রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


উপনিবেশী ভারতের শেষ লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ফ্রেমবন্দি করেন হোমাই।

গুজরাত থেকে বোম্বাইয়ে (বর্তমান মুম্বই) চলে আসার পর তাঁর পরিচয় হয় মানেকশাহ ব্যারাবালার সঙ্গে। মানেকশাহ তখন (১৯২৬ সাল নাগাদ) ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। মানেকশাহের কাছেই প্রথম ক্যামেরার কাজ শেখেন তিনি। বোম্বাইয়ের অলিতে গলিতে ছবি তোলার নেশায় তাঁরা ঘুরে বেড়াতেন। স্কুলের গণ্ডি পেরোনো মেয়ের হাতে ক্যামেরা দেখে সবাই অবাক হতো অথচ সেই মেয়ের হাতে জাদু ছিল, তিনি হোমাই ব্যারাবালা- ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা চিত্র সাংবাদিক। ব্রিটিশ উপনিবেশী শাসনের পরিসর থেকে দেশভাগের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা লাভ সবই তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল অসামান্য দক্ষতায়, যা আজও সেই সময়ের দলিল হিসেবে রয়ে গিয়েছে।
১৯১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর গুজরাটের নভসারিতে একটি পার্সি পরিবারে হোমাই হাতিরাম জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা দোসসাভাই হাতিরাম একটি ভ্রাম্যমান যাত্রাদলের অভিনেতা হওয়ার সুবাদে শৈশবের বেশিরভাগ সময় দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেই কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরাধীন ভারত ও অশিক্ষার অন্ধকারে আচ্ছন্ন সমাজে হোমাইয়ের বাবা মা সুশিক্ষিত ছিলেন না কিন্তু হোমাইয়ের পড়াশোনাতে তাঁদের উৎসাহ, উদ্যমই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। সেই সময় তারদেও এলাকার গ্রান্ট রোড হাইস্কুল থেকে তিনি তাঁর শ্রেণিতে একমাত্র ছাত্রী হিসেবে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করেন। অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা তাঁদের নিত্যসঙ্গী ছিল।

হোমাই ব্যারাবালার ফ্রেমে গান্ধীজি।

কিছুসময় পরে তাঁর পরিবার স্থায়ীভাবে বোম্বাই-এ চলে এলে হোমাই প্রথমে অর্থনীতিতে ডিগ্রি লাভ করার জন্য সেখানকার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন এবং এরপর স্যর জেজে স্কুল অফ আর্ট থেকে পড়াশোনা করেন‌। এই কলেজে পড়ার সময়েই তিনি তাঁর প্রথম কাজটা পেয়ে যান, কাজটা ছিল এক পিকনিক দলের ছবি তুলে দেওয়া। সেই বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ক্যামেরার ক্ষেত্রে কেউ কখনও ডিজিটাল শব্দই শোনেনি, সবটাই ছিল ম্যানুয়াল; আর কোনও মহিলা যদি সেক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্ব দেখান? হয়েছিল তাই। তাঁর তোলা ওই পিকনিক দলের ছবিগুলো স্থানীয় একটি পত্রিকা ‘দ্য বম্বে ক্রনিকল’ এ ছাপা হলে দ্রুতই তিনি বেশ কিছু বাড়তি কাজের প্রস্তাব পেয়ে যান। ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকার পাতায় তাঁর ‘ফটোগ্রাফস অফ লাইফ ইন মুম্বই’ শীর্ষক ছবিগুলো প্রকাশ পাওয়ার পর তিনি গণমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: আমি বনফুল গো: তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১২: সিদ্ধাশ্রমে সাফল্য, বিশ্বামিত্রের বংশবর্ণনা এবং নদীকথায় কীসের ইঙ্গিত?

