শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


নসফেরাতু। ছবি: সংগৃহীত।

জড়বস্তুর মধ্যে প্রাণ খোঁজা জার্মান অভিব্যক্তিবাদীদের অভ্যেস। তাদের চলচ্চিত্রে, সাহিত্যে ও ছবিতে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট যেন নারকীয় অতিস্বরে জড়ানো—যেমন গুস্তাভ মেরিঙ্কের প্রাহা’র ঘেটো (গোলেম, ১৯২০) বা অ্যালফ্রেড কুবিনের তৈরি দুঃস্বপ্নের শহর ‘দ্য ড্রিম রেল্ম’, (দ্য আদার সাইড, ১৯০৮)। এদের সবারই নিজস্ব প্রাণশক্তি আছে। তারা দিনের বেলায় গুটিয়ে থেকে কিছু হতোদ্যম মানুষের চলাফেরার সুবিধে করে দেয় ঠিকই। কিন্তু সন্ধ্যার কুয়াশার সঙ্গে তারা আবার ফিরিয়ে নেয় নিজেদের দখল করা স্থান। দরজা জানলা ঘরবাড়ি গিলে নেয় সেই উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরাফেরা করা শরীরগুলোকে।

ফ্রেডেরিক উইলহেল্ম মারনোর (১৮৮৮-১৯৩১) চলচ্চিত্রেও আমরা পাই সেই একই প্রবণতা। জড়বস্তুর প্রাণসঞ্চার ও প্রাণ সন্ধান। সমুদ্রে এগিয়ে চলেছে নাবিকদের মৃতদেহ বোঝাই ভুতুড়ে এক জাহাজ। ঠিক তার পরের শটে দুলে চলেছে এক মৃত নাবিকের ফাঁকা হ্যামক। মারনোর নসফেরাতু (১৯২২) এরকম বহু অপার্থিব দৃশ্যে সমৃদ্ধ। ব্র্যাম স্টোকারের গথিক উপন্যাস ড্রাকুলা (১৮৯৭) মারনোর নসফেরাতুর অনুপ্রেরণা। এই ছবি হয়ে ওঠে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট চলচ্চিত্রের এক অন্যতম দৃষ্টান্ত।

ট্রানসিলভেনিয়ার সম্ভ্রান্ত বংশীয় কাউন্ট ড্রাকুলা মধ্যযুগ থেকে হামলা চালাচ্ছে দূরদূরান্তের সভ্য দেশের মানুষের উপর। তাদের রক্তই তার প্রাণশক্তির উৎস। মারনোর জগতে এই অভিজাত ভ্যামপায়ার পরিণত হয় এক কঙ্কালসার রক্তশোষক পিশাচে। তার শরীর মানুষ এবং পশুর উদ্ভট মিলনস্থল। তার কান বাঁদুরের কানের মতো তীক্ষ্ণ। তার নখ শকুনের নখের মতো ছুঁচলো। তার চোখ ড্যাবড্যাব করে গিলে খায় তার চারপাশ। জন্ম হয় চলচ্চিত্র জগতের প্রতথম ড্রাকুলার। মারনোর ভ্যামপায়ার হয়ে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফল—রুগ্ন, জীর্ণ, ক্ষুধার্ত মড়কের দূত।
সাহিত্যের ও চলচ্চিত্রের অতিপরিচিত এক চরিত্র ভ্যামপায়ার—যে বার বার দর্শক বা পাঠককে তার শরীরের অশুচি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দেয়। যুগ যুগ ধরে আমরা অশুচিতার ভার চাপিয়ে এসেছি এই চরিত্রটির উপরে। মাইকেল বেল ‘ফুড ফর দ্য ডেড’ (২০০১) লেখাটিতে জানান সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি যে কোনও অতিমারীর সময় ভ্যামপায়ার তাড়ানোর আচার অনুষ্ঠান বেড়ে যেত। প্লেগ, কলেরা, যক্ষ্মা কোনও কিছুতেই তার নিস্তার নেই। সাহিত্যে তাই দেখা পাওয়া যায় পলিডরির ভ্যামপায়ারের (১৮১৯), লে ফ্যানুর কার্মিলার (১৮৭১) আর স্টোকারের ড্রাকুলার (১৮৯৭)।

