শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


আলফ্রেড হিচকক।

ক্যামেরার প্যান শটে চোখের সামনে গড়ে ওঠে এক মস্ত শহর। ফিনিক্স, অ্যারিজোনা। শুক্রবার, তারিখ ১১ ডিসেম্বর, সময় দুপুর ২টো বেজে ৪৩ মিনিট। সংবাদ প্রতিবেদনের কায়দায় শুরু হয় ছবি। সংবাদ প্রতিবেদনেরই ছাপ বজায় রেখে ক্যামেরা যেন বিষয়ের খোঁজে উদ্দেশ্যহীন হয়ে ঘুরে বেড়ায় নানান বহুতলের আশপাশ দিয়ে এবং হঠাৎ ডলি শটের মাধ্যমে ঢুকে পড়ে একটি জানলা দিয়ে দুই বন্ধুর এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তের সাক্ষী হতে। শুরু হয় অ্যালফ্রেড হিচককের ১৯৬০ সালের বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) ছবি ‘সাইকো’। আমরাও দর্শক হিসেবে জড়িয়ে পড়ি ম্যারিয়ান ক্রেন (জ্যানেট লে) ও স্যাম লুমিস (জন গ্যাভিন)- এর হতাশার গল্পে। টাকা নেই তাই বিয়ে সম্ভব নয়—এই হতাশা নিয়ে ম্যারিয়ান ফেরে তার কর্মক্ষেত্রে। সে এক অফিসে সেক্রেটারির চাকরি করে। তার বস ঠিক সেই দিনই তাকে দায়িত্ব দেন চল্লিশ হাজার ডলার ব্যাঙ্কে রেখে আসার।

ম্যারিয়ান টাকা চুরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। চল্লিশ হাজার ডলার নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে স্যামের বাসস্থানের উদ্দেশ্যে। ফেয়ারভেলে। তবে ফেয়ারভেল তার পৌঁছনো হয় না। তার আগেই সে মারা যায়। প্রবল বৃষ্টির জেরে ম্যারিয়ান আশ্রয় নেয় এক মোটেলে —বেটস মোটেল। রাতে সেই মোটেলের স্নানঘরে খুন হয় ম্যারিয়ান। খুনি বেটস মোটেলের মালিক নর্মান বেট্স (অ্যানটনি পার্কিন্স)। নর্মান শুধু ম্যারিয়ানের হত্যাকারী নয়। সে তার নিজের মা নর্মা বেটসকেও বহু বছর আগে খুন করে তার দেহ যত্ন করে সংরক্ষণ করেছে মোটেলের ঠিক পাশে তাদের বাড়িতে।

অ্যালফ্রেড হিচককের এই ছবি ‘সাইকো’-র উপর আস্থা ছিল না প্রায় কারও। চলচ্চিত্র সমালোচকদের মতে ছবির পটভূমি অতি তুচ্ছ। প্যারামাউন্টের দ্বিধা ছিল ছবি অসফল হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে। ‘হেজ কোড’ কর্তৃপক্ষ আপত্তি করে ছবিতে খোলাখুলি যৌনতা ও নগ্নতার দৃশ্য নিয়ে। হিচকক তাও সিদ্ধান্ত নেন তিনি এই ছবি করবেন। প্যারামাউন্টের এই ছবিতে রাখা হয় চল্লিশ শতাংশ অংশীদারি। বাকি ঝুঁকি হিচককের নিজের। মাত্র ৪২ দিনে খুব স্বল্প বাজেটে নিজের টেলিভিসনের সহকর্মীদের নিয়ে হিচকক তৈরি করেন নিজের সাদা কালো মাস্টারপিস ‘সাইকো’।
‘সাইকো’ পনেরো মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে বাণিজ্যিক সাফল্যের তুঙ্গে ওঠে। হিচকক হয়ে যান হলিউডের প্রথম সারির ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। ‘সাইকো’ হলিউডে সৃষ্টি করে চলচ্চিত্রের এক নতুন ধারা—‘স্ল্যাশার’। স্নানঘরে একটি মেয়ের নগ্ন দেহে অসংখ্য বার ছুড়ির আঘাতের দৃশ্য পরবর্তী দিনে হয়ে ওঠে অতি পরিচিত। হিচককের ‘শাওয়ার সিন’ বারংবার পুনর্নির্মিত হয়ে চলে বহু চলচ্চিত্রপরিচালকের ছবিতে। নারীর নগ্নতা ও তার দেহের উপর চলা হিংস্রতা যা পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু নয়, জন্ম দেয় এই ‘স্ল্যাশার’ ধারার। যার সাফল্য রক্ত ও চামড়া নির্ভরশীল। তবে হিচককের তৈরি করা এই বিভৎস ‘কিল-সিন’ থেকে যায় অননুকরণীয়।

