ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
বিপদের সময়েই রাজাদের সাধারণত মন্ত্রীদের কথা মনে পড়ে, অন্য সময়ে নয়। তাই মন্ত্রীপদটিতে টিকে থাকতে গেলে রাজাদের বিপদের মধ্যে থাকাটাই জরুরি—এইরকম বিভিন্ন সব চিন্তা করতে করতেই দমনক সেই বৃষ-সঞ্জীবকের সন্ধান নিয়ে পিঙ্গলকের কাছে এসে উপস্থিত হল। নিজের মনের মধ্যে দমনককে নিয়ে যে সব আশঙ্কাগুলো তৈরই হচ্ছিল সেগুলিকে লুকিয়ে রেখে স্বাভাবিকভাবেই বসেছিল সিংহ পিঙ্গলক। দমনক তাঁর কাছে গিয়ে প্রণাম করলে পিঙ্গলক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন — আপনি কি সেই প্রাণীটির কোনও সন্ধান পেলেন?
দমনক বিনীত ভাবে বলল—হে রাজন! আপনার কৃপাতেই আমার সে সৌভাগ্য হয়েছে। আমি দেখেছি তাঁকে।
পিঙ্গলক আশ্চর্য হয়ে বললেন—সত্য বলছেন?
দমনক তখন আবার নীতিশাস্ত্রের শ্লোক শুনিয়ে বলেন—স্বয়ং মহারাজের চরণপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অসত্য কথা নিবেদনের দুঃসাহস আমার নেই। রাজা বা দেবতার সামনে সামান্যতম মিথ্যাও যে বলে, সে বড়সড় মাপের একজন কেউকেটা হলেও শীঘ্রই তার পতন অনিবার্য। কারণ মনু মহারাজ স্বয়ং বলেছেন যে “সর্বদেবমযো রাজা”—ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য, অগ্নি, বরুণ প্রভৃতি সমস্ত প্রধান প্রধান দেবতাদের শক্তির সার অংশটুকু নিয়ে স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা রাজাকে সৃষ্টি করেছেন। তাই রাজা কোনও সাধারণ মানুষ নন, তাঁকে দেবতার সমানই মান্যতা দেওয়া উচিত। রাজা এবং দেবতার মধ্যে পার্থক্য শুধু এক জায়গাতেই রাজার থেকে শুভাশুভ ফলটা পাওয়া যায় তত্ক্ষণাৎ; কিন্তু দেবতার থেকে সে ফল পাওয়া যায় পরজন্মে।
দমনকের এইসব কথায় পিঙ্গলক বিশেষ একটা পাত্তা না দিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি সত্যিই তবে তাঁকে দেখেছেন?
আসলে পিঙ্গলকের এই সন্দেহটা নিরর্থক নয়। তিনি আসলে বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে সেই অজানা পশুটি যেটি সারাটা সময়ে বনের মধ্যে এমন ভয়ঙ্কর শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে দমনক তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছে; অথচ সে এখনও অক্ষত দেহেই আছে। তাই নিজেই নিজের সন্দেহভঞ্জন করে দমনককে বললেন, “ন দীনোপরি মহান্তঃ কুপ্যন্তীতি ন ত্বং তেন নিপাতিতঃ”—আসলে বলশালী মহান মানুষেরা সর্বদা দীন-হীনদের প্রতি দয়া পরবশ হন; তাদের উপর ক্রুদ্ধ হন না। পণ্ডিতরা বলেন—
তৃণানি নোন্মূলযতি প্রভঞ্জনো মৃদুনি নীচৈঃ প্রণতানি সর্বতঃ।
স্বভাব এবোন্নতচেতসামযং মহান্মহৎস্বেব করোতি বিক্রমম্।। (মিত্রভেদ, ১৩৩)
পাঠকদের বলব শ্লোকটি একটু খেয়াল করবেন। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখাগড়ার প্রাণ যায় — এ কথা সতঃসিদ্ধ। কারণ সেই উলুখাগড়া হল বিবাদমান দু’দলের সৈন্যসামন্ত। দু’দেশের দুই রাজার মধ্যে যুদ্ধ হলে, সৈন্যরা প্রাণে মারা পড়ে এটা আমরা সকলেই জানি; কিন্তু উভয় দেশের সাধারণ মানুষ? যারা অধিকাংশই যুদ্ধ চান না, যারা শান্তিপ্রিয়? যেকোন রাজশক্তির কাছেই যারা মাথা নত করে, যারা দীন-হীন? মহান রাজারা তাদের কোন রকম ক্ষতিই করেন না। এইটাই মহতের লক্ষণ শরণাগত বিনম্রকে সে ক্ষতি করে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে যে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন (Fourth Geneva Convention) হয়েছিল। সেখানে ১৪৯ নং ধারায় (Article 159) সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে — “Civilians are to be protected from murder, torture or brutality, and from discrimination on the basis of race, nationality, religion or political opinion.”
