সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

কিছুদিন আগেই লীলা দুবের লেখা পড়ছিলাম। এদিকে, চারিদিকে আষাঢ় মাসের সূচনা নিয়ে উৎসবের আয়োজন হচ্ছে। লোকজন কদমফুল ফোটা নিয়ে আনন্দ করছেন। সেই সব ছবি ফেসবুকেও দিচ্ছেন। সেই ছবি দেখে ভাবছি কদমফুল থেকে নতুন গাছের চারা তৈরি হয় কি করে। সেই সময় কাকতালীয় ভাবে লীলা দুবের ‘সিড অ্যান্ড আর্থ’ অর্থাৎ বীজ আর পৃথিবী বা মাটির কথা বলা বইয়ের পাতাটি সামনে উঠে এল। আর তখন আমার বাগানে গাছের ঝুলন্ত কাঁঠাল দেখে অম্বুবাচী আসছে সেটাও মনে হল। এত কিছু মনে হওয়ার গুঁত এত সাঙ্ঘাতিক যে, আমি এবারের লেখাতে এই সব কিছু নিয়ে বসেছি আর পাকা কাঁঠালের আমসত্ত্ব হয় না কেন বলে মাথা চুলকাচ্ছি। মানে আর কিছুই না ভিতরের বিপ্লবী সত্ত্বা থেকে থেকে উঠে আসছে না না প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন, মাটির উর্বরতা এবং নারীর উর্বরতা উভয়কেই শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাহলে কি এই শক্তিকেই ভক্তি থেকে দমনের ইচ্ছে জেগেছে? দ্বিতীয়ত, স্ত্রী রজস্বলা বিষয়টিকে অপবিত্র মনে করার কারণের মধ্যে লুকিয়ে আছে কি সেই নির্দিষ্ট সময়কালকে নির্ণয় করা, যখন নারীরা তৈরি নয় গর্ভ সঞ্চারের জন্য?

আমরা যদি লীলা দুবের কথা দিয়ে আজকের আলোচনা শুরু করি, তাহলে মানুষ কীভাবে নারীর উৎপাদন শক্তিকে ব্যবহার করেছে তার একটা আন্দাজ করতে পারি। লীলা দুবে নারীকে পৃথিবী বা মাটির সঙ্গে তুলনা করেছেন, আর পুরুষকে বীজের সঙ্গে। প্রাথমিক ভাবে দেখলে বিষয়টি মনে হবে মাটির ভূমিকা পৃথিবীতে অভয় মিশ্রিত আশ্রয় দাত্রী। আমরা মাটিতে দেখেছি বীজ পড়ে গাছ হতে। সেই গাছ মাটি থেকেই প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করে বড় হয়ে ওঠে। ক্রমে সেই গাছ বড় হয়ে ফুল এবং ফল দেয় পরের প্রজন্ম তৈরি করার জন্য। সেই বীজ আবার মাটিতেই আশ্রয় খোঁজে নতুন পাতা আর মজবুত শিকড় তৈরির রসদ জোগাড় করার জন্য।
মানুষের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি, পুরুষ নারী শরীরের মধ্যে প্রজননের উদ্দেশ্যে বীজ বা শুক্রাণু প্রবেশের জন্য সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। আর নারীদের নিষ্ক্রিয় প্রাপক হিসেবে দেখা হয়। নারীদের মনে করা হয় তারা তাদের গর্ভ পুরুষদের ব্যবহার করতে দেবে, যেমন মাটির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। তারপর যেমন কৃষক বীজ বপন করার পর ছেড়ে দেয় মাটিতে লালিত পালিত হতে। আবার নারীরাই শ্রম দিয়ে মাটিতে লাগান ফসলের দেখভাল করে। কিন্তু ফসল প্রস্তুত হওয়ার পর তাতে কোনও অধিকার থাকে না। তেমন মানব শিশুর জন্মের পর লাপন পালন করার নৈতিক দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয় মায়ের উপর। পিতার সন্তানের উপর যে অধিকার থাকে অর্থাৎ সন্তান পিতৃ পরিচয় নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে, কিন্তু মায়ের পরিচয় সেখানে গৌণ। যারা আইভিএফ কিংবা ‘অ্যাসিস্টেড রিপ্রডাক্টিভ টেকনলজি’র সাহায্যে সন্তান চাইছেন তাদের ক্ষেত্রেও স্বামীর সই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্বামী যদি সেই সন্তানের আইনগত অধিকার না দেন তাহলে সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ কি হবে? মায়ের উপর সন্তানের আইনি অধিকার দিতে এখনও সমাজের বুক কাঁপে। সমাজ বিমিশ্রতায় অর্থাৎ সমাজ ব্যাভিচারে ভরে যাক তা চায় না কখনও।

