সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মলাশয় বা রেকটাম এবং মলদ্বার বা পায়ুর শিরাগুলিতে ফোলা, ব্যথা ও কখনও কখনও রক্তপাত হওয়ার ঘটনা ঘটলে তাকে আমরা সাধারণত অর্শ বা পাইলস বলে থাকি। এটি একটি অত্যন্ত কষ্টকর, ভীতিকারক ও বিরক্তিকর সমস্যা। সারা পৃথিবীতে এই সমস্যায় শতকরা প্রায় ৫ জন লোক ভোগেন। আবার শতকরা ২০ থেকে ৩০ জন মানুষের এই রোগে ভোগার সম্ভাবনা থেকে যায় সব সময়। যুবক থেকে প্রৌঢ় অবস্থায় অর্থাৎ ২০ থেকে ৫০ বছর বয়স্ক লোকেদের মধ্যে প্রায় শতকরা ৫০ জন মানুষই কখনও না কখনও এই অর্শের কষ্টের সম্মুখীন হয়ে থাকেন।

সাধারণভাবে পুরুষের চেয়ে মহিলারা একটু বেশি এই রোগে আক্রান্ত হন। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে এই রোগে মলদ্বার বা বায়ুর রক্তবাহী শিরা সমূহ তার স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে ফেলে। ওই শিথিলতাপ্রাপ্ত শিরাগুলি যখন নিচের দিকে নেমে আসে, সে সময় প্রচণ্ড স্পর্শকাতর হয়ে যায় জায়গাটি। যখন শক্ত পায়খানা বা কুন্থন বেগ হয় তখন ওই শিরা সমূহ বেদনা কাতর হয়ে ওঠে ও গ্রন্থির মতো আকার পায়। আবার কখনও কখনও ফেটে গিয়ে ওই শিরাগুলি থেকে তাজা রক্ত বেরিয়ে আসে। অনেক কারণের জন্যই এই অর্শ রোগ হয়। যেমন মলাশয় বা রেকটামের নিম্নভাগের রক্তবাহী শিরাগুলিতে যদি রক্তচাপ বেশি হয়, পায়খানা করার সময় যদি বেশি কুন্থন দেখা যায়, অনেকক্ষণ বসে থেকে মলত্যাগের জন্য চাপ দেওয়া হয়, দীর্ঘস্থায়ী আমাশার জন্য, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়েরিয়া হয়, মোটা বা মেদ বহুল মানুষের ক্ষেত্রে, গর্ভিণী মায়েদের ক্ষেত্রে, যাদের পায়ুর মাধ্যমে সেক্স উপভোগের অভ্যাস থাকে, যাঁরা শাকসব্জি কম খান বা খাদ্যতন্তু কম নেন, যারা বেশি ভারী জিনিস তোলেন তাঁদের এমনটা হতে পারে।
 

রোগের সাধারণ লক্ষণ

মলদ্বারে ব্যথা, পায়খানা করার সময় কষ্ট ও বিশেষ ধরনের অস্বস্তি, বসে থাকা অবস্থায় ও পায়ু প্রদেশে অস্বস্তি, পায়খানার রাস্তায় প্রচণ্ড চুলকানির অনুভব, কখনও রক্তপাত আবার কখনও রক্তপাত ছাড়াই ব্যথা, বেদনা, ফোলা ও কষ্টকর অস্বস্তির অনুভূতি। সাধারণত আধুনিক বিজ্ঞানে রোগের ভয়াবহতা অনুধাবন করানোর জন্য তিনটি ডিগ্রিতে এই রোগের অবস্থানকে সূচিত করা হয়েছে।

● প্রথম ডিগ্রি: পাইলসের রক্তপাত হলেও মলদ্বারের বাইরে শিরা গ্রন্থিগুলি বেরিয়ে আসে না।

● দ্বিতীয় ডিগ্রি: কুন্থন বা চাপ দেওয়ার সময় বা মলত্যাগের সময় শিরা গ্রন্থিগুলি বাইরে বেরিয়ে আসে অথচ পুনরায় তারা আপসে ই স্বস্থানে ফিরেও যায়।

● তৃতীয় ডিগ্রি: ক্ষেত্রে শিরা গ্রন্থি মলত্যাগের চাপের ফলে বাইরে বেরিয়ে আসে তারপর নিজে থেকে স্বস্থানে ফেরে না, তাকে চাপ দিয়ে মলাশয়ের দিকে ঢোকানো হয়।

আধুনিক বিজ্ঞানে প্রথম ডিগ্রিতে কিছু চিকিৎসার বিধান থাকলেও তা তেমন ফলপ্রসু হয় না। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ডিগ্রির পাইলসের ক্ষেত্রে অপারেশন করার বিধান দেওয়া হয়। যদিও তা প্রায়শই অসফল প্রতিপন্ন হয়। তাই দেখা যাক অর্শ বা পাইলসের সম্বন্ধে আয়ুর্বেদ কী বলছে।