সাধারণ নাগরিককে তার জাতি, জাতীয়তাবোধ, ধর্ম কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে সমস্ত রকমের হত্যা, নির্যাতন আর বর্বরতা থেকে রক্ষা করতে হবে। ঐতিহাসিকরা তথ্য অনুযায়ী কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই প্রায় ১.৫ কোটি সৈন্যের পাশাপাশি প্রায় ৩.৮ কোটি সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানা যায়। এটা যে তত্কালীন ইউরোপে কতখানি মানব সম্পদের উপর প্রভাব পড়েছিল সেকথা নিশ্চয়ই আর আলাদা করে ব্যাখ্যা করবার কিছু নেই আর সেই কারণেই ১৯৪৯ সালের চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনে সাধারণ মানবসম্পদ রক্ষা করবার জন্য এই ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ভেবে দেখুন তো ভারতীয় রাজনীতিশাস্ত্রের শিশুপাঠ্য বইগুলিতে সেই কতকাল আগে সেই মানবসম্পদ রক্ষা করবার শিক্ষা কেমন অনায়াসে রাজার ছেলেদেরকে প্রকৃতি রাজ্যের সর্ববলশালী শক্তি ‘প্রভজ্ঞন’ অর্থাৎ বায়ুর উপমা টেনে বোঝানো হয়েছে! সে আমলের মানুষের অভিজ্ঞতায় বায়ুই হয়তো ছিল সর্বশক্তিমান, তাই হয়তো হনুমানকে পবনপুত্ররূপেই পৌরাণিক সাহিত্যে কল্পনা করা হয়েছে।
যাইহোক আমরা আবার গল্পে ফিরে আসি। চতুর দমনক রহস্য করে পিঙ্গলককে বলল—হে রাজন! আপনি সঠিকই অনুমান করেছেন, তিনি একজন মহাত্মাই বটে। আমরা সকলেই তাঁর শক্তির কাছে দীন-হীনের ন্যায়। তিনি মহাশক্তিশালী। কিন্তু মহারাজ যদি ইচ্ছা করেন তো তাঁকে আমি আপনার ভৃত্যরূপে নিযোগ করতে পারি।
পিঙ্গলক উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “কিং ভবান্ শক্নোতি এবং কর্তুম্”— আপনি কি সত্যিই এমন করবার ক্ষমতা রাখেন?
চতুর দমনক বললেন, মহারাজ! বুদ্ধি প্রয়োগ করে করা যায় এমন কোনও অসাধ্য কার্য এই জগতে নেই। পণ্ডিতরা বলেন—
ন তচ্ছস্ত্রৈর্ন নাগেন্দ্রৈর্ন হযৈর্ন পদাতিভিঃ।
কার্যং সংসিদ্ধিমভ্যেতি যথা বুদ্ধ্যা প্রসাধিতম্।। (ঐ, ১৩৫)
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৪: রাজনীতিতে নিজের উন্নতি করতে গেলে দেবগুরু বৃহস্পতির মতো মানুষের উপরেও বিশ্বাস করা অনুচিত
বিচিত্রের বৈচিত্র: তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম…
পিঙ্গলক তখন বললেন, “যদ্যেবং তর্হ্যমাত্যপদেঽধ্যারোপিতস্তম্”—হে দমনক! যদি এমন আপনি সত্যিই করতে পারেন তবে এই মুহূর্তে আপনাকে পুনরায় অমাত্য পদে বহাল করলাম। আমার প্রজাদের মধ্যে কাকে অনুগ্রহ বা কাকে নিগ্রহ করতে হবে। আজ থেকে এ সবই স্থির হবে আপনার সিদ্ধান্তে।
দমনক তখন তাড়াতাড়ি গিয়ে সেই সঞ্জীবককে বেশ ডাঁটের সঙ্গে খেঁকিয়ে বলল, ওরে বেটা দুষ্ট বৃষ! এদিকে আয়। মহারাজ পিঙ্গলক তোকে ডাকছে। এমন ভাবে অকারণে চিত্কার করছিস কেন?
