাটির কাছাকাছি গ্রামগুলোতেও খবর রটে গিয়েছে। কোতলপুর, দেশড়া, আনুড় প্রভৃতি গ্রামের লোকেরাও এসে ভিড় জমিয়েছে জয়রামবাটিতে। রামচন্দ্রের আর্থিক সংগতি সামান্য হলেও সকলকেই আপ্যায়ণ করে আপন করে নিচ্ছেন। ছোট গ্রামের পুরোহিত, তবু গ্রামের সকলে তাঁকে মান্য করে। গাঁয়ের সাধারণ মানুষের অবস্থাও নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতন। সকাল থেকেই গ্রামের মানুষেরা আজ এ বাড়িতে যাওয়া আসা করছে। কেউই খালি হাতে আসছে না, যার যেমন সামর্থ্য ঝাঁকায় করে চাল, ডাল, শাক-সব্জি নিয়ে আসছে।
সেই ছোট সারুর আজ বিয়ে। সকাল থেকে উলুধ্বনি আর শাঁখের শব্দে মুখরিত সারা গ্রাম। জয়রামবাটির কাছাকাছি গ্রামগুলোতেও খবর রটে গিয়েছে। কোতলপুর, দেশড়া, আনুড় প্রভৃতি গ্রামের লোকেরাও এসে ভিড় জমিয়েছে জয়রামবাটিতে। রামচন্দ্রের আর্থিক সংগতি সামান্য হলেও সকলকেই আপ্যায়ণ করে আপন করে নিচ্ছেন। ছোট গ্রামের পুরোহিত, তবু গ্রামের সকলে তাঁকে মান্য করে। গাঁয়ের সাধারণ মানুষের অবস্থাও নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতন। সকাল থেকেই গ্রামের মানুষেরা আজ এ বাড়িতে যাওয়া আসা করছে। কেউই খালি হাতে আসছে না, যার যেমন সামর্থ্য ঝাঁকায় করে চাল, ডাল, শাক-সব্জি নিয়ে আসছে।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/07/sarada-maa.jpg)
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/08/Kishore-Kumar.jpg)
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১: একটু শুরুর কথা হলে ক্ষতি কী…
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/07/rajkahini-1.jpg)
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/08/GreenAvadavat.jpg)
পাখি সব করে রব, পর্ব-১: সবুজ সুন্দরী মুনিয়া
ঘোষপাড়া থেকে কেউ দই নিয়ে আসছে। কেউ পুকুর থেকে মাছ ধরে আনছে। গ্রামের হাটের মুদির দোকানীরাও তেল, মশলা নিয়ে আসছে। সকলেই আদরের সারুর বিয়েতে ভাগ নিতে চায়। রামচন্দ্রের নিজের ভাইরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। বিশেষ করে সারদার ছোট কাকা নীলমাধব বিয়ের রান্নার বামুনের দায়িত্ব নিয়েছে। অকৃতদার এই ভাইটির প্রতি বড়ভাই রামচন্দ্রের দুর্বলতা আছে। পৌরোহিত্য করার মতো পড়াশোনা তাঁর নেই। তাই তিনি নিজেই রাঁধুনি বামুনের কাজ বেছে নেন। রামচন্দ্রের শ্যালকরা রামব্রহ্ম, রামতারক, কেদার যথাসাধ্য সব কিছু দেখাশোনা করছেন।
এক সময় ব্যস্ততার মধ্যেও লাল ডুরে শাড়ি পরা, মাথায় খোঁপা, কপালে চন্দন আঁকা, হাতে কাচ ও পলার চুড়ি, ছোট দু’পায়ে আলতা এবং গলায় মালা পরে সারুকে দেখে যেন পিতা অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। এই তো সেদিন জন্মানো তাঁর মেয়ে কবে বড় হল? ভাবতে লাগলেন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, আনন্দে তাঁর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
এক সময় ব্যস্ততার মধ্যেও লাল ডুরে শাড়ি পরা, মাথায় খোঁপা, কপালে চন্দন আঁকা, হাতে কাচ ও পলার চুড়ি, ছোট দু’পায়ে আলতা এবং গলায় মালা পরে সারুকে দেখে যেন পিতা অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। এই তো সেদিন জন্মানো তাঁর মেয়ে কবে বড় হল? ভাবতে লাগলেন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, আনন্দে তাঁর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/07/Rabindranth-4.jpg)
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/07/Uttam-Kumar4.jpg)
