রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

রাজা দশরথের কাছে ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের প্রার্থিত ছিলেন শুধু রামচন্দ্র। রামচন্দ্রের সঙ্গে লক্ষণও চললেন ঋষির সঙ্গে। কারণ? রামায়ণস্রষ্টা রামচন্দ্রের ছায়াসঙ্গী লক্ষ্মণ সম্বন্ধে জানিয়েছেন—

লক্ষ্মণো লক্ষ্মিসম্পন্নো বহিঃ প্রাণ ইবাপরঃ। ন চ তেন বিনা নিদ্রাং লভতে পুরুষোত্তমঃ।।

লক্ষ্মীসম্পন্ন লক্ষ্মণ যে রামের আরেকটি প্রাণস্বরূপ। তাঁকে ছাড়া পুরুষোত্তমের ঘুমই আসে না।
রাজধানীর সুরক্ষিত প্রাসাদে ছেড়ে চললেন রামচন্দ্র জীবনাভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে নতুন এক অভিযাত্রায়। এই যাত্রাপথে আছেন এমন এক পথপ্রদর্শক যিনি একজন ধার্মিক যোদ্ধা, জীবনযুদ্ধে স্থির লক্ষ্যপূরণে সফল ব্যক্তিত্ব, যিনি পথে প্রান্তরের অন্ধিসন্ধি জানেন, জ্ঞানী, শ্রদ্ধাশীল, ত্যাগ ও তিতিক্ষার আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনার মতো যাঁর প্রাণ, যাবতীয় সমরাস্ত্রজ্ঞান যার অধিগত, নিজের যা কিছু বৌদ্ধিক জ্ঞানসম্পদ উজার করে বিলিয়ে দিতেই যার ঔদার্য, এমন এক মহান ঋষি।পেছনে পড়ে রইল বন উপবন পরিবেষ্টিত সুরম্য প্রাসাদ, শত্রুর অগম্য দুর্লঙ্ঘ পরিখাবেষ্টিত সুরক্ষিত অযোধ্যা নগরী। এক অনিশ্চয়তার নতুন পথে চলেছেন অভিযাত্রী রামচন্দ্র। যেন এক পরীক্ষার্থী, এক নব্য জ্ঞানাভিলাষী, চলেছেন ঋষি বিশ্বামিত্রের অভিভাবকত্বে। একজন ভাবি শাসকের যে প্রকৃতিপাঠ প্রয়োজন। কঠোর রাজনীতির ঊষর মরুপ্রান্তরে কান্ত কোমল প্রকৃতির সান্নিধ্যে, নদীর গতিধারার উৎসমুখ, পাহাড়ের উন্নতসঙ্গ, শ্বাপদসংকুল অরণ্যের প্রতিবন্ধকতা এইসব অনুষঙ্গের আবশ্যকতা হয়তো আছে। আয়োজন মহর্ষি বিশ্বামিত্রের। তিনি তাঁকে নিয়ে চললেন অবারিত প্রকৃতির উন্মুক্ত পরিসরে। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যে উদ্দেশ্য তা হল একজন মহান ঋষিকে চিন্তামুক্ত যজ্ঞীয় বাতাবরণ সৃষ্টিতে সহায়তা। দৃশ্যটি বড়ই মনোরম নির্মল সুবাতাসের অঘ্রাণ নিতে নিতে সরযূ নদীর তীর ধরে এগিয়ে চললেন লক্ষণভাইয়ের সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্র। পথ দেখিয়ে চলেছেন এমন একজন মহান ঋষি বশিষ্ঠের শংসাপত্রে তাঁর গুণরাশির বিচ্ছুরণ —