এদিকে সঞ্জীবক তো এ ক’দিন মনের আনন্দে সে বনের মধ্যে উচ্চৈস্বরে হাঁক-ডাক ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। যমুনাতীরের কচি ঘাস খেয়ে এতোদিনে শক্তসমর্থও হয়েছে সে। দমনকের ধমকে খেয়ে রীতিমত থতমত খেয়ে ভয়ে ভয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল, হে ভদ্র! এই পিঙ্গলকটি কে?
তাতে দমনক তাকে দ্বিগুণ ধমকে বলল, স্বামী পিঙ্গলককে তুই জানিস না? কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর না জানার ফলটা এখনই হাতে-নাতে পেয়ে যাবি। সমস্ত পশুপরিবৃত হয়ে এই বনের রাজা সিংহ-পিঙ্গলক ওই দূরে বটবৃক্ষের মূলে বসে রয়েছেন।
সব দেখে শুনে সঞ্জীবক নিতান্ত বিমর্ষ হয়ে পড়লেন; তার আয়ু যে আজকেই শেষ হতে চলেছে এ-কথা বুঝতে আর বাকি রইল না তার। বিষণ্ণ মনে দমনককে প্রসন্ন করার চেষ্টায় বললেন, হে ভদ্র! আপনাকে দেখে তো সাধু চরিত্রের মানুষ বলেই মনে হচ্ছে, সেইসঙ্গে কথায়-বার্তায় আপনি যে বচনপটুও সেটাও বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। যদি সত্যই আপনি আমাকে রাজার কাছে নিয়ে যান, তবে অনুরোধ করছি রাজার থেকে অভয়দান করিয়ে আমার প্রতি কৃপা করুন।
দমনক কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আপনি সত্যই বলেছেন। সত্যি বলতে রাজ-কূটনীতিও এই কথাই বলে। যেহেতু—
পর্যন্তো লভ্যতে ভূমেঃ সমুদ্রস্য গিরেরপি।
ন কথঞ্চিন্মহীপস্য চিত্তান্তঃ কেনচিৎ ক্বচিৎ।। (ঐ, ১৩৬)
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৮: ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা
দমনক বললেন, তুমি এখানেই অপেক্ষা কর আমি সঠিক সময় বুঝে তোমাকে রাজার কাছে নিয়ে যাব।
সঞ্জীবকের সঙ্গে এইরকম একটা প্রাথমিক কথাবার্তা বলে দমনক মনে মনে একটি কৌশল চিন্তা করে পিঙ্গলকের কাছে গিয়ে বলল, হে রাজন! সেই প্রাণিটি কোনও পার্থিব প্রাণী নয়। সে ভগবান্ মহেশ্বরের বাহনের মতো বিশাল একটি বৃষ। আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, “মহেশ্বরেণ পরিতুষ্টেন কালিন্দীপরিসরে শষ্পাগ্রাণি ভক্ষযিতুং সমাদিষ্টঃ কিং বহুনা মম প্রদত্তং ভগবতা ক্রীডার্থং বনমিদম্”—ভগবান্ শঙ্কর প্রসন্ন হয়ে খেলা করবার জন্য আমাকে যমুনাতটবর্তী এই বন প্রদান করেছেন।
সিংহ-পিঙ্গলকও এবার বেশ ভয় পেয়ে বললেন, এইবার বিষয়টা আমি পুরোটা বুঝলাম। দেবতার প্রসাদ ছাড়া হিংস্র-মাংসাশী জন্তুতে পরিপূর্ণ এইরকম জঙ্গলের মধ্যে একটি তৃণভোজী প্রাণী কি করেই বা নির্ভয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে? আমার বিষয়টা আগেই বোঝা উচিত ছিল। যাইহোক তুমি তাকে কী বললে?