মারনো বেছে নিয়েছেন এক বেমানান শরীর, যা পশু ও মানুষের জৈবিক আকারের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। এই শরীর শুধু জৈবিক ভাবে ভিন্ন নয়। সামাজিক দিক থেকেও কোণঠাসা। কাউন্ট ওরলকের সঙ্গে মড়কের সম্পর্ক—গোটা ছবি জুড়ে থাকা কীটপতঙ্গ ও জীবাণু, মৃত নাবিকদের জাহাজ, জাহাজময় ইঁদুরের ছেয়ে থাকা, দেশে প্লেগের আতঙ্ক, হাটারের গলায় মশার কামড়ের মত ছোট ছোট ক্ষতচিহ্ন—একটি সরলরেখা টানে রোগ ও অশুচিতা থেকে কোনও এক বিশেষ ধরনের শরীর পর্যন্ত। যে শরীর ভিন্ন ও অপরিচিত। রোগবাহক। অনৈতিক। নোংরা।
আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৩: চলচ্চিত্রের চিওরুসকিউরো: গ্রিফিথ ও রবার্ট ওয়াইন

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৭: লতা-কিশোর-পঞ্চম-গুলজারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কই শিকওয়া নেহি’

বিচিত্রের বৈচিত্র: মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

স্টোকারের ড্রাকুলায় লন্ডন প্রায়শই কুয়াশায় ঢাকা। কুয়াশা মানেই ঘোলা অচল অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আর এই অস্বাস্থ্যকর কুয়াশার মধ্যে দিয়েই ড্রাকুলার আগমন। ড্রাকুলার প্রাসাদ ধুলোময় অপরিষ্কার। তার কফিন থেকে বাসি গন্ধ বেরোয়। মারনোর ওরলকও স্টোকারের ড্রাকুলার মতো দূষিত।

মারনোর নসফেরাতুর বেশিরভাগটাই লোকেশন শুটিং, যা এক্সপ্রেশনিসমের এক চেনা বৈশিষ্ট্য। স্বল্প বাজেটও লোকেশন শুটিংয়ের আরেকটি কারণ। মারনো তাই আশ্রয় নেন প্রকৃতির। অ্যাংলো-স্যাক্সন কবিতার মতো নসফেরাতুর প্রকৃতি একই সঙ্গে ভয়ংকর ও অপূর্ব। সমুদ্রের অস্থির ঢেউয়ের মিডিয়াম শট ও ক্লোজ শট, অন্ধকার বিশাল সব পাহাড়, জঙ্গল, ঘাসের দমকা হাওয়ায় দুলে ওঠা, মেঘের আনাগোনা—সব অশনি সংকেতের ভয় সৃষ্টি করে। নসফেরাতুর ভৌতিক গলির কোনও তৈরি করা চিওরোসকিউরোর শৈলী লাগে না।

মারনোর তত্ত্বাবধানে ফ্রিটজ আর্নো ওয়াগনারের ক্যামেরা একটা হাই অ্যাঙ্গেল শটে তুলে ধরেন এক সরু দীর্ঘ গলি যার দু’ ধারে ইটের সারি সারি দমবন্ধ করা বাড়ি। ক্যামেরার মাঝামাঝি থেকে যায় যে জানলা দিয়ে শট তোলা হচ্ছে তারই লোহার শিক। একটি শটে কোনও রকম বাহ্যিক প্রযুক্তির সাহায্য না নিয়ে এমন রোধের যন্ত্রণার অভিব্যক্তি বিরল।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৪: এ শুধু অলস মায়া?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪০: সে এক স্বর্গপুরীর ‘চিরকুমার সভা’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২: চলমান সুন্দরবন