এষ বিগ্রহবান্ ধর্ম্ম এষ বীর্য্যবতাং বরঃ। এষ বিদ্যাধিকো লোকে তপসশ্চ পরায়ণম্।। এষোঽস্ত্রান্ বিবিধান্ বেত্তি ত্রৈলোক্যে সচরাচরে।নৈনমন্যঃ পুমান্ বেত্তি ন চ বেৎস্যন্তি কেচন।।
শৌর্যশালীদের মধ্যে মূর্তিমান ধর্মস্বরূপ, বিদ্যাবত্তার আধিক্যে, শতপশ্চর্যায় শ্রেষ্ঠ, তাঁর মতো অস্ত্রজ্ঞান ত্রিলোক চরাচরে কেউ অবগত নন এমন সেই মহান ঋষি বিশ্বামিত্র।রাজ্যের প্রকৃতির ভৌগোলিক জ্ঞান, ধর্মচিন্তার ব্যাপকতা, তপস্যাকঠোর জীবনদীক্ষা সেইসঙ্গে অস্ত্রপ্রয়োগ ও সংবরণের কুশলতা প্রদানই তাঁর উদ্দেশ্য। দশরথ পুত্রের দুর্বলতা জানিয়েছিলেন, “নৈব বেত্তি বলাবলম্” রামচন্দ্রের বল এবং অবলের সম্যক জ্ঞান নেই। একজন সুশাসকের তাঁর সাম্রাজ্যের নাড়িনক্ষত্র জ্ঞানসম্ভার আয়ত্তাধীন থাকা প্রয়োজন।বিশ্বামিত্র চললেন সর্বাগ্রে, তিনি যে পথিকৃৎ, তাঁকে অনুসরণ করলেন রামচন্দ্র,সকলের পেছনে সদ্য কাকপক্ষধারী ধনুকে শোভিত লক্ষ্মণ।প্রথমে আলোকে উত্তরণের দিশারী গুরু পেছনে বয়ঃক্রমানুসারে গ্রহীতা শিষ্যদ্বয়।
সদ্যতরুণ দুই ভাইয়ের অঙ্গশোভা ছিল অঙ্গুলিত্রাণ, খড়্গ এবং বিবিধ অলঙ্কার।অনেক যুদ্ধ এখনও বাকি। এসব যে বাইরের সুরক্ষার আবরণ। অন্তরের শক্তি?

তিনজন অর্দ্ধযোজন অর্থাৎ ছয়ক্রোশ পথ অতিক্রম করে উপস্থিত হলেন সরযূনদীর দক্ষিণতীরে।ঋষি বিশ্বামিত্র মধুর সম্ভাষণে রামচন্দ্রকে বললেন—

গৃহাণ বৎস সলিলং মাভূৎ কালস্য পর্যয়ঃ।। মন্ত্রগ্রামং গৃহাণ ত্বং বলামতিবলাং তথা।। ন শ্রমো ন জ্বরো বা তে ন রূপস্য বিপর্য্যয়ঃ। ন চ সুপ্তং প্রমত্তং বা ধর্ষয়িষ্যন্তি নৈর্ঋতাঃ।।

হে বৎস, সময় নষ্ট করো না। জলে আচমন করে মন্ত্রসকল, বলা ও অতিবলা গ্রহণ কর। বলা ও অতিবলা তোমার ক্লান্তি, জ্বরবিকার, রূপবিকৃতি দূর করবে। এই মন্ত্রজ্ঞান আয়ত্তে থাকলে নিদ্রাভিভূত অবস্থায় বা কার্যান্তরে ব্যস্ততায় অসতর্ক অবস্থাতেও রাক্ষসেরা তোমার ক্ষতি করতে পারবেনা। এছাড়াও—

এতদ্বিদ্যাদ্বয়ে লব্ধে না ভবেৎ সদৃশস্তব।বলা চাতিবলা চৈব সর্ব্বজ্ঞানস্য মাতরৌ।।

সর্বজ্ঞানমাতৃকা এই বলা ও অতিবলালাভে—

ন সৌভাগ্যে ন দাক্ষিণ্যে ন জ্ঞানে বুদ্ধিনিশ্চয়ে। নোত্তরে প্রতিবক্তব্যে সমো লোকে তবানঘ।।