দমনক বললেন, হে রাজন! আমি তাঁর কাছে গিয়ে দর্পের সঙ্গে বললাম, হতে পারে আপনাকে মহাদেব স্বয়ং এই বনটি লীলাখেলা করবার জন্য প্রদান করেছেন কিন্তু আমাদের এই বন স্বয়ং মাতা চণ্ডিকার বাহনতুল্য মহারাজ পিঙ্গলকের রাজ্য আর তাই আপনি হলেন তাঁর অভ্যাগত সম্মানীয় অতিথি। তাই চলুন তাঁর কাছে আপনাকে নিয়ে যাই আপনারা দু’জনে দুই ভাইয়ের মতন একসঙ্গে পানাহার করে ঘুরে বেড়িয়ে কাল অতিবাহিত করবেন। সেই বৃষটি তখন আমার কথা মেনে নেয় এবং প্রসন্ন হয়ে বলে, বেশ তবে আপনার মহারাজের কাছ থেকে আমাকে অভয় প্রদান করিয়ে দিন। তারপর না হয় সব ব্যবস্থা হবে।
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৯: ডায়াবেটিসে কি আলু একদম বন্ধ?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে
আপনার মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগতেই পারে সামান্য একটি শৃগাল যেখানে একটি বৃষকে দেখে ভয় পেল না, সেখানে সিংহের মতো পরাক্রমী একটি প্রাণী কী করে সেই বৃষের শব্দ শুনে বা তার কথা শুনে এতোটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। শুধু তাই নয়, দমনক যাতে তাঁর কাছ থেকে ‘অভয়দানের’ প্রতিশ্রুতিটিও আদায় করে সে কথাও পিঙ্গলক নিশ্চিতক করতে চাইল। উত্তরে বলা যেতে পারে এই পঞ্চতন্ত্রের কাহিনিগুলো যদি আপনি খেয়াল করেন তাহলে আপনি তিন ধরণের প্রাণী দেখতে পাবেন। প্রথম প্রকারের প্রাণীরা হল পুরোপুরি বন্য—সিংহ, ব্যাঘ্র বা কুমীরের মত প্রাণীরা এই শ্রেণীর অন্তর্গত।
দ্বিতীয় প্রকারের মধ্যে আছে গৃহপালিত প্রাণীরা যেমন, গর্দভ, বৃষ, ঘোড়া প্রভৃতি প্রাণীরা; আর তৃতীয় প্রকারের প্রাণীরা হল, শেয়াল, বেজি, বিড়াল প্রভৃতি প্রাণীরা—যাঁরা এমনিতে বন্য কিন্তু মনুষ্য সমাজের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে; তারা বনেও যেমন থাকে আবার নগরপ্রান্তের মনুষ্য সমাজের মধ্যেও তাদের যাতায়াত আছে। ফলে তারা গৃহপালিত পশুদেরও যেমন চেনে, তেমনই বন্যহিংস্র প্রাণীদের সঙ্গেও তাদের যাতায়াত। শেয়াল এমনই এক প্রাণী, যে এমনিতে বন্য কিন্তু নগরে-গ্রামে যাতায়াতের কারণে গৃহপালিত বৃষকেও সে চেনে।
শেয়ালের মতো প্রাণীরা তাই চতুর; কারণ তারা মনুষ্যসমাজ ও বন্যসমাজ উভয় সমাজের কূটনীতিকেই জানে — গল্পে তাই শেয়াল হয়ে যায় পণ্ডিত কিংবা সিংহরাজার মন্ত্রী বা প্রধান পরামর্শদাতা। তাই বৃষের গর্জন শুনে শেয়াল পণ্ডিত দমনক ভয় না পেলেও একেবারে গৃহপালিত পশুদের সঙ্গে পরিচয় নেই যাঁর সেই সিংহরাজ পিঙ্গলক কিন্তু ভয় পেয়ে গিয়েছিল আর চতুর দমনক সেই সুযোগটাই নিয়েছিল। কারণ রাজারা বিপদে পড়লেই মন্ত্রীদের মন্ত্রণা তাঁরা গ্রহণ করেন।—চলবে।