ইলিশই হল আমাদের দেশের একমাত্র পরিযায়ী মাছ। ইলিশ নামটির গরিমা এমনই যে, আমাদের আবেগ ও আস্বাদ দুটোই এর সঙ্গে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে থাকে সততই। ফি বছর বর্ষার শুরুতে সমুদ্র থেকে নদীতে এসে ইলিশ ডিম পাড়ে। আবার সেই সমুদ্রেই ফিরে যায়। তবে সঙ্গে সঙ্গে যায় না। বেশ কিছুদিন নদীতে ও তারপরে উপকূলে বা মোহনায় কাটিয়ে তবে সে সমুদ্রের দিকে পাড়ি দেয়।
হুগলি নদীর পথে ডায়মন্ডহারবার, বলাগড়, ফারাক্কা এরকম আরও কয়েকটি জায়গায় ডিম পাড়তে পছন্দ করে ইলিশ। গবেষকরা দেখেছেন, ইলিশের কর্ণগহ্বরে বা কানকোতে থাকা ওটোলিথের ওপর আইসোটোপ বা সংস্থানিক প্রয়োগ করে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জেনেছেন যে, একটি ইলিশ কত দিন মিষ্টি জলে থাকে, আর কত দিন নোনাজলে কাটায়। ওর ঠিক বয়সটি কত ইত্যাদি আরও অনেক বিষয়ে সম্যক ধারণা করা গিয়েছে।
হুগলি নদীর পথে ডায়মন্ডহারবার, বলাগড়, ফারাক্কা এরকম আরও কয়েকটি জায়গায় ডিম পাড়তে পছন্দ করে ইলিশ। গবেষকরা দেখেছেন, ইলিশের কর্ণগহ্বরে বা কানকোতে থাকা ওটোলিথের ওপর আইসোটোপ বা সংস্থানিক প্রয়োগ করে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জেনেছেন যে, একটি ইলিশ কত দিন মিষ্টি জলে থাকে, আর কত দিন নোনাজলে কাটায়। ওর ঠিক বয়সটি কত ইত্যাদি আরও অনেক বিষয়ে সম্যক ধারণা করা গিয়েছে।
মূলত বর্ষার মরশুমে জুলাই থেকে অক্টোবর এবং পরবর্তীকালে আবার ফেব্রুয়ারির কাছাকাছি সময়ে ইলিশ মাছ, নদীতে ডিম পাড়তে চলে আসে। ডিম পাড়ার ঠিক পরেই শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয় সেই ডিম। এর প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পরে জন্ম নেয় ইলিশের ডিমপোনা। এবার তিনদিন কুসুমথলিতে জমানো পুষ্টি উপাদানের আত্তীকরণ শেষে নদীতে প্রাপ্ত বিভিন্ন অনুশৈবাল এবং প্রাণীকণা বিশেষ করে কপিপোড ও রটিফার খেয়ে ক্রমেই ধানি পোনা, চারা পোনাতে রূপান্তরিত হয়।
ক্রমশই ৫-৬ মাসে আরও বেড়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে অর্জন করে লবণ সহনশীলতা। এবার সে মোহনাতে এগিয়ে যায়। ক্রমশ কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে তবে সমুদ্রে পাড়ি দেয়। সেখানে প্রায় দেড় বছর কাটে। আবার সে নদীমুখে যাত্রা করে মিষ্টি জলে ডিম পাড়ার জন্যে। একটি পরিণত ইলিশ ১০ লক্ষ ডিম পাড়তে পারে। আর যদি ধরে নেওয়া যায় এদের বাঁচার হার মাত্র দশ শতাংশ তাহলে একটি ইলিশ থেকে এক লক্ষ ইলিশের পোনা পাওয়া সম্ভব।
ক্রমশই ৫-৬ মাসে আরও বেড়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে অর্জন করে লবণ সহনশীলতা। এবার সে মোহনাতে এগিয়ে যায়। ক্রমশ কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে তবে সমুদ্রে পাড়ি দেয়। সেখানে প্রায় দেড় বছর কাটে। আবার সে নদীমুখে যাত্রা করে মিষ্টি জলে ডিম পাড়ার জন্যে। একটি পরিণত ইলিশ ১০ লক্ষ ডিম পাড়তে পারে। আর যদি ধরে নেওয়া যায় এদের বাঁচার হার মাত্র দশ শতাংশ তাহলে একটি ইলিশ থেকে এক লক্ষ ইলিশের পোনা পাওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৪: বাড়ির চৌবাচ্চায় মাছ চাষ করে পরিবারের নিত্যদিনের মাছের চাহিদা সহজেই পূরণ করা সম্ভব
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২০: অহল্যার শাপমুক্তি ও কিছু প্রশ্ন
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৯: ডায়াবেটিসে কি আলু একদম বন্ধ?