সৌভাগ্যে, দাক্ষিণ্যগুণের ঔদার্যে, জ্ঞানের গভীরতায়, বুদ্ধির শাণিত তীক্ষ্ণতায়, উত্তরদানের দৃঢ়তায়, প্রত্যুত্তরের যুক্তিনিষ্ঠতায় তোমার তুল্য পৃথিবীতে কেউ থাকবেনা। ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র, তিনি অতীতে একজন ক্ষাত্রতেজে উদ্দীপ্ত রাজা ছিলেন তিনি রামচন্দ্রকে এই বলদানে মনে হয় রাজোচিত উৎসাহশক্তি দান করলেন। অর্থশাস্ত্রকার কোটিল্য বলেছেন—

শৌর্যম্ অমর্ষঃ শীঘ্রতা দার্ক্ষ্যং চোৎসাহগুণাঃ।
আরও পড়ুন:

উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১৬: উত্তম-সুচিত্রাকে সহজে দেখা যেত না, তাই তাঁদের প্রেম দেখতে হল-এ ভিড় করতেন উৎসাহীরা

মহাকাব্যের কথকতা: পর্ব-৯: কৌরবদের জন্ম এবং কুরুপাণ্ডবদের ছেলেবেলার শত্রুতা

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৪: মাছের বাজারের দুনিয়ায় আলিপুরের ‘নেট বাজার’ তালিকায় শীর্ষে

অজানার সন্ধানে: মিথ্যার সঙ্গে আপোষ না করে ছাড়েন চাকরি, দিন কাটে অনাহারে, কে এই ভারতের ফেভিকল ম্যান?

পরাক্রমপ্রকাশ, ক্ষমাহীনতা, কর্মোদ্যোগ, শারীরিক তৎপরতা, কুশলতা এসবই যে রাজার উৎসাহগুণ।

রাজার আত্মসম্পদ বা রাজোচিতগুণের তালিকায় সর্বশেষে আছে ‘বৃদ্ধোপদেশাচারঃ’ বয়োজ্যেষ্ঠদের উপদেশানুসারে কার্যানুষ্ঠান। মহর্ষি বিশ্বামিত্র প্রদত্ত বলা ও অতিবলা হয়তো রাজপুত্রদের আত্মশক্তি উদ্বোধনের সহায়ক।

ঋষি বিশ্বামিত্র কেন এই বল দান করলেন রামচন্দ্রকে?

প্রদাতুং তব কাকুৎস্থ সদৃশস্ত্বং হি পার্থিব। কামং বহুগুণা সর্ব্বে ত্বয্যেতে নাত্র সংশয়ঃ।।

হে কাকুৎস্থ রাঘব, যদিও তোমার বহু গুণ আছে তবে এই গুণপ্রদানের যোগ্যপাত্র তুমিই,এই গুণ তোমাকে বহুগুণ দান করবে।

সরযূর জলে পরিশুদ্ধ হয়ে বলা ও অতিবলা গ্রহণ করলেন রামচন্দ্র। ঋষি বিশ্বামিত্রের প্রতি গুরুর প্রতি যা কর্তব্য তার সম্পন্ন করলেন। এ গুরুস্বীকৃতি গ্রহীতার বিনম্রতা, দাতা গুরুর গৌরব। সেই রাত ঋষির সঙ্গে মধুর আলাপচারিতায় তৃণশয্যায় শয়নে অতিবাহিত হল।রাজকীয় যাপনের বাইরেও যে আছে কঠোর, কঠিন রূঢ়, বাস্তবের কর্কশ ভূমি-মৃত্তিকাশয়নে যেন তারই শিক্ষা।

প্রভাতবেলায় অবগাহন এবং অর্ঘ্যদানান্তে গঙ্গার সঙ্গমস্থলে উপস্থিত হলেন তাঁরা তিনজন। সেখানে পুণ্যাশ্রমে তপস্যারত ঋষিদের দেখে পরম কৌতূহলে জানতে চাইলেন—