বিচিত্রের বৈচিত্র, তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম…
যথাসময়ে ঠাকুর ও সারদার শুভ পরিণয়বেলা এসে গেল। ছাদনাতলায় উলু আর শঙ্খধ্বনির মাঝে রামচন্দ্র কন্যা সম্প্রদান করলেন। সারদাকে পিঁড়িতে বসিয়ে যখন বর প্রদক্ষিণ করা হচ্ছে, তখন একটি বিঘ্ন ঘটেই গেল। মেয়েদের হাসিমুখর গৃহপ্রাঙ্গণে সাতপাকের পর গাঁটছড়া বাঁধার সময় সাতাশটি পাটকাঠি জ্বেলে এয়োস্ত্রীরা সারদাকে নিয়ে বর প্রদক্ষিণ করার কালে জামাইয়ের হাতে বাঁধা মাঙ্গলিক সুতো পুড়ে গেল। সকলেই উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন, অমঙ্গল আশঙ্কায়। ঠাকুর শান্তভাবে মৃদু হেসে বললেন, সাতপাকে বাঁধা হয়ে গিয়েছে, হাতের সুতো রইল কি না-রইল তাতে কি আসে যায়। সকলে অবাক হয়ে খেয়াল করলেন যে তাঁদের জামাই তো যে-সে নয়। ইনি যে রসের ঠাকুর। আবার হাসি কলরবের মধ্যে সকলে মিলে গাঁটছড়া বেঁধে দিলেন।
শুভ পরিণয় জয়রামবাটির সকলের আন্তরিকতায় নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয়ে গেল। বাসরঘরে সুগায়ক বরের উদাত্ত কণ্ঠের গান শুনে সবাই অভিভূত হয়ে গেল। এমন ব্যাকুল-করা শ্যামাসঙ্গীত তারা যে কখনও শোনেনি। গানের তরঙ্গে সকলের মন থেকে সব অমঙ্গল চিন্তা দূর হয়ে গেল। এক অনাবিল আনন্দে সকলের মন ভরে উঠল।
শুভ পরিণয় জয়রামবাটির সকলের আন্তরিকতায় নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয়ে গেল। বাসরঘরে সুগায়ক বরের উদাত্ত কণ্ঠের গান শুনে সবাই অভিভূত হয়ে গেল। এমন ব্যাকুল-করা শ্যামাসঙ্গীত তারা যে কখনও শোনেনি। গানের তরঙ্গে সকলের মন থেকে সব অমঙ্গল চিন্তা দূর হয়ে গেল। এক অনাবিল আনন্দে সকলের মন ভরে উঠল।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/07/pancham.jpg)
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২১: পঞ্চমের সুরের মাদকতায় বুঁদ হয়ে আশা গাইলেন সেই তোলপাড় করা গান ‘পিয়া তু আব তো আজা…’
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/07/sundarban-3-2.jpg)
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা
গানের পর বর আর বধূ শুতে গেলেন। দুজনায় জেগে দুজনাকে দেখেন। ঠাকুর প্রদীপের আলোয় নববধূকে দেখে যেন গভীর অন্তঃস্থল থেকে বললেন, বেশ তুমি, দিব্যি। তার পর সারদাকে বললেন, ‘দ্যাখো গো, নারকেল তেলের গন্ধ আমার সয় না, তুমি এই বিছানায় শোও, আমি বরং মাটিতে শোব’খন, অসুবিধে হবে না’। এই কথা শুনে ছোট্ট সারদা তখনই পালঙ্ক থেকে নেমে দরজার পাশে গুটিয়ে রাখা চ্যাটাই বিছিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত ছোট কনেটির চোখে শোওয়া মাত্র ঘুম নেমে এল।
পরের দিন সকালে নববিবাহিত বরকনেকে নিয়ে যাওয়া হল কালীমন্দিরের পশ্চিম প্রান্তে যেখানে খোলা আকাশের নীচে রয়েছেন প্রস্তর নির্মিত ষষ্ঠী ঠাকুরণ। রীতি অনুযায়ী কন্যা ও জামাতাকে প্রণাম করতে বললেন। বিদায় বেলার সময় হয়ে আসছে। কুলদেবতা সুন্দরনারায়ণ ধর্মঠাকুর আর সিংহভাহিনী মায়ের মন্দিরে সকলে উপস্থিত হয়েছেন লৌকিক আচারের জন্য।—চলবে।
পরের দিন সকালে নববিবাহিত বরকনেকে নিয়ে যাওয়া হল কালীমন্দিরের পশ্চিম প্রান্তে যেখানে খোলা আকাশের নীচে রয়েছেন প্রস্তর নির্মিত ষষ্ঠী ঠাকুরণ। রীতি অনুযায়ী কন্যা ও জামাতাকে প্রণাম করতে বললেন। বিদায় বেলার সময় হয়ে আসছে। কুলদেবতা সুন্দরনারায়ণ ধর্মঠাকুর আর সিংহভাহিনী মায়ের মন্দিরে সকলে উপস্থিত হয়েছেন লৌকিক আচারের জন্য।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।