বেদান্ত বলে ব্রহ্মসত্য জগৎ মিথ্যা। কী রকম মিথ্যা? অলীক কল্পনা নয় বা একেবারে যে শূন্য তাও নয়। তবে যা আপাতদৃষ্ট হয়। তা প্রকৃতপক্ষে তা নয়। মিথ্যা প্রতিভাত হয়। কেন আমরা ভুল দেখি? এ প্রশ্নের উত্তর শাস্ত্রে রয়েছে মায়ার কারণে। এ মায়া কার? ঈশ্বরের শক্তি, মায়া। তিনি এ মায়া বিস্তার করেছেন। ঈশ্বর যেমন অনন্ত তার মায়া তেমন অনন্ত তবে সান্ত। তিনি যেমন জাদুকর আর এ জগত তার খেলা। আমরা জীবকুল সে খেলার সঙ্গী। যে মায়া শক্তি আবরণ ও বিক্ষেপ শক্তি দিয়ে আমাদেরকে প্রলভিত করছেন, আমাদেরকে আকর্ষিত করছেন, আর সত্য আমাদের অধুরা হয়ে যাচ্ছে। মায়া যে প্রবল শক্তি, তার প্রভাবে বড় বড় মুনি ঋষিরাও ভ্রমে পতিত হয়েছেন। ব্রহ্মে, মায়া নেই, সেখানে সৃষ্টি নেই, সেখানে শুদ্ধব্রহ্ম প্রকাশ পাচ্ছে মাত্র। কিন্তু যখন তিনি এক ব্রহ্ম থেকে সৃষ্টি শুরু করলেন ঈশ্বর পদবাচ্য হলেন। মায়ার রাজ্যে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়। আর জগতের সব কিছু মায়া শক্তি দিয়ে পরিচালিত করে। তা তার কৃপা ছাড়া মুক্তি নেই।
পরমহংসদেব বলিতেন, “সংসারী মানুষ এই যাহা যা করে সব ঠিক ঠিক কেবল একটি ভুল।” একজন বলিল “সে ভুলটি কি?” তিনি এও বললেন, “অসার ধন-মানের জন্য না করে ভগবানের জন্য যদি তাহার ওইরূপ বিদ্যা বুদ্ধি যত্ন পরিশ্রম ত্যাগ স্বীকার ও কষ্ট সহ্য করত তবেই ঠিক হতো।” পাল্লার যেদিক ভারী হয় সেইদিক নেমে পড়ে। যে দিক হালকা সেদিন উপরে উঠে যায়। তেমনি যার সংসার মান-সংভ্রম টাকা কড়ি নানা ভার সেই নেবে পরে। আর যার কোন ভার নেই সেই উঠে ঈশ্বরের রাজ্যে যায়।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-২১: সকল কাজে সকল ভাবে তাঁর সান্নিধ্য অনুভব করাই প্রকৃত ভক্তের উদ্দেশ্য
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট
বিষয় আসক্ত আমাদের মন কে মলিন করে ঈশ্বর চিন্তা আসতে দেয় না। যে সব থেকে কাছে তাঁকে দূরের মনে হয়, ধরা ছোঁয়ার বাইরে মনে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “যতক্ষণ জল ঘোলা থাকে ততক্ষণ চন্দ্র সূর্যের প্রতিবিম্ব তাতে ঠিক ঠিক দেখা যায় না। মায়া ও তেমনই আমি ও আমার এই জ্ঞান যতক্ষণ না যায় আত্মার সাক্ষাৎকার ততক্ষণ ঠিক ঠিক হয় না।”
মায়া-র প্রবল শক্তি তা বোঝানোর জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ কখন কখন একটা গামছা নিয়ে নিজের সামনে ধরে অন্তরঙ্গদের বলতেন, দেখ আমি এত কাছে আছি অথচ দেখা যাচ্ছে না। তেমন “যে সূর্য পৃথিবীকে আলো করে রেখেছেন সামান্য একখানা মেঘে সেই সূর্যকে যেমন ঢেকে ফেলে তখন সে সূর্য আর দেখা যায় না, তেমনি সর্বশক্তিমান সর্বব্যাপী সচ্চিদানন্দ কে আমরা সামান্য মায়ার আবরণী দেখতে পাচ্ছি না। পানাপুকুরে নেমে যদি পানা কে সরিয়ে দাও। আবার তখনই পানা এসে জোটে। সেইরকম মায়াকে ঠেলে দিলেও আবার মায়া এসে জোটে। তবে যদি পানাকে সরিয়ে দিয়ে বাঁশ বেঁধে দেওয়া যায়, তাহলে আর বাঁশ ঠেলে আসতে পারে না। সেই রকম মায়াকে সরিয়ে দিয়ে জ্ঞান ভক্তির বেড়া দিতে পারলে আর মায়া তার ভেতর আসতে পারে না। সচ্চিদানন্দ কেবলমাত্র প্রকাশ থাকেন।”
মায়া-র প্রবল শক্তি তা বোঝানোর জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ কখন কখন একটা গামছা নিয়ে নিজের সামনে ধরে অন্তরঙ্গদের বলতেন, দেখ আমি এত কাছে আছি অথচ দেখা যাচ্ছে না। তেমন “যে সূর্য পৃথিবীকে আলো করে রেখেছেন সামান্য একখানা মেঘে সেই সূর্যকে যেমন ঢেকে ফেলে তখন সে সূর্য আর দেখা যায় না, তেমনি সর্বশক্তিমান সর্বব্যাপী সচ্চিদানন্দ কে আমরা সামান্য মায়ার আবরণী দেখতে পাচ্ছি না। পানাপুকুরে নেমে যদি পানা কে সরিয়ে দাও। আবার তখনই পানা এসে জোটে। সেইরকম মায়াকে ঠেলে দিলেও আবার মায়া এসে জোটে। তবে যদি পানাকে সরিয়ে দিয়ে বাঁশ বেঁধে দেওয়া যায়, তাহলে আর বাঁশ ঠেলে আসতে পারে না। সেই রকম মায়াকে সরিয়ে দিয়ে জ্ঞান ভক্তির বেড়া দিতে পারলে আর মায়া তার ভেতর আসতে পারে না। সচ্চিদানন্দ কেবলমাত্র প্রকাশ থাকেন।”
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২১: ক্যানসার মানেই মৃত্যু?