অর্শ রোগের আক্ষরিক অর্থ হল ‘অরিবৎ প্রাণান শৃনাতি ইতি অর্শঃ’। অর্থাৎ যা শত্রুর মতো রোগীর প্রাণের সংকট আনে তাহাই অর্শ। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, এই রোগকে আয়ুর্বেদ দুঃশ্চিকিৎস্য ও মারাত্মক বলে বর্ণনা করেছে। শুধু তাই নয় এই রোগে পাঁচ প্রকার বায়ু (প্রাণ, অপান, সমান উদান ও ব্যান), পাঁচ প্রকার পিত্ত (পাচক, সাধক, রঞ্জক, আলোচক ও ভাজক) এবং পাঁচ প্রকার কফ (ক্লেদক, রসক, অবলম্বক, শ্লেষ্মক ও তর্পক) সব গুলিই বিকৃত হয়। সেই সঙ্গে আমাদের মলাশয় ও পায়ুর মধ্যে অবস্থিত সংবরণী, বিসর্জনী ও প্রবাহনী নামক বলি তিনটি ও দূষিত হয়ে এই রোগ উৎপন্ন হয়।এ তে মাংসাংকুর সদৃশ্ গ্রন্থি পায়ু থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে সাথে কখনও রক্তপাত ঘটায় আবার কখনও রক্তপাত ছাড়াই প্রবল ব্যথা, বেদনা, ফোলা, মলদ্বারে কাঁটা কাঁটা বোধ-সহ প্রবল অস্বস্তিতে রোগী পীড়িত হয়। সুতরাং বায়ু, পিত্ত ও কফ এই তিন দোষেরই প্রকোপ ঘটাতে পারে এমন আহার (খাদ্যাভ্যাস), বিহার (কাজকর্ম) এবং আচার (আচরণ) হল রোগ সৃষ্টির মূল কারণ।

আরও পড়ুন:

উদরি বা জলোদর রোগের মতো ভয়ংকর রোগেও আয়ুর্বেদে সফল চিকিৎসা রয়েছে, জানতেন?

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: রোজের খাদ্যতালিকায় তেঁতুল নেই! এ সব জানলে এমন ভুল আর নয়

 

রোগের নিদান

অতিগুরুপাক খাবার যেমন পায়েস, কড়াপাক সন্দেশ, অতিচর্বিযুক্ত বা তৈলাক্ত খাবার, অতি শীতল পানীয়, অভিষ্যন্দজনক খাবার, যেমন দই, সংযোগ বিরুদ্ধ আহার যেমন মাংস ও পায়েশ একসঙ্গে খাওয়া, দই মাছ মাংস ডিম ইত্যাদি একসঙ্গে খাওয়া, অত্যধিক মশলাদার খাবার, মদ্যপান,পূর্বাহারের অপরিপক্ক অবস্থায় পুনরায় খাওয়া, খাদ্য খাবারের সময় না মানা, অত্যধিক রতিক্রিয়া করা, বেশি উপোস দেওয়া, অত্যধিক পরিশ্রম, ভারী জিনিস তোলা, গদিতে বসা, অত্যধিক শোক রাগ ক্ষোভ ইত্যাদিতে থাকা, দুপুরে ঘুম, রাত জাগা, একদম পরিশ্রম না করা, শরীরের ওজন বেড়ে চলা ইত্যাদি কারণে বায়ু, পিত্ত ও কফ প্রকুপিত হয়ে মলাশয় ও মলদ্বারে স্থানসংশ্রয় করে ও রক্তকে প্রকুপিত করে। সেই সঙ্গে মাংসের ন্যায় কঠিন অঙ্কুর বা গাঁঠের মতো অবয়ব তৈরি করে অর্শ তৈরি করে।
 

অর্শের প্রকারভেদ

অর্শ সাধারণত দুই প্রকার। এক, সহজ অর্শ, যা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে পায়ু প্রদেশে বিকৃতি উৎপন্ন করে থাকে। দুই, জন্মোত্তর কালজ অর্থাৎ জন্মের পর মিথ্যা আহার, বিহার ও আচরণ থেকে জন্মায়। এই জন্মোত্তর কালজ অর্শ সাধারণত দোষের আধিক্য অনুযায়ী ছয় প্রকার হয়। যথা: বাতজ, পিত্তজ, কফজ, দ্বন্দজ, সান্নিপাতজ এবং রক্তজ অর্শ। আচার্য্য চরক ও বাগভট্ট অর্শকে আবার বিশেষ দু’ ভাগে ভাগ করেছেন। আর্দ্র অর্শ এবং শুষ্ক অর্শ।
 

অর্শের সাধারণ উপসর্গ

মলদ্বারে শূল বা ব্যথা, জ্বালা বা দাহ বোধ, মলত্যাগকালীন রক্তপাত হওয়া (কখনও রক্তপাত নাও হতে পারে), কোষ্ঠকাঠিন্যতা, কখনও কখনও মলের অতিসরণ, পেটে ফাঁপ ধরা ,পেটে অস্বস্তিবোধ, অরুচি, মলত্যাগে ভয় বোধ, দুর্বলতা,মলদ্বারে কর্ত্তনবৎ (কাটার মত পীড়া বা পায়খানার রাস্তায় কামড়ে ধরার মতো বোধ), তৃষ্ণা, মূর্ছা ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২০: পঞ্চমের সুর আর কিশোর-আশার অনবদ্য উপস্থাপনা, ‘এক ম্যায় অউর এক তু’ গানটি আজও সুপারহিট

