শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


গিরিশচন্দ্র।

শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ ধন্য হওয়ার পর থেকে গিরিশচন্দ্রের নাটক লেখার ধাঁচটাই যেন অন্যরকম হয়ে গেল। ঠাকুরের কৃপালাপ করার পর বুদ্ধদেব, বিল্বমঙ্গল, রূপ সনাতন নাটকে গিরিশচন্দ্রের আধ্যাত্মিক ভাব বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছিল। তারপরেই এল এই পূর্ণচন্দ্র নাটকটি। এখানে তাঁর সুক্ষ আধ্যাত্মিক দৃষ্টি কী রকম খুলে গিয়েছিল যাঁরা তাঁর নসীরাম, জনা, কালাপাহাড়, পাণ্ডবগৌরব, শঙ্করাচার্য প্রভৃতি নাটকগুলো মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেছেন, তাঁদের কাছে আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।
গিরিশচন্দ্র ‘পূর্ণচন্দ্র’ নাটকে যে শিক্ষাটা দিয়েছেন সেটি হল “ঈশ্বর মঙ্গলময়, শিক্ষার নিমিত্ত তিনি মানবকে দুঃখ দেন, অসংশয় চিত্তে ভগবানে বিশ্বাস রাখো।” পূর্ণচন্দ্র নাটকের অভিনয় সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়েছিল। সংবাদপত্রগুলিতে এবং শিক্ষিত সমাজে এর যথেষ্ট সমাদর ও সুখ্যাতি হয়েছিল। দামোদর, ইচ্ছা ও পূর্ণচন্দ্রের ভূমিকাভিনয়ে মতিলাল সুর, ক্ষেত্রমণি ও গোলাপ সুন্দরী অদ্ভুত কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এই নাটকের অভিনয় দর্শন করে অনেকেই বলেছিলেন যে এই নাটকের কোনও তুলনা হয় না।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৩৪: ‘মুকুল মুঞ্জরা’ গিরিশচন্দ্রকে নাট্যজগতে স্বতন্ত্র করে তুলেছে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৪: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ‘রাত-ভোর’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১০: কিশোর কণ্ঠের উপর যেন এক অলিখিত দাবি ছিল পঞ্চমের

এরপরই গিরিশচন্দ্রের ‘বিষাদ’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় এমারেল্ড থিয়েটারে। দিনটি হল ১৮৮৮ সালের ৬ অক্টোবর। প্রথম দিনে অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অলোকের ভূমিকায় মহেন্দ্রলাল বসু, মাধবের চরিত্রে মতিলাল সুর, সরস্বতীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন হারকাটা গলির কুসুমকুমারী। উজ্জ্বলা হয়েছিলেন কিরণশশী। সোহাগীর ভূমিকায় ক্ষেত্রমণি। এই নাটকের সংগীত পরিচালক হলেন মোহিত মোহন গোস্বামী ও পূর্ণচন্দ্র ঘোষ।

কুসুমকুমারী।

সরস্বতী চরিত্র গিরিশ চন্দ্রের একটা অপূর্ব সৃষ্টি, স্বামী পতিতায় আসক্ত, বেশ্যাগৃহে থাকেন। সরস্বতী পতি সেবায় জীবন উৎসর্গ করে বালকের ছদ্মবেশে ধারণ করলেন এবং বিষাদ নাম গ্রহণ করে বেশ্যার দাসত্ব স্বীকার করলেন। রামকৃষ্ণ লোক শিক্ষার কথা বলেছিলেন গিরিশচন্দ্রকে। এই নাটকে লোকশিক্ষার অনেক কিছু আমরা দেখতে পাই। এই নাটকে শিক্ষার প্রচুর চেষ্টা আছে। সুনিপুণ অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা অভিনয় চাতুর্যে এই চেষ্টা রঙ্গমঞ্চকে আরও প্রস্ফুটিত করে তুলেছিলেন। সঙ্গতি সম্পন্ন যুবক সংঘ দোষে কুলটার কৌশলে পড়ে কেমন করে সর্বস্বান্ত হন, আপনার বংশ মাহাত্ম্য নষ্ট করে নিচের থেকেও নিচ পশুবৎ হয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬২: প্রথম রবীন্দ্রজীবনী

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৪: মাছের বাজারের দুনিয়ায় আলিপুরের ‘নেট বাজার’ তালিকায় শীর্ষে

স্বাদে-আহ্লাদে: ম্যাগি ভালোবাসেন? এই রেসিপি ট্রাই করে দেখেছেন?

গিরিশচন্দ্রের লেখনি কৌশলে এই পাপ চিত্র অতি উজ্জ্বল বর্ণে বিষাদে বর্ণিত হয়েছে। একদিকে যেমন এই নারকীয় দৃশ্য অপরদিকে ভক্তি। স্বামীর জন্য কেমন করে স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়, আত্ম বলি দিতে হয়, বিষাদের মধ্য দিয়ে সেই সুরটি ফুটে উঠেছে। বিষাদ নাটকের গানগুলি অতুলনীয়। “আমরা চার রকমের চার বিরহিনী”, “প্রেমের এই মানা”, “বিরহ বরং ভালো এক রকমে কেটে যায়” প্রভৃতি গানগুলো একসময় খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
বছর দুই পরে গোপাললাল শীলের শখ মিটে যাওয়ায় তিনি এমারেল্ড থিয়েটার মতিলাল সুর, পূর্ণচন্দ্র ঘোষ, হরিভূষণ ভট্টাচার্য ও ব্রজলাল মিত্র এই চারজনকে ভাড়া দিলেন। এই সময়ে গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে গোপালবাবুর কার্যত সম্বন্ধ ফুরিয়ে যায়। তখন গিরিশচন্দ্র পুনরায় কর্নোয়ালিশ স্ট্রিটে (বর্তমান নাম বিধান সরণি) প্রতিষ্ঠিত স্টার থিয়েটারের ম্যানেজারের পদটি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি যেন নিজের ঘরেই ফিরলেন।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content