কস্যায়মাশ্রমঃ পুণ্যঃ কো ন্বস্মিন্ বসতে পুমান্। ভগবন্ শ্রোতুমিচ্ছাবঃ পরং কৌতূহলং হি নৌ।।

এই আশ্রম কার?কারা এখানে বাস করেন?
বিশ্বামিত্র স্মিত হেসে জানালেন পূর্বে এই আশ্রম ছিল মদন বা কামদেবের।দেবাদিদেবের সমাধি ভঙ্গের পর দুর্ম্মেধা অর্থাৎ দুর্মতি কামদেব তাঁর চিত্তবিভ্রম ঘটিয়েছিলেন।মহাদেবের জলন্ত ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে মদনদেব ভস্মে পরিণত হলেন। অনঙ্গ ইতি বিখ্যাতস্তদা প্রভৃতি রাঘব সেই থেকে কামদেব অনঙ্গ নামে বিশ্রুত হলেন।তাঁর নামানুসারে এই স্থানটি অঙ্গরাজ্য নামে অভিহিত।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৩: আচমকা রাতের পার্টিতে হাজির পুলিশ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬২: প্রথম রবীন্দ্রজীবনী

পোন্নিয়িন সেলভান ২: ছোটবেলার ভালোবাসার সামনে ‘পরদারেষু মাতৃবৎ’ও দুর্বল হয়েছিল

প্রায় তারুণ্যে উপনীত রামচন্দ্রকে ব্রহ্মর্ষি জানাচ্ছেন স্থানমাহাত্ম্যের ইতিহাস, বিচিত্র কাহিনি। অন্তর্নিহিত বার্তা বোধ হয়, কামনার ছলাকলায় কদাপি ভুলনা বাছা। বিস্মিত রামচন্দ্র, তিনি এতদিন অযোধ্যায় নাগরিকজীবনে রাজপ্রাসাদের স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে এসেছেন, তাঁর অপার কৌতূহলের উত্তরে রাজ্যের নামের উৎস বর্ণনা করছেন ঋষিশ্রেষ্ঠ বিশ্বামিত্র। তাঁর ক্ষত্রিয়প্রেক্ষিত কাজ করছে বর্ণনায়।বক্তা ক্ষত্রিয় থেকে ঋষিত্বে উত্তীর্ণ এক মহান ঋষি এবং শ্রোতা একজন ভাবী রাজা। যদিও সেই ভবিষ্যতের রাঘব রামচন্দ্রের শৈশবে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে শাস্ত্রের জ্ঞান অধিগত করেছেন তবুও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাজনিত জ্ঞানও যে রাজ্য শাসনে আবশ্যক।

একদা মহাদেবের নিবাস ছিল যে অনঙ্গাশ্রমে সেখানে ঋষিদের দ্বারা আপ্যায়িত হলেন তিনজন।রজনী অতিবাহিত হলে বিশ্বামিত্রসহ রাম লক্ষণ নৌকায় গঙ্গা নদী উত্তীর্ণ হলেন। মাঝনদীতে জলের তরঙ্গভঙ্গের শব্দ শুনতে পেলেন রামচন্দ্র।এর কারণ কী? জানতে চাইলেন।

বারিণো ভিদ্যমানস্য কিময়ং তুমুলো ধ্বনিঃ

জলরাশির সংক্ষোভে উত্তাল জলের তুমুল শব্দ কেন?ব্রহ্মর্ষি জানালেন মানসসরোবর উৎপত্তির ইতিকথা। ব্রহ্মা কৈলাস পর্বতে মন দিয়ে একটি সরোবর নির্মাণ করেছিলেন। মন থেকে জাত, তাই এর নাম মানস সরোবর। মন যে উন্মুক্ত হয় জলের সান্নিধ্যে। দুইই ছলছল,টলটল করে। সরোবর জলের স্বচ্ছতায়, আর মন ভাবনার গভীরতায়। সেখান থেকে উৎপত্তি অযোধ্যার নিকটবর্তী সরযূ নদীর।