অজানার সন্ধানে: এক লিটার পেট্রলে গাড়ি ছুটবে ১০০ কিমি! যুগান্তকারী যন্ত্র আবিষ্কার করেও রহস্যজনক ভাবে উধাও হন বিজ্ঞানী ওগলে

 

অর্শের চিকিৎসা

আয়ুর্বেদে সাধারণত চার রকম ভাবে চিকিৎসা করার কথা বলা হয়েছে।
● এক: ভেষজ (যেখানে দোষের আধিক্যতা কম এবং উপদ্রব নেই।)
● দুই: ক্ষারকর্ম (যেখানে অর্শে অল্প উপদ্রব উপস্থিত হয়েছে এবং রোগ ক্রমশ জটিলতার দিকে যাচ্ছে বোঝা যায়।)
● তিন: অগ্নিকর্ম (যেখানে কর্কশ কঠিন অর্শের বলি দেখা যায়, বায়ু ও কফ দোষের আধিক্য থাকে।)
● চার: শস্ত্রকর্ম (যেখানে দোষের আধিক্য বেশি, কষ্টও বেশি) ।

আয়ুর্বেদে অগ্নি-কর্ম, ক্ষারকর্ম ও শস্ত্রকর্ম ছাড়াও অত্যন্ত ফলপ্রদ কিছু চিকিৎসা রয়েছে। যেমন: সংশোধন চিকিৎসা। অর্থাৎ শরীরের দোষগুলোকে বাইরে বের করে (ডিটক্সিফিকেশন) দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যেমন: বমন, বিবেচন, আস্থাপন বা অনুবাসন বস্তি এবং পিচ্ছা বস্তি।
 

সংশমন চিকিৎসা

যেখানে ঔষধি খাইয়ে বা তেল বা মলম ইত্যাদি লাগিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
 

চূর্ণ ঔষধি

যেমন: বিজয় চূর্ণ, সমশর্কর চূর্ণ, ধাতুরাদি চূর্ণ এইগুলির যেকোনও একটি ৩ থেকে ৬ গ্রাম দেওয়া যায় গরম জল-সহ।
 

বটি ঔষধ

যেমন: পঞ্চানন বটি, জাতিফলাদি বটি, শিলা গন্ধক বটি, চন্দ্রপ্রভা বটি ২৫০ মিলিগ্রাম করে দিনে দু’ বার ইষদুষ্ণ গরম জল-সহ দেওয়া হয়।
 

ক্বাথ বা পাচন

চন্দনাদিক্বাথ, ফলত্রিকাদি পাচন ২০ মিলি লিটার করে দিনে দু’ বার সমপরিমাণ জল-সহ দেওয়া যায়।
 

আসব বা অরিষ্ট

দন্তারিষ্ট, অভয়ারিষ্ট, দ্রাক্ষাসব, ফলারিষ্ট ইত্যাদির মধ্যে যেকোনও একটি ২০ মিলিলিটার করে দিনে দু’ বার সমপরিমাণ জল-সহ খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

রসৌষধি

অর্শকুঠার রস, অষ্টাঙ্গ রস যেকোনও একটি ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার গরম জল-সহ দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

ঘৃত ঔষধি

যেমন: চব্যাদি ঘৃত, নাগরাদ্য ঘৃত ১০ মিলিলিটার থেকে ২০ মিলি লিটার দিনে দু’বার দেওয়া যায়।
 

লেপনের জন্য তেল

যেমন: পিপ্পলাদ্য তৈল, জাত্যাদি তৈল ইত্যাদি মলত্যাগের আগে ও পরে মলদ্বারে লাগালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

পাক বা অবলেহো ঔষধ

যেমন: দশমূল গুড়, ১০ থেকে ২০ গ্রাম দিনে একবার বা দু’ বার দেওয়া যায়।
 

মোদক ঔষধ

যেমন: সুরণ মোদক, কৃষ্ণ তিলাদি যোগ ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার ঘোল-সহ খেতে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫: সুন্দরবন নামরহস্য

 

পথ্য

শালিতন্ডুলের অন্ন, গম, অড়হর ডাল, আমলকি, মুগডালের স্যুপ, ঘি, লাউ, পটল, পালংশাক, ওল, সবুজ শাক, সৈন্ধব লবণ, পেঁপে, ঘোল, শসা, আমাদা।
 

অপথ্য

গুরুপাক খাবার, তেল ঝাল মশলাদার খাবার, ভাজাভুজি, আচার, গরম মশলা, কন্দশাক, অতিভোজন, অজীর্ণে ভোজন, চর্বিযুক্ত মাংস ইত্যাদি।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content