শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

হিন্দু পুরাণ মতে বটবৃক্ষকে ত্রিদেবের আশ্রয়স্থল হিসাবে মান দেওয়া হয়েছে। বটের মূলে অধিষ্ঠান করেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, বটবৃক্ষের বল্কলে ভগবান বিষ্ণু অধিষ্ঠান করেন এবং শাখায় দেবাদিদেব মহাদেব আছেন বলে মানুষের বিশ্বাস। আবার অনেকেরই বিশ্বাস আছে ধনসম্পদ এর দেবতা কুবের নাকি এই বৃক্ষেই বাস করেন। তাই যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সংস্কার ও সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়েছে বট বৃক্ষ।

বট গাছকে উর্বরতার প্রতীক হিসাবে পুজো করে আসছেন সন্তান ধারনে ইচ্ছুক নারীরা। মহাভারতে এক পর্বে বর্ণিত আছে যে, এক মা ও তার মেয়ে দুটি আলাদা আলাদা বটবৃক্ষকে আলিঙ্গন করেছিলেন। ফলস্বরূপ তাদের দুই সন্তান হয়েছিলেন, যার মধ্যে একজন ছিলেন খ্যাতনামা ঋষি বিশ্বামিত্র এবং অন্যজন জমদগ্নি। এক লৌকিক উপকথায় আছে এক নিঃসন্তান নারী বটবৃক্ষের পুজো-অর্চনা করে সাতটি পুত্র সন্তানের জননী হয়েছিলেন। পুরাণের সতী সাবিত্রীর কথা প্রায় সকলেরই জানা। বিবাহের এক বছরের মধ্যে সাবিত্রী তাঁর স্বামীকে হারিয়ে ফেলেন। সাবিত্রী বটবিক্ষোকে পুজো করেই অবশেষে তার স্বামীর প্রাণ ফিরে পেলেন। এই কথাকে স্মরণে রেখেই সবধারা বট সাবিত্রী ব্রত পালন করেন। উপবাস করে ওই দিন বট বৃক্ষকে প্রদক্ষিণ করেন। এ সব কারণেই হয়তো ভারতীয় নারীদের মনে বটবৃক্ষ খুবই পবিত্র জায়গা করে নিয়েছে।
 

শুধুই কি উর্বরতার প্রতীক?

না, অমরত্বের প্রতীক হিসাবেও যুগ যুগ ধরে বট বৃক্ষকে স্থান দিয়েছে ভারতীয় পুরাণ। পৃথিবীতে মানুষের জন্ম মুহুর্তে মানবজাতির কল্যাণার্থে দেবতারা মর্তে রক্ষক হিসাবে পাঠান রানি নিরন্তালিকাকে। তিনি একটি পাতায় মুড়ে নিজের সঙ্গে কিছু বট গাছের বীজ পৃথিবীতে নিয়ে আসেন এবং মানব কল্যাণের স্বার্থে সেগুলি রোপন করলেন। আরও একটি আদিবাসী লোককথায় বটগাছকে নিয়ে সুন্দর একটি উপাখ্যান আজ পাঠকদের শোনাবো।

পাতাল বাসিনি সর্পরাজ বাসকীর একটি সুন্দর উদ্যান ছিল এবং সেই উদ্যানের শোভা বর্ধন করত এক বিশাল বট বৃক্ষ। দেবী অম্বা একদিন সেই বৃক্ষের স্বপ্ন দেখে বৃক্ষটিকে পৃথিবীতে আনতে চাইলেন। কিন্তু সে পথ কেউই জানতেন না। তবে সামান্য এক গুবরে পোকার সাহায্যে পাতাল লোকে প্রবেশ করলেন দেবী অম্বা। ঘরতর যুদ্ধের শেষে বাসুকীর আগুনের লেলিহান শিখায় প্রাণ হারালেন অম্বা। ঘটনাচক্রে দেবাদিদেব মহাদেব এবং পার্বতী সেই উদ্যানে ভ্রমণ করছিলেন। অম্বার এরূপ অবস্থা দেখে দেবী পার্বতী স্পর্শকাতর হয়ে পড়লেন। মহাদেবকে বারংবার অনুরোধ করলেন সোমবার প্রাণ ফেরানোর জন্য। মহাদেব অস্বীকার করলে পার্বতী ভীষণ ক্রধানিত হলেন। জানালেন, অম্বা তাঁরই এক অবতার। তাই অম্বা প্রাণ না ফিরে পেলে তিনিও মহাদেবের কাছে ফিরবেন না। দেবী পার্বতীকে বিলীন হতে দেখে অগত্যা মহাদেব নিরুপায় হয়ে অম্বাকে সশরীরে ফিরিয়ে আনলেন। বরদানও করলেন। বরস্বরূপ অম্বা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সহস্র মস্তক বিশিষ্ট সর্পরাজ বাসকীর একটি মস্তক বাকি রেখে বাকিগুলো কর্তন করলেন। এরপর দেবী পার্বতীর আশীর্বাদে অম্বা সেই বটবৃক্ষকে পাতাললোক থেকে ধরাধামে এনে প্রতিষ্ঠা করলেন।

