শুক্রবার ২৯ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

হইব না কেন?

উত্তম কুমারকে সারাজীবন যত মানুষ অপমান করেছেন তার তালিকা তৈরি হলে ওঁর রিলিজ হওয়া ছবিগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে।

এ এক ভয়ানক প্রশ্ন এবং পরস্পরবিরোধী বিশ্লেষণ যে, উত্তম কুমারের জীবদ্দশায় সারা গায়ে প্রশংসার ফুল-বেলপাতা চুঁইয়ে পড়তো, যাঁকে দেখার জন্য আমজনতা উন্মাদ হয়ে উঠতেন; তাঁর সম্পর্কে এ ধরনের উক্তি কিছুটা বেমানানই বটে।

কিন্তু আমাদের নির্মমভাবে মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি উত্তম বেঁচে থাকতেন বা তাঁদের সঙ্গেই নিজের অস্তিত্বকে এগিয়ে নিয়ে যেতেন, তাঁর কাজের জগতে, তাঁর পারিবারিক গণ্ডির ভেতরে এবং কাজের জগৎ এবং পারিবারিক লোকেদের মিশ্রিত একটা জগতে, প্রশংসার ঝাড়বাতিতে সলতে পাকানো ভক্তদের মাঝে নয়।

যে সময় উত্তমবাবু কাজ করেছেন বা পারিপার্শ্বিক লোকেদের ভরিয়ে রেখেছিলেন সে সময় থেকে শুরু করে আজও চলচ্চিত্র বা শিল্পের জগতে সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা-সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
উত্তম কুমারের সমগ্র জীবনকে কতগুলি পর্বে ভাগ করা এছাড়া আমাদের কাছে কোনও উপায় নেই। তাঁর সমগ্র সৃষ্টির ফসল একদিকে, আর একদিকে তাঁর ব্যক্তি-সত্তাকে মায় শিল্পী-সত্তাকে কখনও আলাদাভাবে কখনও একে অপরের যুগ্ম-অবস্থানে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। এ ধরনের একটা এলোমেলো সমীকরণের সদুত্তর খুব সহজে যে হবে না তা বলাই বাহুল্য। আমরা প্রথম অবস্থানে যদি দেখি ব্যক্তি উত্তমের বেঁচে থাকার আবর্তন সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তন।

প্রশ্ন উঠতে পারে অরুণ যখন উত্তম কুমার হয়ে ধরা দিলেন বা ধরা পড়লেন তখন থেকে মহানায়ক হয়ে জীবনের ইনিংস শেষ করা পর্যন্ত তিনি একই মানুষ ছিলেন, না অন্য—যা জাগতিক সকলের পক্ষেই স্বাভাবিক?

যে উত্তম কুমারকে একদিন মানসিক সমর্থন থাকে এরকম কাজের জন্য সুযোগ-দাতাদের কখনও সামনে, কখনও পিছনে, কখনও বা পায়ের নিচে ঘুরতে হয়েছে সেই একই শ্রেণি, একটা সময় উত্তম কুমার-এর কখনও সামনে, কখনও পেছনে, কখনও বা পায়ের নীচেও ঘুর ঘুর করেছেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৩: কোন কাননের ফুল ‘শ্যামলী’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত

তাহলে সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে একজন সংগ্রামী মানুষ লড়াইয়ের ময়দানে সবচেয়ে পিছনের অবস্থান থেকে যাত্রা শুরু করে নিজেকে ভাঙতে-ভাঙতে বা গড়তে গড়তে এমন একটা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছেন তখন একটা শ্রেণি চেষ্টা করেছেন তাঁকে থামাতে যিনি তাঁদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। বিফলে নেমে এসেছে অপমানের পরম্পরা।

অতএব ব্যক্তি উত্তম অনেকের মধ্যে একজন ছিলেন। সেখান থেকে তার পারিবারিক সামাজিক পাটিগণিত যখন বদলাতে শুরু করেছে ব্যক্তি উত্তমের সংজ্ঞা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে সভ্যতার নিয়মে যখন তাঁর আর্থিক প্রতিষ্ঠা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা সব বদলাতে শুরু করে।

ছবি: সংগৃহীত।

আসলে শিল্পীর শিল্প-সত্তার বাইরে ব্যক্তি-সত্তা কারও কারও বেশি কারও কারও বা কম। উত্তম কুমারের নামে কি এমন একটা ম্যাজিক হয়ে গিয়েছিল যে, তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর শিল্পীজীবন এবং ব্যক্তিজীবন একটা সময় এক হয়ে যায়। স্রষ্টা শুধুই যখন সৃষ্টির মধ্যে আনন্দ পান, তখন বাহ্যিক স্থূল আনন্দ তার কাছে খুব কৌলিন্যহীন বলে মনে হয়।

উত্তম কুমারে জীবনকে আমরা পুঙ্খ-অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখি না। কারণ তাঁর উপমা তিনি। আমরা সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে পারি সমুদ্রের ঢেউ কেমন, সমুদ্রের গভীরে কী কী রত্ন আছে, সমুদ্রের ওপারে কী আছে। কিন্তু কখনওই আমরা সমুদ্র হয়ে উঠতে পারি না, সম্ভবও নয়। উত্তমবাবু সেরকম একজন ক্ষণজন্মা শিল্পী যাঁর জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই আছে, সাফল্য অপেক্ষা ব্যর্থতার গভীরতা অনেক বেশি আছে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৮: ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২১: পঞ্চমের সুরের মাদকতায় বুঁদ হয়ে আশা গাইলেন সেই তোলপাড় করা গান ‘পিয়া তু আব তো আজা…’