আইনি অধিকারের সঙ্গে সমাজ আর একটি বিষয়কে চিরস্থায়ী করে রাখতে চায়, সেটি হল পুরুষ প্রাথমিক উৎপাদক আর নারী হল গৌণ বা সহায়ক এজেন্ট। এই শ্রমবিভাজন সমাজে বজায় রাখতে পারলেই প্রমাণ হবে পুরুষ সক্রিয় এবং শক্তিশালী আর নারীরা নিষ্ক্রিয়, অধস্তনও। এই রূপকটি লিঙ্গ বৈষম্যকে স্বাভাবিক করে তোলে এই পরামর্শ দিয়ে যে, এই সব ভূমিকা জীববিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক বিশ্বে নিহিত।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৪: সতী ও অসতী মাঝে পিতৃতন্ত্র

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৯: পথের প্রান্তে রয়ে গিয়েছে সে হাজার তারার ‘লক্ষহীরা’

পরবর্তীকালে এই বীজবপন আর গর্ভ ব্যবহার করতে দেওয়ার বিষয়টির মধ্যে অর্থনীতি এবং ক্ষমতা বা রাজনীতির ভূমিকা অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর তখন নারী পুরুষের মধ্যেকার ক্রিয়া হয়ে ওঠে পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার কেন্দ্র এবং ক্ষেত্র। ক্ষমতার কেন্দ্রে নারীকে নিয়ে এসে নারীকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় প্রমাণ করার জন্য তার যৌনতা এবং প্রজননে সহায়তাকারী অঙ্গগুলির উপর সরাসরি আক্রমণ করা শুরু হয়। নারীদেরকেই বস্তুতে পরিণত করে দেওয়া হয়।

উৎপাদিত সম্পদ এবং তার বণ্টন করার সময় নারী যদি সন্তান উৎপাদন করতে না চায় কিংবা বিবাহবন্ধনকে উপেক্ষা করে তখন কি হবে? কী হবে এই প্রশ্নের মধ্যেই থাকে আমাদের পরিচয়ের প্রথম ধাপ, আর তা হল পরিবার বা আত্মীয়তার সম্পর্ক বা রক্তের সম্পর্ক। এই রক্তের সম্পর্ক অনেক সময়েই আমাদের স্মৃতিতে থেকে যায় বা স্মৃতি থেকেই বলি। বিয়ের সময় বা কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমাদের পাঁচ প্রজন্মের কথা স্মরণ করতে হয়। তাই সেই পরিচয়ের মূল যেখানে রক্তের সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে সেখানে নারী পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলা হয়েছে। সেই জটিলতা বেড়েছে যখন নারীর কৌমার্য ভঙ্গের রক্ত নিয়ে উল্লাস অনেকটাই অন্য ভাবে দেখা হচ্ছে স্ত্রীর রজস্বলার রক্ত শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি, ধর্মবৃক্ষ বা বোধিবৃক্ষ অশ্বত্থ

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৬: ‘ও হানসিনি, মেরি হানসিনি কাঁহা উড় চলি’—কিশোর-পঞ্চম ম্যাজিক চলছেই

স্ত্রী রজস্বলার সময় কেন শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে আর তার মধ্যে একটি তারিখ থাকে। অর্থাৎ প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়। এই ভাবনার আলোচনার মধ্যে লুকিয়ে আছে অম্বুবাচী থেকে স্ত্রী রজস্বলার মধ্যে থাকা সেই সব সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয় যা শুধুই শারীরিক নয়।

অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে তাদের প্রজননের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। সেই সময় সেই মেয়ে প্রাণী পুরুষ প্রাণীদের সঙ্কেত দিতে থাকেন। এই সব প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায় যৌন কার্যকলাপকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ভাবে তাদের বিবর্তন হয়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে তা হয়নি। তারা প্রজনন করার লক্ষ্য ছাড়াই সহবাসে নিযুক্ত হতে পারে। এমনকি মানুষ মধ্যে যৌন কার্যকলাপকে নির্দিষ্ট সময়ে সীমাবদ্ধ রাখতেও পারে না। সেই রকম শারীরিক ব্যবস্থা তাদের শরীরে গড়ে ওঠেনি। তার বদলে নারীর শরীর থেকে নির্দিষ্ট সময়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। এই বেরিয়ে আসার মধ্যে দিয়ে একটি সুস্পষ্ট ‘না’ এর বার্তা দেখা দিচ্ছে।

এই ‘না’ জানিয়ে দেয় এই সময় নারী কোনও ভাবেই গর্ভ ধারণে সক্ষম নয়। কিন্তু এই ‘না’ সময় তৈরি হয়েছে যখন নারী বড় গোষ্ঠীর মধ্যে অনেক মহিলার সঙ্গে থাকা শুরু করে। অনেক ধরনের কাজের ভাগা ভাগি করে করার প্রবণতা বাড়ে। সেই সময় বাহু নারী নিজেদের মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়া শুরু হয়, কে কীভাবে যৌন সম্পর্কে যোগদান করবে। এই ভাবে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে ওঠে। যার ফলে শরীর প্রজননের জন্য তৈরি হলেও নির্দিষ্ট সময়ে প্রজনন না হলে রক্ত আকারে বেরিয়ে আসে। সমাজের কাছে এই ভাবে নারীর প্রজননের নির্দিষ্ট সময় পরিষ্কার নয়। তাই পিতৃ পরিচয় স্পষ্ট করে বলাও সম্ভব হয় না। তাই উপায় হিসেবে নারীর শরীর এবং তার যৌনতাকেই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে যায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজ।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩: গায়ে আমার পুলক লাগে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১৩: কবির ঘড়ি

অম্বুবাচি তাই একটি সামাজিক নির্মাণ। এই নির্মাণের মধ্যে একটি বিষয় পরিষ্কার করে দেখানো হয়েছে নারীর শরীরের উর্বরতার যে বিষয়গুলো অপরিষ্কার সেগুলি এই সময় সব অপবিত্র ভাবেই দেখতে হবে। মন্দিরের দরজাও বন্ধ থাকবে। এই স্ত্রী রজস্বলার বিষয়টি অপবিত্র, সে তিনি দেবী হন বা সাধারণ নারী। প্রথাগত র ধারণার সঙ্গে কৃষিকাজের যে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে পারি সেটা হল, দীর্ঘ গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহে মাটির জল শূন্য হয়ে যায়। রুক্ষ মাটিতে হাল চালানো যায় না। তাই বর্ষার বৃষ্টিতে মাটি নরম হওয়া অব্ধি অপেক্ষা করাই সভ্যতা। অপেক্ষার পর মাটি কর্ষণ করে তবেই ফসল বপন করা শুরু করা উচিত। আর নারীদের নিজেদের মন এবং শরীর তৈরি করে শুধু নয়, স্ত্রী রজস্বলার বিষয়টিকে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বিধির মধ্যে নিয়ে আসার জন্য লড়াই করতে হবে। যতদিন বিজ্ঞাপনে নীল তরল আর নিচু সুরে, চোখ নামিয়ে কথা বলা হবে ততদিন অপবিত্র হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

ঋণ স্বীকার:
https://eportfolios.roehampton.ac.uk/anthroehampton/2022/01/10/being-human-the-anthropology-of-menstruation/
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content