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-২০: রায়পুর থেকে রাজিম
মায়া কি দেখা যায়? কোন সময় মহর্ষি নারদ বলেছিলেন, “ঠাকুর তোমার যে ঘটন অঘটন পটিয়সী মায়া তা আমাকে দেখাও।” ঠাকুর বললেন “তথাস্তু।” পরে একদিন নারদকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুর বেড়াতে বেরোলেন, অনেক দূর বেড়াতে বেড়াতে ঠাকুরের পিপাসায় অস্থির হয়ে পড়লেন এবং বললেন, যেখানে পাও একটু জল এনে আমায় বাঁচাও। নারদ তাড়াতাড়ি জলের চেষ্টায় গেলেন। নিকটে জল নাই খানিক দুরে গিয়ে একটা নদীর মতো দেখতে পেলেন। নদীর নিকটে গিয়ে দেখেন একটি পরমা সুন্দরী যুবতী সেখানে বসে আছে। নারদ তার রূপ দেখে মোহিত হয়ে গেল। তারপর তার নিকটে নারদ যাওয়া মাত্র আলাপ করতে লাগলেন। এত গভীর আকর্ষিত হলেন যে সেখানে তাকে নিয়ে ঘর সংসার করতে লাগলেন। ক্রমে তাহার অনেকগুলি ছেলে মেয়ে হল।
আরও পড়ুন:
নুডলসে চাই নতুনত্ব! নিমেষে বাড়িতেই তৈরি করে ফেলুন চিলি গার্লিক নুডলস
পিকনিক দল থেকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু: তাঁর লেন্সের বিস্তৃতি ছিল বিস্ময়কর
নারদ সেই ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখে ঘরকন্যা করতেছে এমন সময় সেখানে ভয়ানক বান হল যেখানে সেখানে লোকে মরতে লাগলো। নারদ সে দেশ হতে ছেলে মেয়েগুলিকে নিয়ে পালাবার পরামর্শ করলেন। স্ত্রীও তাতে সম্মত হল। তাহারা উভয়ে পুত্র কন্যা গুলিকে নিয়ে নদীর সেতুর উপর দিয়ে যাওয়ার সময় সেতু ভেঙে, অবশেষে তার স্ত্রী ও পুত্র কন্যারা জলময় হয়ে মরে গেল। নারদ তাহাদের শোকে আকুল হয়ে হাপুস নয়নে ক্রন্দন করছে। এমন সময় ঠাকুর সম্মুখে গিয়ে বললেন, “কই নারদ জল কই? আর তুমি কাঁদছো বা কেন?” নারদ ঠাকুরের দর্শন পেয়ে বিস্মিত হলেন এবং তখন সকল কথা বুঝতে পেরে বললেন, “ঠাকুর তোমাকে নমস্কার আর তোমার মায়াকে নমস্কার।”
পুত্র, স্ত্রী, গৃহাদি উন্নতি যদি বা হয়,
প্রশংসা, সম্পদ যৌবন যে ভাবে নিত্য
সে মূঢ় ব্যক্তি নিশ্চয়।
সংসার কারাগৃহ ত্যাগে যিনি
সম্পূর্ণ বিচারে দেখে ক্ষনিকের বিনিশ্চয়।।
আমার প্রতি ক্ষণে উপলব্ধি করি মায়ার শক্তি, প্রলভিত হয়ে নিত্য নতুন কর্ম ও ফল ভোগ করি।
পুত্র, স্ত্রী, গৃহাদি উন্নতি যদি বা হয়,
প্রশংসা, সম্পদ যৌবন যে ভাবে নিত্য
সে মূঢ় ব্যক্তি নিশ্চয়।
সংসার কারাগৃহ ত্যাগে যিনি
সম্পূর্ণ বিচারে দেখে ক্ষনিকের বিনিশ্চয়।।
আমার প্রতি ক্ষণে উপলব্ধি করি মায়ার শক্তি, প্রলভিত হয়ে নিত্য নতুন কর্ম ও ফল ভোগ করি।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।