১৯৩০ সালে হোমাই তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ইতিমধ্যে তাঁর ক্যামেরায় পারিপার্শ্বিক নানা ধরনের ছবির সঙ্গে সঙ্গে সদ্য সূচিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্রও বন্দি হয়, কিন্তু সেই সময় চিত্র সাংবাদিকতা ছিল পুরুষদের একচেটিয়া পেশা।

তাই ছবির স্বার্থে এতদিন তাঁর তোলা সব ছবি তাঁর স্বামীর নামে প্রকাশিত হত। স্বামী মানে ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র হিসেবরক্ষক ও চিত্রগ্রাহক মানেকশাহ জামশেদজি ব্যারাবালা, তাঁর সঙ্গে হোমাই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই মানেকশাহ তাঁকে প্রথম জীবনে ক্যামেরায় ছবি তোলা শেখান। দু’ জনের বন্ধুত্ব প্রণয় থেকে পরিণয়ে পরিণতি পায়।

তাঁর তোলা ছবিতে নেহরু সবচেয়ে সপ্রতিভ থাকতেন।

এরপর ১৯৪২ সালে স্বামী মানেকশাহ ‘ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে’র ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজের ডাক পেলে ব্যারাবালা দম্পতি বোম্বাই থেকে দিল্লিতে চলে আসেন। সেই সময় তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল প্রিয় স্পিড গ্রাফিক ক্যামেরা। সেই ক্যামেরা পিঠে ঝুলিয়ে তিনি সাইকেলে করে দিল্লির রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। একটু একটু করে গড়ে তোলা রাজধানী শহরের বিভিন্ন ছবি তিনি তুলতে শুরু করেন। দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় থেকে তাঁর তোলা ছবিগুলো আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। একজন চিত্র সাংবাদিক হিসেবে স্বাধীনতা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ইন্দিরা গান্ধী সহ আরও অনেক রাজনৈতিক এবং জাতীয় নেতাদের ছবি তোলেন। তাঁর ছবিগুলোকে ছবি বলা যাবে না, সেগুলো আসলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জীবন্ত দলিল। তাঁর তোলা বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম স্বাধীনতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার সময়ে ভারতের মাটিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের শেষ স্যালুট প্রদানের দৃশ্যটি।
আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’

বিভিন্ন সময়ে তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সপ্রতিভ ছবিগুলো তুলেছিলেন। তাঁর প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে নেহরু ছিলেন অন্যতম। জওহরলালের মৃত্যুর পর তিনি বলেছিলেন, “বাকি আলোকচিত্রকারদের থেকে লুকিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদেছিলাম আমি”। এতটাই সুসম্পর্কে ছিলেন তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তবে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তাঁর পেশাগত জীবনের সবচেয়ে বড় অনুশোচনা ছিল এই যে গান্ধীজির শেষ সময়ে তিনি থাকতে পারেননি। ধারাবাহিকভাবে তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও ভারত সফরে আসা অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এবং তারকাদের ছবি তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে চিনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা হো চি মিন, মহারানি এলিজাবেথ দ্বিতীয় এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ১৯৫৬ সালে তিনি লাইফ ম্যাগাজিনের হয়ে চতুর্দশ দলাই লামা যখন নাথুলা পাস হয়ে প্রথম সিকিমে প্রবেশ করেন তখন তাঁর ছবি তোলেন, এমন বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছেন হোমাই।

তাঁর ক্যামেরায় ইন্দিরা গান্ধী।

তেরো সংখ্যার বিশেষ প্রকাশ ছিল তাঁর জীবনে। তাঁর বেশিরভাগ ছবিই ‘দালদা ১৩’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হত কারণ তাঁর জন্মসাল ছিল ১৯১৩, তের বছর বয়সে তাঁর হবু স্বামীর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় এবং তাঁর প্রথম গাড়ির নম্বর ছিল ‘ডিএলডি ১৩’। এমন তুখোড় চিত্র সাংবাদিক ১৯৭০ সালে তাঁর স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুর কিছুদিন পরেই নতুন প্রজন্মের আলোকচিত্রীদের খারাপ আচরণের জন্য চিত্রগ্রাহকতা ছেড়ে দেন। জীবনের শেষ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় তিনি একটাও ছবি তোলেননি।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-গন্ধে: মিষ্টি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? বাড়িতে ঝটপট বানিয়ে ফেলুন জিভে জল আনা ক্ষীর মাধুরী

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২১: ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট ও সমৃদ্ধি কামনা

