শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

গত সপ্তাহে আমরা জেনেছিলাম, জাতির কল্যাণে জাতীয় বৃক্ষ অর্থাৎ বট গাছের অমৃত কথা। এই সপ্তাহে আপনাদের শোনাবো একই গোত্রভুক্ত (Moraceae) আরও একটি গাছ অর্থাৎ অশ্বত্থ গাছের কথা। ঋগ্বেদ থেকে শুরু করে অথর্ববেদে অশ্বত্থ গাছের কোন ধর্মগত স্থান না থাকলেও জানা যায় যে, এই গাছের রোগ নিরাময়ে ভূমিকা আছে।

ভারতের ইতিহাসে বৈদিক সংস্কৃতির পরপরই আসে বৌদ্ধ সংস্কৃতি এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির হাত ধরে আসে স্মার্ত বা পৌরাণিক যুগ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অশ্বত্থ গাছ হল অতি পবিত্র একটি গাছ অর্থাৎ ‘বোধিবৃক্ষ’। বৌদ্ধমতে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের বোধিগয়াতে এই বৃক্ষের তলায় জ্ঞানচক্ষুর উন্মোচন ঘটেছিল অর্থাৎ তিনি সিদ্ধিলাভ করে গৌতম বুদ্ধে পরিণত হয়েছিলেন। তাই এই গাছকে জ্ঞানবৃক্ষও বলা হয়।

চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনায় এই বৃক্ষের উল্লেখ পাওয়া যায়। স্মার্ত সংস্কার অনুযায়ী অশ্বত্থগাছকে পুজোর বিধান দেওয়া হয়েছে পুরোহিত তন্ত্রে। অশ্বত্থস্তোত্র অনুযায়ী, এই গাছের মূলে ব্রহ্মার অধিষ্ঠান, গুঁড়িতে থাকেন পালনকর্তা বিষ্ণু এবং গাছের পাতায় অধিষ্ঠান করছেন দেবাদিদেব মহাদেব। গুজরাত রাজ্যে অশ্বত্থগাছকে ব্রাহ্মণ রূপে কল্পনা করা হয় এবং মনে করা হয় এই বৃক্ষ হত্যা, ব্রাহ্মণ হত্যার ন্যায় পাপের কাজ। লৌকিক বিশ্বাস অনুযায়ী ব্রহ্মা পলাশ বৃক্ষ রূপে, রুদ্র ডুমুর বৃক্ষ রূপে এবং বিষ্ণু অশ্বত্থবৃক্ষরূপে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করেন। তাই অশ্বত্থ বৃক্ষের নীচে বসে ব্রাহ্মণরা প্রার্থনা করেন।

তবে মতান্তরে অশ্বত্থ বৃক্ষের স্পর্শ নাকি অমঙ্গলের প্রতীক। পদ্মপুরাণের ১৬১ নম্বর অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে এই গাছে অলক্ষ্মীর আভাস আছে। চিল ,শকুন ও কাক জাতীয় পাখিরা রাত্রে এই গাছে আশ্রয় নেয় এবং এই গাছের তলায় রাতে থাকলে নাকি প্রাণহানি হতে পারে। কোন কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে এমনও বিশ্বাস আছে যে সকল মৃত আত্মা পরলোকে জল পায় না, এই অশ্বত্থ গাছ সেই জলদানের একটি পথ হিসেবে কাজ করে। এই কারণে শ্রাবণ, কার্তিক এবং চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের চতুর্দশ তিথিতে এই গাছের মূলে জল দান করার রীতি আজও গ্রামাঞ্চলে চলে আসছে। মৃত ব্যক্তির আত্মীয় পরিজনরা এই বিশ্বাসেই অশ্বত্থ গাছের মূলে জল দানের মধ্যে দিয়ে মৃত আত্মার মধ্যে জল সঞ্চারিত করেন। তবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিচার করলে দেখা যায়, অশ্বত্থ গাছে শ্বসনের ফলে প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। এটি ভারী গ্যাস বলে অক্সিজেনের মতো অন্যান্য প্রয়োজনীয় গ্যাসকে সরিয়ে দিয়ে এই গ্যাস নিচের দিকে অত্যাধিক পরিমাণে জমা হতে থাকে। এই কারণবশত রাত্রে এই গাছের নিচে শুয়ে থাকা মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
অশ্বত্থ গাছকে কেন্দ্র করে আদিবাসী লোককথায় এক গল্পকথা আছে। তার সামান্য অংশ আজ পাঠকদের জানাবো। লোককথা অনুযায়ী, মহাপ্রভু এই পৃথিবীতে মানুষ-পশু-পাখি এবং সমস্ত রকম গাছের সৃষ্টি করেন। ধীরে ধীরে মানব জাতি সংখ্যা বাড়তে থাকায় তিনি মানুষের জন্য একটি রাজা এবং রাজপরিষদ তৈরি করে দিলেন। এরপর প্রাণীদের সংখ্যাও দ্রুত হারে বেড়ে যাওয়ায়, মহাপ্রভু তাদের জন্য একজন রাজা এবং রক্ষী নিযুক্ত করলেন। তারপর ধীরে ধীরে জৈবিক নিয়মে বৃক্ষের সংখ্যাও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে লাগলো। তখন গাছেরা হিমগিরি পর্বতের মাথায় সমবেত হয়ে মহাপ্রভুর কাছে অনুরোধ করলেন তাদের রাজ পরিষদ তৈরির জন্য। সেই সময় ঘটনাচক্রে পান্ডুপুত্র ভীম সেই রাস্তাতেই গমন করছিলেন। সবটা শুনে তিনি জানালেন যে তিনি এই সমস্যার সমাধান করে দেবেন। তিনি প্রতিটি বৃক্ষকে ধাক্কা দিলেন এবং ফলস্বরূপ প্রায় প্রতিটি বৃক্ষই ভীমের ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল, শুধু তেঁতুল ,অশ্বথ এবং বটগাছ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