বট গাছ সামাজিক স্তরে এবং চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যবহার হয়ে আসছে সেই রামায়ণ-মহাভারত তথা বৈদিক আমল হতে।

 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: ফিকাস বেঙ্গলেন্সিস।
● বাংলা নাম: বট। [প্রাচীন শাস্ত্রমতে বট শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে বৃত্ত শব্দ থেকে কারণটা হল, বেশ খানিকটা দূর থেকে শাখা-প্রশাখা যুক্ত পুণ্য বটগাছ কে দেখতে অনেকটা বৃত্তের মতো]
● ইংরেজি নাম: বেনিয়ান ট্রি (Banyan Tree), তবে একে ‘ইন্ডিয়ান ফিগ ট্রি’ও বলা হয়।
● গোত্র: মোরেসি।
● গাছের প্রকৃতি: বট গাছ একটি বিশাল আকার বৃক্ষ যা বহু শাখান্বিত, বহুবর্ষজীবী, গুপ্তবীজী এবং দ্বিবীজপত্রী প্রকৃতির হয়ে থাকে। এই গাছের পাতা একক জালকাকার এবং সরল পত্র হয়। পুষ্পবিন্যাস উদম্বর প্রকৃতির হয়ে থাকে। ফুল একটি গোলাকার আধারের ভিতরে থাকে যা দেখা সম্ভব নয়। তিন ধরনেরই ফুল অর্থাৎ পুঃ পুষ্প, স্ত্রীপুষ্প এবং ক্লিব পুষ্প বর্তমান থাকে বটগাছে।
● গাছের বিস্তৃতি: ফিকাস বেঙ্গালেন্সিস, বট গাছে এই প্রজাতির আদি উৎপত্তিস্থল হল এশিয়া মহাদেশ। এশিয়ার অন্তর্গত ভারত মায়ানমার, তাইল্যান্ড, দক্ষিণ চীন এবং মালেশিয়া হল বট গাছের প্রাচীন উৎপত্তিস্থল। সমুদ্র সমতল থেকে মোটামুটি এক হাজার মিটার উচ্চতায় বট গাছের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ সহ ভারতের সর্বত্রই অল্পবিস্তার দেখা যায় বটগাছ।

আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: পদ্মপুরাণ

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২: “যে ‘কেবল’ পালিয়ে বেড়ায়”

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

বট গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে নানান রকমের রাসায়নিক পদার্থ যেমন ফ্লভোনয়েড, গ্লাইকোসাইড, বেঙ্গালেনোসাইড ইত্যাদি পাওয়া যায়। বট গাছের ছালে পাওয়া যায় ২০ টেট্রাট্রাই একোনথ্রিন-২-অন, বিটা সিটোসেরল আলফা ডি গ্লুকোজ, মেসো ইনোসিটল নামক গ্লাইকোসাইডগুলি। বট গাছের পাতায় থাকে ৯.৬৩ শতাংশ প্রোটিন, ২৬.৮৪ শতাংশ ফাইবার, ২.৫৩ শতাংশ ক্যালশিয়াম অক্সাইড এবং ০.৪ শতাংশ ফসফরাস।
এছাড়াও বট গাছের লাটেক্স বা তরুক্ষীরে থাকে অ্যালবুমিন, শর্করা, ম্যালিক অ্যাসিড, বেসিন ইত্যাদি ইত্যাদি রাসায়নিক যৌগ।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৯: যোগ্য বা অযোগ্য—যে মানুষই রাজার আশেপাশে থাকেন, রাজা তারই কথায় ওঠেন-বসেন

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে বটগাছের ব্যবহার

আমাদের সকলেরই জানা, বটগাছ হল ক্লান্ত পথিকের আশ্রয়স্থল। এই গাছ মানুষ-সহ বিভিন্ন প্রাণীদের ছায়া প্রদান করে। এছাড়াও অনেক পাখি এবং কীটের আশ্রয়স্থল হল বটগাছ। এসব ছাড়াও কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রে বটগাছের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার হয়ে আসছে চরক-শুশ্রুত- বানভট্ট এবং আয়ুর্বেদ সংহিতার সময়কাল থেকেই। রোগ প্রতিরোধে বটগাছের বিভিন্ন অংশের ব্যবহারগুলো হল—
 