রবার্ট ওয়াইনের ‘দ্য কেবিনেট অফ ডক্টর ক্যালিগারি’তে (১৯২০) অ্যাবসার্ডিটি বা ভয়ের উদ্রেক করার উপায় ছিল কোনও এক ব্যক্তি বা বস্তুকে বাঁকা ভাবে দেখানো বা আবছা করে দেওয়া। মারনোর ভয়ের জীব কিন্তু ক্যামেরার দিকে এগিয়ে আসে। গিলে নেয় গোটা স্ক্রিন স্পেস। যেমন সেই মারণ জাহাজ সমুদ্রের ঢেউ ঠেলে যখন বন্দরে ঢোকে বা একটা লো-অ্যাঙ্গেল শটে তোলা ওরলকের ছায়া যেটা আস্তে আস্তে জাহাজ ছেড়ে এগিয়ে যায় তার শিকারের দিকে। তার দীর্ঘ দেহ গ্রাস করে গোটা পর্দা। যেন স্ক্রিন ছেড়ে বেরিয়ে আসবে আমাদের কাছে। ঢুকে পরবে আমাদের শরীরে তার সমস্ত রোগ, জঞ্জাল ও জ্বালা নিয়ে।

মারনোর নসফেরাতু জন্ম দেয় দুটি ভিন্ন সিনেমাটিক ভ্যামপায়ার প্রথার। একটিতে ভ্যামপায়ার কুৎসিত ও ঘৃণ্য। আরেকটিতে সে ভয়াবহ কিন্তু আকর্ষণীয়। নসফেরাতুর মুক্তি পাওয়ার ঠিক নয় বছর পর আসে টড ব্রাউনিংয়ের ড্রাকুলা (১৯৩১)। এই ছবিতে আমরা ড্রাকুলার চরিত্রে পাই বেলা লুগোসিকে। টড ব্রাউনিংয়ের ভ্যামপায়ার, বেলা লুগোসি, ওরলক বা কাউন্ট ড্রাকুলা কারও মতো নয়। লুগোসি শিকারকে সম্মোহন করে নিজের শারীরিক সৌন্দর্য দিয়ে। আর মারনোর সেই ক্ষুধার্ত রুগ্ন রক্তচোষা পরজীবীকে আমরা আবার দেখতে পাই বহু বছর পর, ১৯৭৯ সালে, জার্মান পরিচালক ওয়ার্নার হার্জগের ছবি নসফেরাতু: ফ্যান্টম অফ দ্য নাইটে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৬: মাছের তেল হার্ট অ্যাটাক আটকায়?

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩: ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২০: জীবন্ত লাশ?

১৯২২ সাল থেকে এই রক্তচোষা রহস্যময় অ-মৃত চরিত্রকে নিয়ে তৈরি হয়েছে পাঁচশোর উপর চলচ্চিত্র। ওয়ার্নার হার্জগের পর ১৯৮৮ সালে আসে ‘নসফেরাতু ইন ভেনিস’। ২০০০ সালের ‘শ্যাডো অফ দ্য ভ্যামপায়ার’-এর শুটিং হয় মারনোর সেই ১৯২২-এর নসফেরাতুর সেটে। তার মানে এই মেটা রিমেকটি বানানো ও দেখা হচ্ছে প্রায় ১০০ বছর পরে।

তবে এই কুৎসিত ড্যাবড্যাবে তীক্ষ্ণদন্ত একাকী ভ্যামপায়ার নসফেরাতুর শেষ দৃশ্যের মতো আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে সুদর্শন বাফি দ্য ভ্যামপায়ার স্লেয়ার (১৯৯৭-২০০৩), টোয়াইলাইট (২০০৮-২০১২) এবং ট্রু ব্লাড (২০০৮-২০১৪)-এর মোলায়েম সস্নিগ্ধ, জ্যান্ত-মানুষের-রক্ত-না-খেতে-চাওয়া ভ্যামপায়ারদের দীপ্তিতে।—চলবে।
* ড. সুবর্ণা মণ্ডল (Subarna Mondal), অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content