আমাদের মৎস্য দপ্তর এই বংশগতি প্রক্রিয়াকে সুনিশ্চিত করবার জন্য প্রতিবছর সেপ্টেম্বর অক্টোবরে উপকূল অঞ্চলে নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে। সফলভাবে যদি এই নিয়মের প্রয়োগ করা যায় তাহলে ইলিশ পেতে আমাদের আর ভাবনা থাকে না। কিন্তু সমুদ্রে যাওয়ার আগে অনেক সময় জালবন্দি করে ফেলা হয় ইলিশ। সরু ফাঁসের জাল পেতে দেদার ধরা হয় ওই অপরিণত ইলিশগুলোকে। ক্রমশই ইলিশের যোগান কমে যাওয়ার এটি একটি অন্যতম কারণ। কেবল নজরদারি আর সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করেও আমরা অবস্থার একটু হলেও উন্নতি করতে পারি হয়তো।
ইলিশের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরও অনেক কারণ আছে। যেমন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রে জলস্তর বেড়ে যাওয়ায় নদীতে নোনা জলের অনুপ্রবেশ বাড়ে। এর ফলে এই মাছের জীবনচক্র ব্যাহত হয়। আসলে, যতক্ষণ না ইলিশ মিষ্টি জলে আসতে পারছে ততক্ষণ তার সেই অবিস্মরণীয় স্বাদ ঠিক পাওয়া যায় না। ইলিশ যখন ছুটে আসে নদীপথে তখন কিছু খায় না। ফলে শরীরের জমা ফ্যাট ভেঙ্গে সাঁতরানোর শক্তি পায়। সেই সঙ্গে ওমেগা-থ্রি দীর্ঘশৃংখল ফ্যাটি অ্যাসিড পড়ে থাকে এবং তা তখনও পর্যাপ্ত পরিমাণে থেকে যায়। পরে সেই স্বাদ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-২: রাজাদের স্থাপত্য-কীর্তি ও রাজধানী
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩৭: মহানায়কের সেই ভুবন ভুলানো হাসি আর সস্নেহ চাহনির কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে
এই সঞ্চিত ফ্যাট ভেঙে ইলিশের স্বাদ এত বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। আইসিএআর-এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিফা, কল্যাণী এবং রহড়ার সেন্টার ইলিশের কৃত্রিম প্রজননের কাজে সফল হয়েছে। স্বাভাবিক প্রজননের সময় পরিণত পুরুষ এবং স্ত্রী ইলিশ নদীর থেকে সংগ্রহ করে, নদীবক্ষেই নৌকার উপরে নিষিক্ত করে, ল্যাবে ডিম পোনা তৈরি করে। সেই ডিম পোনাকে রটিফার জাতীয় প্রাণীকণা খাইয়ে মিষ্টি জলের পুকুরে, সুন্দরভাবে বাড়িয়ে তুলতে পেরেছেন মৎস্যবিজ্ঞানীরা। এই ইলিশের বৃদ্ধির হার হয়তো তুলনামূলকভাবে কম। বছরে ১০০ থেকে দেড়শ গ্রাম বলা যেতে পারে। দু’ বছরে ৫০০ গ্রাম হয় এর ওজন। তাহলে এই কাজটিও যে করা গিয়েছে সেটি একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা, যা কিছুদিন আগেও অসম্ভব মনে হত।
অনেকে প্রশ্ন করেন, এই পুকুরে বেড়ে ওঠা ইলিশ কি স্বাদে প্রাকৃতিক ইলিশের মতো আদৌ হবে? সেটা আগামী দিনে হয়তো সঠিক ভাবে জানা যাবে। কিন্তু দীর্ঘকাল আমাদের অনেকেরই ধারণা ছিল নদী থেকে ইলিশকে তোলার সঙ্গে সঙ্গে ইলিশ মারা যায়। কারণ জ্যান্ত ইলিশ আমরা হয়তো অনেকেই চোখে দেখিনি। পুকুরে বেড়ে উঠলেও এবং ডিম এলেও প্রজনন করানো যাচ্ছে না এদের। প্রজননের জন্য প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা ইলিশের প্রয়োজন বিশেষভাবে আছে। এখন ইলিশের গতিবিধির পথকে প্রসারিত করবার জন্য ‘ফিস পাস’ তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যারেজগুলিতে। এর ফলে ইলিশ সমুদ্র থেকে নদীপথে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারে। আগে যেমন এলাহাবাদ পর্যন্ত ইলিশ পাওয়া যেত। তখন অবশ্য ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি হয়নি বা ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি হলেও ‘ফিস পাস’ তখন ছিল না।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫২: আঁধার ঘনালো বুঝি সীতার ভুবনে…
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৪: রাজনীতিতে নিজের উন্নতি করতে গেলে দেবগুরু বৃহস্পতির মতো মানুষের উপরেও বিশ্বাস করা অনুচিত
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৮: ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার
সুতরাং এখন ইলিশ আসতে পারবে শুধু নজর রাখতে হবে যে, খোকা খুকি ইলিশকে কেউ যেন ধরে যেন না নেয়। আমাদের ক্রেতাদের মধ্যেও যদি এই বোধ আসে যে ওই ছোটমাছকে আমরা কিনবোনা তাহলেও কিন্তু কিছুটা এর প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমাদের পড়শী দেশ, বাংলাদেশ খুব কঠিন ভাবে এই দিকটি দেখছে। নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ ধরার কোনও উপায় থাকছে না। যাঁরা যখন তখন ইলিশ ধরতেন তাঁদের অনেককেই বিকল্প কাজেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আর এ ভাবেই শুধু ইলিশ রপ্তানির মাধ্যমে দেশের আয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
আশা করব, আগামী দিনে আমাদেরও ইলিশের প্রাচুর্য থাকবে এবং এই ইলিশ থেকে আমাদেরও পর্যাপ্ত আয়ও বাড়বে। দেশের জিডিপিতেও ইলিশ অবদান রাখতে পারবে। সেই সঙ্গে রসনা তৃপ্তির জন্য আপামর বাঙালির অযথা প্রচুর অর্থব্যয় করতে হবে না শুধুমাত্র একটি ইলিশ কিনার জন্যে।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।