জীবাণু ধ্বংস করতে

ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক ধ্বংস করার ক্ষেত্রে বটগাছের মূল থেকে নির্গত নির্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যাকটেরিয়াগুলো হল— ব্যাসিলাস সাবটিলিস (Bacillus subtilis), স্টেফাইলোকক্কাস এরিয়াস (Staphylococcus aureus), সিউডোমোনাস (Pseudomonas), এসচেরিয়া কোলাই (E coli), ছত্রাক (Fungus), অ্যাসপারজিলাস নাইগার (Aspergills niger), স্টেফাইলোকক্কাস অ্যারিয়াস (Staphylococcus aureus) ইত্যাদি।
 

শরীরের জ্বালা ভাব কমাতে

অনেকেরই প্রায় সারা বছর ধরে শরীরের বিভিন্ন অংশে জ্বালা এবং অস্বস্তি ভাব থাকে, তাঁরা ৫০ থেকে ৮০ গ্রামের মতো বটের ছাল এক লিটার জলে সিদ্ধ করে চার ভাগের এক ভাগ ছেঁকে জলে মিশিয়ে স্নান করতে পারেন। অথবা ওই সিদ্ধ জল দুই থেকে তিন চামচ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খালি পেটে খেলেও উপকার হবে বলে মানা হয় সুশ্রুত সংহিতায়।
 

বট গাছের কুড়ি (অর্থাৎ ফল বেরোনোর আগের অবস্থায়) আর মসুর ডাল একসঙ্গে সমপরিমাণে বেটে মুখে প্রলেপের মতো লাগালে, মেচেতার দাগ অনেক অংশে নিরাময় হয়। অন্য কোন ধরনের ত্বকের পিগমেন্টেশনের ক্ষেত্রেও এটি লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
 

পায়ের পাতা ফাটা দূর করতে

শীতের শুরুতে বা অনেকেরই সারা বছর পা ফাটার সমস্যা থাকে। তাঁরা ঘুমানোর আগে বটের গাঢ়ো আঠা পায়ের গোড়ালিতে লাগিয়ে সারারাত শুয়ে থাকলে ,সকালে দেখবেন অনেকটাই কমে গিয়েছে।
 

স্ত্রী রোগ নিরাময়ে

সুশ্রুত সংহিতা অনুযায়ী বট গাছ হল বিভিন্ন প্রকার যোনি দোষনাষক এবং এটি প্রদাহ দূর করে।

আরও পড়ুন:

দেখব এবার জগৎটাকে, পর্ব-১২: বেশিক্ষণ থাকলে আরও কী কী হতো কে জানে, মুহূর্তে নৌকা ঘোরাল বনি

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৪: সতী ও অসতী মাঝে পিতৃতন্ত্র

 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে

বট গাছের ছাল থেকে যে রাসায়নিক পদার্থ (বেঙ্গালেনোসাইড) পাওয়া যায় তা রক্তের শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এটি এক ধরনের গ্লাইকোসাইট যেটি ডাইবেটিসের হাইপোগ্লাইসিমিক কাজে সাহায্য করে।
 

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে

বট গাছের মূলে উপস্থিত ফ্ল্যাভোনয়েড কার্যকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে দেহের অ্যালার্জি প্রতিরোধে এবং ট্রেস কমাতেও সাহায্য করে।
 

দাঁতের সমস্যায়

অনেকেরই দাঁতের মাড়ি ফোলা ও ব্যথার সমস্যা থেকে থাকে, সেই সকল ক্ষেত্রে বটের আঠা টুথপেস্টের মতো দাঁতের মাড়িতে লাগিয়ে রাখলে ব্যথা ও ফোলা ভাব অনেকটা কমে যায়।
 

ইমিউনোমডুলেটর হিসাবে

বটবৃক্ষের মূলের নির্যাসে মিথাইল উপস্থিত থাকে যা, ইমিউনোমডুলেটর হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা নেয়।
 

নানাবিধি রোগ নিরাময়ে

প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে, বটগাছের তরুক্ষীর অর্থাৎ ল্যাটেক্স ডায়রিয়া, আমাশয়, অর্শ, রিউমেটিজম বাত, ডাইবেটিস চর্মরোগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এমনকি, বটের ফলের নির্যাস টিউমার প্রতিরোধেও ভূমিকা নেয়।

এই সকল কারণেই হয়তো হিন্দু পরম্পরা অনুযায়ী বটগাছ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের আশ্রয়স্থল হিসাবে যুগ যুগ ধরে পুজো পেয়ে আসছে। তাই অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, বটবৃক্ষের কোনও একটি সামান্য অংশের ভস্ম যদি তেলের সঙ্গে মিশিয়ে অঙ্গে ধারণ করা যায় তবে দেহের সকল পাপের নাকি মুক্তি ঘটে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content