পরীক্ষা শেষে ভীম হিমগিরি পর্বতে এসে মহাপ্রভুকে জানালেন যে তেঁতুল গাছকে রাজা, বটগাছকে মন্ত্রী এবং অশ্বত্থ গাছকে রক্ষী হিসাবে নিযুক্ত করতে হবে। মহাপ্রভুর নির্দেশ মতো তাই হল। মহাপ্রভু অশ্বত্থ গাছকে জানালেন, ঝড় এলে তার আগেই যেন তিনি সকলকে সাবধান করে দেন। এই কারণবশতই হয়তো, অশ্বত্থ গাছের পাতা সামান্য বাতাস দিলেও সব সময় তির তির করে বিচরণ করে।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: জাতির কল্যাণে ‘জাতীয় বৃক্ষ’

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: ফুসফুসের ক্যানসারের প্রাথমিক সনাক্তকরণের জন্য শ্বাস বায়োপসি পরীক্ষার নতুন দিশা

এবার আসা যাক অশ্বথ গাছের বিজ্ঞানসম্মত দিকগুলিতে।
 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: ফিকাস রিলিজিওসা (Focus religiosa).
● বাংলা নাম: অশ্বত্থ।
● গোত্র: মরেসি।
● গাছের প্রকৃতি: অশ্বত্থ গাছ হল বহুবর্ষজীবী, বহু শাখান্বিত, গুপ্তবীজী এবং বৃক্ষ জাতীয় উঁচু উদ্ভিদ। পাতা চকচকে এবং উজ্জ্বল গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়। এই গাছের পাতা সরল একক পত্র এবং জালিকাকার শিরাবিন্যাস বিশিষ্ট। পুষ্পবিন্যাস উদম্বর প্রকৃতির অর্থাৎ ডুমুরের মতোই হয় তাই ফুল বাইরে থেকে দেখা যায় না। একটি গোল আধারের ভেতরে স্ত্রী ফুল, পুরুষ ফুল এবং ক্লীব ফুল থেকে থাকে।
 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

অশ্বত্থ গাছের ছালে খুব বেশি পরিমাণে ট্যানিন উপস্থিত থাকে। পাতায় থাকে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং বিভিন্ন ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড। ফলের মধ্যে থাকে শর্করা, ফ্ল্যাভোনয়েডস এবং বিভিন্ন ধরনের উৎসেচক।

আরও পড়ুন:

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৮: মাথার চুলটা পেছন থেকে এসে মুখটাকে ঢাকা দিয়ে দিয়েছে, মেয়েটি কি লাইনে ঝাঁপাতে চাইছে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে বটগাছের ব্যবহার

 

ক্ষত নিরাময়ে

কোনও ক্ষতস্থান থেকে যদি অনেক পুঁজ বের হয় এবং যন্ত্রনা হয় সেই ক্ষত জায়গায় অশ্বত্থের কচি পাতা চাপা দিয়ে বেঁধে রাখলে ওই পুঁজ পড়া এবং যন্ত্রণা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
 

কান এবং দাঁতের সমস্যা দূরীকরণে

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে কানে পুঁজ ও যন্ত্রণা হলে অশ্বত্থ গাছের পাতার ঠোঙা বানিয়ে তার মধ্যে সরষের তেল রেখে গরম করতে হবে এবং খানিকটা ঠান্ডা হলে ওই তেল একটু করে প্রতিদিন দিলে পুঁজ পড়া কমে যায়। অশ্বত্থ মূলের রস দাঁতের ও মাড়ির রোগ সারাতে সক্ষম।
 

কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে

অশ্বত্থ বীজ শরীর ঠান্ডা রাখে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এই গাছের পাতা এবং কচিমুকুলও কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতে কার্যকারী ভূমিকা নেয়।
 

ডায়াবেটিস প্রতিরোধে

অশ্বত্থ গাছের ছালে প্রচুর পরিমাণে ট্যানিন উপস্থিত থাকে এবং এই গাছের ছাল নিঃসৃত ট্যানিন কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে।
 

অণুজীবি ধ্বংস করতে

অশ্বত্থ গাছের ছালের মধ্যে উপস্থিত রাসায়নিক পদার্থ ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করে। ছালে উপস্থিত ইথানল নির্যাস প্রোটোজোয়া ধ্বংস করে এবং এটি কৃমিনাশক এবং অ্যান্টিভাইরাস হিসাবেও কাজ করে।
 

স্ত্রীরোগ নিরাময়ে

স্ত্রীদেহে যোনিদ্বারের নিচের দিকে যোনিকন্দ রোগ হয়। এই রোগের ক্ষেত্রে প্রচুর দুর্গন্ধযুক্ত রক্তস্রাব নিঃসরণ হতে থাকে। আয়ুর্বেদ মতানুসারে, অশ্বথ গাছের ছাল এবং পাতা প্রায় কুড়ি থেকে ত্রিশ গ্রাম নিয়ে চার কাপ জলের সঙ্গে সিদ্ধ করতে হবে। ফুলে এক কাপ অবস্থায় এলে ছেঁকে নিয়ে ওই জল দিয়ে বারে বারে রোগগ্রস্ত জায়গা ধুয়ে ফেলতে হবে। এর ফলে ওই রক্তস্রাব অনেকটাই কমে যাবে এবং ক্ষত শুকোতে থাকবে।
 

পুরুষের নানা রোগব্যাধি নিরাময়ে

পুরুষদের ইন্দ্রিয় শৈথিল্যে অশ্বথ গাছের মূল নিঃসৃত রস ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়। এই গাছের ফল এবং বীজ নানান যৌন রোগ নিরাময় ব্যবহৃত হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে, স্বপ্নদোষে অশ্বত্থের পত্রমুকুল চার থেকে পাঁচটি জলের সঙ্গে বেটে একটু চিনি সহযোগে খেলে উপকার পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১: সুন্দরবনের শেকড়ের খোঁজে

চলো যাই ঘুরে আসি: অযোধ্যা— ইতিহাস ও জনশ্রুতি /২

 

শিশুদের মুখের ক্ষত সারাতে

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই মুখের মধ্যে ক্ষত অথবা ঘা দেখতে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে অশ্বত্থ গাছ থেকে পাওয়া শুকনো ছাল মিহি করে গুঁড়ো করে নিতে হবে। তারপর এক চিমটি নিয়ে তার সঙ্গে দুই থেকে চার ফোঁটা মধু মিশিয়ে ক্ষতস্থানে লাগালে ধীরে ধীরে ক্ষত নিরাময় হবে।
 

হাঁপানি নিরাময়ে

শুকনো অশ্বত্থ গাছের ফলের গুঁড়ো জলে ভিজিয়ে রেখে খেলে হাঁপানি রোগ সারে।
 

শরীর ঠান্ডা রাখতে

অশ্বত্থ গাছের পাকা ফল খুবই ঠান্ডা। এটি শরীরের জ্বালা (গা জ্বালা) ভাব নিয়ন্ত্রণ করে। পাতা এবং কচিমূল নানা রকম চর্মরোগ নিরাময় করে ‌।
 

নানারকম অসুখ প্রতিরোধে

অশ্বত্থ গাছের পাতা কোষ্ঠকাঠিন্য, মামস, প্যালপিটেশন, হৃদদৌবল্য এবং মূত্ররোগ নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও এই গাছের বল্কল-নির্যাস আলসার এবং গনেরিয়া রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা নেয়। এর মূল, বাত বা গাউট প্রতিরোধ করে।
 

সাবধানতা

অশ্বত্থ গাছ থেকে ঝরে পড়া বা পাওয়া শুকনো ছাল যতটা উপকারী, কাঁচা ছাল কিন্তু ততটাই ক্ষতিকারক। কখনোই গাছ থেকে নিয়ে আসা কাঁচা ছাল রোদে বা ঘরে শুকিয়ে গুঁড়ো করে রেখে ক্ষতস্থানে লাগানো উচিত নয়। এতে ক্ষতির সম্ভাবনা আরও বেড়ে যেতে পারে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content