এই খুনের দৃশ্য ৪৫ সেকেন্ডের। কিন্তু এই ৪৫ সেকেন্ডের ফুটেজের জন্যে শুটিং চলে টানা এক সপ্তাহ এবং কাজে লাগানো হয় ৭০টি ক্যামেরা। ম্যারিয়ানের হাত, কাঁধ ও মাথার সঙ্গে জোড়া হয় অন্য এক সদৃশ ব্যক্তির দেহ। গোটা দৃশ্যায়নই মন্তাজ-ভিত্তিক। ছোট ছোট ফিল্ম ক্লিপ দিয়ে তৈরি হয় এই ভয়ংকর দৃশ্য।

ছবিতে ম্যারিয়ান ও দর্শক কেউই প্রস্তুত নয় এই আচমকা অযৌক্তিক নৃশংসতার জন্য। স্নানঘরে ম্যারিয়ান স্নান শুরু করে। তার সারা দিনের ক্লান্তি আনন্দে পরিণত হয়। চুরি করা টাকা সে পরের দিনই ফেরত দিয়ে দেবে। এই সিদ্ধান্ত আর শাওয়ারের জল যেন তার সমস্ত দুশ্চিন্তা ও পাপবোধ ধুয়ে দেয়। আমরাও ম্যারিয়ানের সাথে যোগ দেই এই নিশ্চিন্ত হওয়ার আশ্বাসে।

ঠিক সেই সময় স্নানঘরের দরজা আস্তে আস্তে খুলে যায়। শাওয়ারের পর্দায় এসে পড়ে এক ছায়া। পর্দা সরতেই শুরু হয় ম্যারিয়ানের শরীরে ছুড়ির আঘাত। খুব দ্রুত একের পর এক ক্যামেরার কাট যেন তাল মেলায় ছুড়ির আক্রমণের সঙ্গে। এক মুহূর্তে দেখা যায় ম্যারিয়ানের নিজেকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা আর তার পরেই দেখা যায় খুনির হাতিয়ারের নেমে আসা ম্যারিয়ানের দিকে। অবিশ্রা্ন্ত ক্যামেরার দ্রুত কাট, ম্যারিয়ানের চিৎকার যা ঢাকা পড়ে বার্নার্ড হারমানের তীক্ষ্ণ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে, শাওয়ারের জল যা আবছা করে চারিদিক, আর এক অচেনা খুনির হিংস্র আক্রমণ।
আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৫: হিচককের লন্ডন, হিচককের সিরিয়াল কিলার

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪২: আশা-ভরসার ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক’

