শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫


স্কেচ: লেখক।

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। ঘরের বিড়াল বনে গেলে বাঘ হয়। কপাল যদি মন্দ হয়, দুব্বোক্ষেতে বাঘের ভয়। খ্যাঁককশেয়ালই যুদ্ধের সময় বাঘ হয়ে যায়। গাধাকে পরালে বাঘের ছাল, বাঘ থাকে না চিরকাল। মোগল পাঠান হদ্দ হল, ফারসি পড়েন তাঁতি, বাঘ পালাল বিড়াল এল, শিকার করতে হাতি। কী কথা বললে হায়, শুনে হাসি পায়। লেজকাটা কুকুর হয়ে বাঘ হতে চায়। শক্তের ভক্ত নরমের বাঘ (যম)। তুলসীবনের বাঘ। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। বাঘ-ভালুকের রাজ্যে থাকি, মনের কথা মনেই রাখি।
বাঘ বুড়া হলেও রাগ ছাড়ে না। বাঘের দাঁত গেলে ও ইচ্ছা যায় না। বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। শুয়ে-শুয়ে লেজ নাড়ে, সেই বাঘ মানুষ মারে। আগে গেলে বাঘে খায়, পাছে গেলে সোনা (টাকা) পায়। অভদ্রা বরষা কাল, হরিণী চাটে বাঘের গাল। শাোনরে হরিণী তোরে কই, সময়গুণে সবই সই। নৌকার শত্রু ঢেউ, বাঘের শত্রু ফেউ। উপকারীকে বাঘে খায়। যা করে না বনের বাঘে, তা করে মনের বাঘে। মনে বড় সাধ, চড়ব বাঘের কাঁধ। সুযোগ পেলে ছাড়ে না, নাগে আর বাঘে। জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ। ভালর ভাল সৰ্বকাল, মন্দের ভাল আগে। রাজকন্যা যায় রাজার বাড়ি, সন্ন্যাসীকে খায় বাঘে।

রবিবাবু বলেছেন—
“এক ছুটে পালালো বেহারা,
বাঘ দেখে আপন চেহারা।
গাঁ গাঁ করে ডেকে ওঠে রাগে,
দেহ কেন ভরা কালাে দাগে?
ঢেঁকিশালে পুঁটু ধান ভানে,
বাঘ এসে দাঁড়ালাে সেখানে।
ফুলিয়ে ভীষণ দুই গোঁফ
বলে, চাই গ্লিসেরিন সাপ”
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৬: মজল আঁখি মজেছে মন, ইমোজি তোদের ডাকল যখন

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ

বাচ্চা ভোলানোর গানেও আছে “এক যে ছিল বাঘ /তার গায়ে ডোরাকাটা দাগ /লক্ষ্মীসোনা ছেলে এক /কেউ বকে না কেউ মারে না একটুও নেই রাগ।”

বাঘ নিয়ে কতো প্রবাদ, লোককথা, গল্প, কবিতা, গান। সেই কবে কোন রাখাল ছেলে সকলকে বাঘের ভয় দেখাতো, আর যেদিন সত্যিই বাঘ এল…

অথবা, শরত্চন্দ্রের গল্পে, এক বহুরূপী বাঘের ছদ্মবেশে নাকাল করেছিল বেশ…

অথবা, একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল। বোকা বককে পুরস্কারের ধোঁকা দিয়ে বাঘ হাড় বের করিয়ে নিল। পুরস্কার চাইতে বাঘ বলল “আমার মুখে মাথা ঢুকিয়ে বার করতে পেরেছো, এই পুরস্কার যথেষ্ট নয় কি?”

অথবা, সেই একটা আহত বুড়ো বাঘ একটা সোনার বালার লোভ দেখিয়ে মানুষ ভোলাতো…

অথবা, সেই ছাগলছানাটা বলতো “সিংহের মামা আমি নরহরি দাস/ পঞ্চাশ বাঘে মোর এক এক গ্রাস।”

বিগ ক্যাট। মাসির বোনপো। বোনপো বনের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড। মাসি মজন্তালী সরকারের গৃহিনী মহাবিদ্যাধারিণী, তবে ধরা পড়ে ভাজা মাছেও একান্ত বৈরাগ্য দেখান। মাসি দুধ চুরি করতে ভালোবাসেন।