পেশার শীর্ষে থাকার সময় কেন তিনি চিত্র সাংবাদিকতা ছেড়ে দিলেন, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতেন, “এটার আর কোনও মূল্য নেই। আমাদের আলোকচিত্রীদের জন্য নিয়ম ছিল; আমরা এমনকি, যথাযথ পোশাক পরিধান রীতিনীতি অনুসরণ করতাম। আমরা একে অপরকে সম্মান করতাম, সহকর্মীদের মতো ব্যবহার করতাম। কিন্তু তারপর সবকিছু খুব খারাপ দিকে পরিবর্তিত হয়ে গেল। তারা শুধু দ্রুত কিছু পয়সা রোজগারে উৎসাহী হয়ে পড়ল; আমি আর এই ভিড়ের অংশ হতে চাইনি।”

২৪শে নভেম্বর ১৯৫৬ সালে, আনুষ্ঠানিক পোষাকে দলাই লামা সিকিমের নাথুলা পাস দিয়ে ভারতে ঢুকছেন, তিনি ফ্রেমবন্দি করেছিলেন।

অবসর নেওয়ার পর হোমাই ব্যারাবালা দিল্লি থেকে পিলানিতে তাঁর কর্মরত ছেলের কাছে চলে যান। শেষে ১৯৮৯ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছেলের মৃত্যুর পর তিনি তাঁর জন্মস্থান গুজরাতে ফিরে বরোদাতে একটি নতুন বাসভবনে একান্তে বসবাস করতেন। জীবনের শেষ দুটি দশক তিনি গাছপালা ও বাগান চর্চার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছিলেন। ২০১২ সালের ১৫ জানুয়ারি এই মহীয়সী ফুসফুসের রোগে ভুগে ইহলোক ত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন:

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৪: পুতুলের মাথায় কোঁচকানো সোনালি চুল, চোখ দুটো কেমন যেন অদ্ভুত, কিন্তু এটা আমায় কে পাঠালো?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২১: ক্যানসার মানেই মৃত্যু?

আজ যে মোবাইল ক্যামেরা সবার হাতে হাতে, বিশেষত নিজস্বী তোলায় পটু বর্তমান প্রজন্ম কত সহজে নানাভাবে ছবি তুলে থাকেন, সেই প্রজন্ম ভাবতেই পারবে না যে ১৯২০-৩০ এর দশকে ম্যানুয়াল ক্যামেরায় এমন ছবি তোলা ছিল কত কঠিন। অথচ হোমাইয়ের হাতের জাদুতে সেটাই সম্ভব হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে ‘আউটস্ট্যান্ডিং উওম্যান মিডিয়া পার্সন’ হিসেবে হোমাই ‘চামেলি দেবী জৈন পুরস্কার’ লাভ করেন।

সঞ্জয় এবং রাজীবকে নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী।

২০০৬ সালে বিবিসি তাঁরই গৃহীত বহু দুর্লভ আলোকচিত্র ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের একটি সময়ানুক্রমিক ইতিবৃত্ত ‘ইন্ডিয়া ইন ফোকাস: ক্যামেরা ক্রনিক্যালস অফ হোমাই ব্যারাবালা’ নামক গ্রন্থ প্রকাশ করে তাঁকে সম্মান প্রদান করেছে। ২০১১ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন।

এছাড়া তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক দ্বারা ‘ন্যাশনাল ফটো অ্যাওয়ার্ড ফর লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’ এ সম্মানিত হন। ‘ব্রিটিশ আর্টস কাউন্সিল’ ১৯৯৬ সালে হোমাইয়ের জীবন অবলম্বন করে ‘দালদা- ১৩’ নামক একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে। দিল্লির ‘দ্য আলকাজি ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস’ কর্তৃপক্ষ তাঁর গৃহীত আলোকচিত্রগুলো তাদের ‘চিরকালীন সংগ্রহ’ হিসেবে সংরক্ষণ করে তাঁকে সম্মান প্রদান করেছে। ২০১৭ সালের ৯ ডিসেম্বর হোমাই ব্যারাবালার ১০৪ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুগল একটি ডুডল “লেন্স নিয়ে প্রথম মহিলা” দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছে। তাঁর মহান জীবনের কর্মকাণ্ড আজও ভারতীয় ইতিহাসের এক পর্বের সাক্ষী হয়ে আছে।
* দশভুজা (women – Special Article) : ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

Skip to content