দর্শক হয়ে পরে ম্যারিয়ানের মতোই বিহ্বল অসহায় ও বেদনাক্লিষ্ট। ছুড়ির অবি‌শ্রান্ত আঘাত ম্যারিয়ানের মৃত্যুর কারণ ঠিকই তবে এই দৃশ্যে ম্যারিয়ানের চামড়ায় ছুরির ছোঁয়া দেখানো হয় কেবল এক বারই। তাও সেটি এতোই দ্রুত ঘটে যে দর্শকের চোখেই পড়ে না অনেক সময়। রক্ত দেখানো হয় ঠিকই তবে তা সাদা-কালোর আভরণে ঢাকা। ম্যারিয়ানের চিৎকার আমরা শুনতে পাই ঠিকই। তবে সেই চিৎকার ক্ষীণ হয়ে যায় বার্নার্ড হার্মানের খরশান গ্লিসান্ডোতে।

হিচকক খুন আসলে ঘটায় দর্শকের মস্তিষ্কে। আমাদের কল্পনার জগতে ছুড়ি ক্ষতবিক্ষত করে ম্যারিয়ানের দেহ। আমরা একইসঙ্গে পাই লজ্জা ও ভয়। ড্রেনের মুখ, ম্যারিয়ানের ছড়ানো পা, শাওয়ার হেড, ম্যারিয়ানের স্থির মৃত দৃষ্টি পর পর ক্লোজ শটে সাজিয়ে তুলে ধরা হয় দর্শকের সামনে। নিস্তব্ধ এক মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে ক্যামেরা ঘুরে বেড়ায়। নিজেকে সরায় না অনেকক্ষণ।

দর্শককে বাধ্য করে একটি ধবধবে বাথরুমের দিকে তাকিয়ে থাকতে যেখানে প্রাণের কোনও চিহ্ন নেই। হিচকক পরিকল্পিত ভাবেই নগ্ন মৃতদেহ ফেলে রাখেন আমাদের সামনে। কিন্তু সেই দৃশ্যে অশ্লীলতার লেশ মাত্র নেই। ম্যারিয়ানের নগ্নতাকে গ্রাস করে বিষাদ। এখানেই ‘সাইকো’ আর পরবর্তীকালের ‘স্ল্যাশার’ ছবির পার্থক্য।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৯: পঞ্চমের সুরে লতার গাওয়া ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’ গান শুনে শুনেই প্রস্তুতি শুরু করেন কিশোর

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫: আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী?

এরপর শুরু হয় দর্শকের অস্বস্তি। এতক্ষণ সে ছবিটি দেখেন ম্যারিয়ানের চোখ দিয়ে। ম্যারিয়ানের স্যামের কাছে পৌঁছনোর যাত্রাতে হিচকক মূলত আই-লাইন ম্যাচিং শট ব্যবহার করেন। ম্যারিয়ান তার দ্বিধা, ভয়, রাগ সবই ভাগ করে নেয় দর্শকের সঙ্গে। দর্শকও অভ্যস্ত হয়ে ওঠে ম্যারিয়ানের দৃষ্টি দিয়ে গল্পটি উপভোগ করায়। এই মূল চরিত্রের আকস্মিক মৃত্যুতে দর্শক হারায় তার ছবির গল্পের সূত্রধর। ক্যামেরার মতো সেও এদিক ওদিক খুঁজে বেড়ায় কোন এক খুঁটি যার আশ্রয়ে সে বাকি ছবিটি বুঝবে। দৃশ্যে প্রবেশ করে নর্মান বেটস। ম্যারিয়ানের মৃতদেহ দেখে সে স্তম্ভিত, কাতর। দর্শক সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যায় তার খুঁটি নর্মান বেটস।