এদিকে পয়সা দিলে নাকি বোনপোর দুধ, থুড়ি, বাঘের দুধ-ও মেলে। মাসি-বোনপোর দেখা হলে, কী হবে বা হয়ে থাকে বলা মুশকিল। তবে জুলাই মাসের শেষে একটা বোনপো দিবস আছে। আন্তর্জাতিক বোনপো দিবস। ইন্টারন্যাশনাল টাইগার’স ডে। বনে বনে বাঘ বাড়ুক। বন্যেরা বনেই সুন্দর। নদীনালা পার হয়ে মাসির বাড়ি আসার দরকার নেই যখন তখন। স্বয়ং জগন্নাথ বছরে একবার আসেন মোটে। মেসো মজন্তালীর হালুম হালুম শুনলে হার্টবিট বেড়ে যায়। দ্বিপদ মানুষগুলো বোনপোর গলায় কলার আইডি কী গাঁদার মালা, কিছুই পরিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত

বাঘ কী চায়? এ এক রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য বটে। এদিকে দ্বিপদরা ‘বাঘের বাচ্চা’ হতে ভালোবাসেন। একমাত্র এই রিলেশনটাই সম্মানের। তাই বাংলার বাঘ, বাঘিনী, ব্যাঘ্রহুংকার এসব চলে বেশ। কবিরা শার্দুলবিক্রীড়িত ছন্দে লিখতেন। মাঘের শীত বাঘের গায় ক্ষীণের শীত সর্বদা। শিবাজী বাঘনখ দিয়ে আফজল খান-কে হত্যা করেন। কৃত্তিবাস শিব বাঘছাল পরে ব্যাঘ্রচর্মের আসনে বসে থাকেন। তবে নিন্দুকরা বলেন, বাঘের ধরলে আঠারো ঘা। আর বাঘকে ঠেকানোর আর ঠকানোর জন্য মাথার পিছনে মুখোশ পরলে নাকি বাঘ জব্দ হয়।

একটা সহজ সরল মানুষের মন নাকি বাঘের থেকেও জটিল হয়। দেখা যাচ্ছে, লিটল পুষি ক্যাট আর বিগ ক্যাটের সম্পর্কটা বেশ আদরের হলেও বাস্তবটা অন্যরকম। পাড়ার বাঘ আর বনের বাঘের তফাৎ যতটা ততটাই। বনের বাঘ বাড়ুক তবে, মনের বাঘ নয়। মানুষখেকো বাঘের বুদ্ধি নাকি ভয়ানকরকম শয়তানীতে ভরা থাকে। তবে মানুষ যদি পেটভরে খেতে পারে, বাঘ পারবে না কেন? পৃথিবী তো কেবল দ্বিপদ ব্যাঘ্রশাবকদের কেনা নয়। আর তারা ‘বাঘের বাচ্চা’ হলেই খুশি।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৩: কোন কাননের ফুল ‘শ্যামলী’

অজানার সন্ধানে: এক লিটার পেট্রলে গাড়ি ছুটবে ১০০ কিমি! যুগান্তকারী যন্ত্র আবিষ্কার করেও রহস্যজনক ভাবে উধাও হন বিজ্ঞানী ওগলে

তবে তাঁদের পিতৃপ্রবর ব্যাঘ্রদেব মনুষ্যশাবক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন কীনা তা দক্ষিণরায় বলতে পারবেন বিশদে। মোট কথা, বাঘের লোভ নেই, যতটা উদরপূর্তি হলে চলে যায়, তার বাইরে সে ভাবে না। এদিকে, মানুষ তার বিপরীত। আর সেটা বলেই তাকে ‘আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস’ পালন করতে হয় খোল করতাল বাজিয়ে। কিন্তু, বাঘের দল ‘বিশ্ব মনুষ্য দিবস’ পালন করে নাকি? না না, পাড়ার দায়িত্ব যেমন হরিদাস পালের মাথায়, তেমনই পৃথিবীর দায়িত্ব মানুষের হাতে। কারণ পৃথিবীকে পাল্টে দিতে গিয়ে উল্টে দেওয়ার ক্ষমতা সে রাখে বটে। বেচারা বোনপোর সে জোর কোথায়? আর, (বা)গ আর (বা)ঘ এর ব্যবধান অনেকটাই। দুটোই কামড়ায়।

তবে ওই, মাসি আর বোনপোর মতোই ফারাক। স্যাকরার ঠুকঠাক আর কামারের এক ঘা। বাঘকে ঘি আর শাক খাইয়ে দুবেলা টপ্পা শুনিয়ে তাকে বদলানো যায় না। মাংসের গন্ধে সে ব্যাকুল হবেই। বরং বলতে পারেন, Bug-এ ধরলে নিস্তার আছে, কিন্তু বাঘ বাগে পেলে সব বঞ্চনার হিসেব কষে নেবে। বাঘ বাড়ান। বাগান সাজিয়ে তুলুন। বাঘবন্দি খেলা আর নয়। পায়ে পড়ি বাঘ মামা, কোরোনাকো রাগ মামা!!! কথায় বলে, বাঘ মরিলে চামড় রেখে যায়। মানুষ মরিলে নাম রেখে যায়।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content