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩৭: মহানায়কের সেই ভুবন ভুলানো হাসি আর সস্নেহ চাহনির কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে

আমরা প্রতিটা সাল ধরে যদি তাঁর ছবির জগতকে আলোচনা করি তাহলে দেখব উনি শুধু প্রথম সাত বছর ব্যর্থ হননি, প্রতি বছর উনি ব্যর্থ হয়েছেন। কখনও ব্যর্থতার পারদ কম, কখনও বা বেশি। কেরিয়ারের শুরুর ব্যর্থতা মেরামতযোগ্য ছিল, কিন্তু শেষের দিকে অবজ্ঞা-অবহেলা-জনিত যে ব্যর্থতা, তা অমেরামতযোগ্য ছিল। যে কারণে মৃত্যু এসে খুব তাড়াতাড়ি সবকিছুর সমাধান করে দিয়েছে।

আমরা যদি কল্পনার হাত ধরে আরও দশ বছর উত্তমবাবুকে জীবিত রাখতে পারতাম রক্ত মাংসের শরীরে, তাহলে দেখতে পেতাম উনি যে ক্ষতবিক্ষত মানসিক গঠন নিয়ে
জীব-জগতকে বিদায় জানিয়েছেন আরও ১০ বছরে ওজোন-স্তরে যেমন ফুটো বেড়েছে সে রকমই ওঁর হৃদয় ভাঙ্গা বাড়তো।

কেরিয়ারের শুরুতে উনি ইন্ডাস্ট্রিতে অবহেলিত হচ্ছেন নামি-দামি তারকাদের পাশাপাশি স্থানাভাবে, আর কেরিয়ার শেষের দিকে উনি অবহেলিত হচ্ছেন অপমানিত হচ্ছেন অনামী, অদেখা, অপরিচিত, স্বল্প অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নবাগত কুশীলবদের তরফ থেকে।

ছবি: সংগৃহীত।

উনি আত্মজীবনীতে এক জায়গায় বলছেন, ”অনেকেই আমার কেরিয়ারের শুরুর দিকের অবস্থানটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ উত্তম কুমার হয়তো ফুরিয়ে গিয়েছেন, তাঁকে আর কোনও কাজে লাগবে না এ ধরনের একটা চিন্তা তাঁদেরকে গ্রাস করেছে। কিন্তু জেনে রাখা ভালো সবাই হয়তো ভাবেন আমি খুব বেশি বুঝতে পারি না। কিন্তু ঈশ্বর আমাকে বোঝার ক্ষমতা একটু বেশিই দিয়েছে বৈকি।”

এ ধরণের উক্তির সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে খ্যাতির মধ্যগগনে থেকে সকলের থেকে অপাংক্তেয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার যন্ত্রণা বড্ড বেশি। অথচ এই ইন্ডাস্ট্রিতে যখন তাঁকে প্রয়োজন হচ্ছে, প্রযোজক পরিচালকেরাই দিনের পর দিন তাঁকেই কাজে লাগিয়ে নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৯: ডায়াবেটিসে কি আলু একদম বন্ধ?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে

অসিত বরণের যে চেহারা ছিল বা বসন্ত চৌধুরীর যে আভিজাত্য ছিল তাতে অনায়াসে ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবির রাজা সূর্যকিশোর রায়চৌধুরী বা ‘স্ত্রী’ ছবির মাধব দত্ত মানিয়ে যেত। তাহলে বৌদ্ধিক-স্বাক্ষর পরিচালক গোষ্ঠীরা, কেন উত্তমবাবুকে নিয়ে কাজ করলেন?

উত্তর একটাই। বসন্ত চৌধুরী বা অসিত বরণের জমিদারের চরিত্র ফোটাতে যে ডেডিকেশন দরকার তার কোনওটাই উত্তমোচিত ছিল না। যে কারণে উত্তমবাবুকে সবার আগে ভাবা হয়েছে।

আবার এই উত্তমবাবুকেই ‘ওগো বধূ সুন্দরী’-তে যখন কাষ্ট করা হচ্ছে, তখন অতি দুঁদে সমালোচকও মনে মনে সমান্তরাল দৃশ্যপট ভেবে যাচ্ছেন এবং একবারের জন্য মনে হচ্ছে না যে উৎপল দত্তকে দিয়েও এ রোল করানো যেত।

ছবি: সংগৃহীত।

উৎপল দত্ত-র চেহারা, চোখের চাউনি এবং অভিনয় ক্ষমতা দিয়ে কোনও অংশে কম যেতেন না গগন সেন-র রোলে। এর উত্তরে বলা যায়, হ্যাঁ। উৎপল দত্তের সেই অভিনয় ক্ষমতা ছিল ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র নায়কের চরিত্রে অভিনয় করার।

কিন্তু কোথায় যেন কী একটা ছিল না, যেটার জন্য উত্তমবাবুকেই ভাবতে বাধ্য হয়েছেন ছবির নির্মাতাদের। এই বাধ্যতামূলক সমীকরণের নামই ”তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?”
প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাওয়া খবরাখবর ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ফ্যাশন, লাইফস্টাইল, সাজগোজ, গল্প, উপন্যাস, বিনোদন, বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়া, দেশ-বিদেশের হালহকিকত প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞের বিশেষ কলম পড়তে চোখ রাখুন সময় আপডেটস-এর পাতার বিভিন্ন বিভাগে। প্রতি ক্লিকেই মন ভালো করা প্রতিবেদন সাজানো রয়েছে। চলতে থাকুন সময়ের সঙ্গে — সময়, অসময়ে, সবসময়ে

Skip to content