তবে দর্শকের মন আবার অস্থির হয় যখন ক্রমশ বোঝা যায় যে খুনি আসলে নর্মান। নর্মান একজন ট্যাক্সিডার্মিস্ট। তার মোটেলের দেয়ালে ও টেবিলে অসংখ্য মৃত পাখি সংরক্ষণ করা। নর্মানের পাখি সংরক্ষণের নেশা। নিজের মাকেও সে তার অদ্ভুত সংগ্রসহশালার এক অংশ করে রাখে। তার মা তার কাছে আজীবন থাকবে এই আকাঙ্ক্ষায় সে মাকে হত্যা করে ও তারপর তাকে বাঁচিয়ে রাখে তার বিকৃত মস্তিষ্কে। সে নিজেই কখনও কখনও হয়ে ওঠে তার মা। এবং যে কোনও সুন্দরী যুবতীর প্রতি আকৃষ্ট হলেই তার মায়ের সত্ত্বা জেগে ওঠে। নৃসংস ভাবে হত্যা করে সেই হতভাগী কিছু-না-বুঝে-উঠতে-পারা মেয়েটিকে। ম্যারিয়ানের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪: সুন্দরবনের লবণ-বৃত্তান্ত

ছবির শেষের দিকে আমরা মুখোমুখি হই সেই দুর্ধর্ষ হত্যাকারী বৃদ্ধা মৃতা মায়ের। ম্যারিয়ানের খোঁজ করতে আসা তার বোন লাইলা (ভেরা মাইলস) নর্মানের বাড়িতে ঢোকে তার মায়ের সন্ধানে। মায়ের ঘর, বিছানা, আয়না, আলমারি দেখতে দেখতে সে পৌঁছে যায় বেটস অট্টালিকার পাতালঘরে। সেই ঘরে পেছন ঘুরে চেয়ারে বসা নর্মানের মা।

লাইলা চেয়ারটা ঘুরিয়ে সম্মুখীন হয় তার জীবনের সবচেয়ে বিভৎস দুঃস্বপ্নের। এক কঙ্কালসার মূর্তি। পরিপাটি চুলের খোপা, পরিষ্কার পোশাক পরা এক মৃতদেহ। যার ফাঁকা চোখের কোটরের ক্লোজ শটের পরই আর একটি ক্লোজ শটে দেখা যায় লাইলার ভয়ার্ত জ্যান্ত মুখ। লাইলার আর্তনাদ ও নর্মানের পেছন থেকে ছুটে এসে চিৎকার মিলিয়ে যায় বার্নার্ড হারমানের স্ট্রিং বোয়ের প্রখরতায়। বেসমেন্টের দোদুল্যমান বাল্ব দেখায় মায়ের শূন্য দৃষ্টি, লাইলার মুখ ফেরানো, আর নর্মানের ছুড়ি নিয়ে লাইলার দিকে এগিয়ে আসা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২: মেয়েটি যেন গৃহলক্ষ্মী

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২২: কেস কালাদেও: ফাইল নম্বর ১

শেষ রক্ষা হয় স্যামের মধ্যস্থতায়। লাইলাকে আঘাত করার আগেই নর্মান ধরা পরে যায় স্যামের কাছে। ছবির শেষ দৃশ্যের পূর্ববর্তী দৃশ্যে নর্মানকে জেলে দেখানো হয়। তার সত্ত্বাকে এতদিনে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে তার মায়ের সত্ত্বা। তার মা প্রথম বার কথা বলে সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। বলে এই সমস্ত খুনের জন্যে দায়ী তার ছেলে। সে নয়। এই সহজ সরল সত্যিটা অবশ্য জটিল হয়ে ওঠে যখন ক্যামেরার ডিজলভ শটে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় নর্মানের মুখ আর ভেসে ওঠে তার মায়ের হাড়-সর্বস্ব মৃত মুখ।

শটটি শেষ হয় অসম্পূর্ণ এক তারল্যে। মা আর ছেলে, মৃত্যু ও জীবন, ভালোবাসা ও ঘৃণা আর আলাদা করা যায় না। সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আর দর্শক এই প্রশ্ন নিয়ে বাড়ি ফেরে যে, নর্মান আসলে কে? নর্মান বেটস? নাকি তার মা? পুরুষের দেহে নারী? নাকি নারীর দেহে পুরুষ? নাকি দুই-ই?—চলবে।
* ড. সুবর্ণা মণ্ডল (Subarna Mondal), অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content