সরঃ প্রবৃত্তা সরযূঃ পুণ্যা ব্রহ্মসরশ্চ্যুতা।তস্যায়মতুলঃ শব্দো জাহ্নবীমভিবর্ত্ততে।।

সরোবর থেকে উৎপন্ন তাই তার নাম সরযূ। ব্রহ্মা-সৃষ্ট সরোবর থেকে উৎপন্ন তাই পবিত্র। এর থেকে যে অতুল কল্লোল উত্থিত হচ্ছে তা গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হওয়ার কারণে। ঋষি বিশ্বামিত্রের নির্দেশমতো দুই পবিত্র নদীকে প্রণাম জানালেন দুই ভাই। গঙ্গার দক্ষিণতীরে সিংহ, বাঘ, বরাহ, হাতি প্রভৃতি হিংস্র শ্বাপদসংকুল অরণ্যে উপস্থিত হলেন তাঁরা। এই ভয়াল অরণ্য সৃষ্টির কারণ কী?

কিং স্বিদং দারুণং বনম্

ঋষি বিশ্বামিত্র জানালেন— এই অরণ্য হলো মলদ ও করূষ নামে দেবনির্মিত দুই পরিত্যক্ত নগরীর ধ্বংসাবশেষে সৃষ্ট মহারণ্য। বৃত্রাসুরকে বধ করবার পর ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত ইন্দ্রকে গঙ্গা জলে স্থান করিয়ে মুনি ও তপস্বীরা, ইন্দ্রের দেহের মল ও করূষ অর্থাৎ ক্ষুধা দূর করেন।প্রীত ইন্দ্র বলেন—

ইমৌ জনপদৌ স্ফীতৌ খ্যাতিং লোকে গমিষ্যতঃ। মলদাশ্চ করূষাশ্চ মমাঙ্গমলধারিণৌ।।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৪: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ‘রাত-ভোর’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৬: গরমে কক্ষনও ডিম খেতে নেই?

স্বাদে-আহ্লাদে: খুদের টিফিনে কী দেবেন ভেবেই মাথায় হাত? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন মুগ ডালের চিল্লা!

সকৃতজ্ঞ ইন্দ্র স্থানদুটির নামকরণ করে বললেন আমার অঙ্গমলধারণ করায় এদের নাম হবে মলদ এবং করূষ। বর্ধিষ্ণু স্থানদুটি পৃথিবীতে খ্যাতি লাভ করবে।প্রাক্তন বিখ্যাত স্থানদুটির মাহাত্ম্য বর্ণনা করলেন ঋষি। বর্তমানে স্থানদুটি যক্ষিণী অধ্যুষিত অরণ্য।কে সেই যক্ষিণী? সেই বহুকালের সমৃদ্ধ জনপদদুটিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাড়কা নামে হস্তীর মতো বলধারিণী কামরূপিণী এক যক্ষিণী। বর্তমানে স্থান দুটি যক্ষিণী অধ্যুষিত অরণ্য।সে ও তার পুত্র বিপুলবদন মহাপরাক্রমী মারীচ নিয়ত জনসাধারণের মনে ত্রাস সঞ্চার করে চলেছে।

রামচন্দ্রের প্রশ্ন, যক্ষজাতি অল্পবলবিশিষ্ট হয় তাহলে অবলা তারকার এই হস্তিনীসদৃশ বল কিভাবে সম্ভব?অত্যাচারীকে নির্মূল করবার আগে যেন সম্পূর্ণভাবে তার সম্বন্ধে জানতে চান রামচন্দ্র। বিশ্বামিত্র তাড়কার জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন, সেই সঙ্গে তার শক্তির উৎস কী? তাও জানালেন। সুকেতু নামে মহান বীর্যবান যক্ষের কন্যা হলেন এই তাড়কা। সন্তানহীন সুকেতু ব্রহ্মাকে কঠোর তপস্যায় তুষ্ট করে এই কন্যা লাভ করেন। যেহেতু কন্যা, তাই তাকে সবলা করবার লক্ষ্যেই সহস্র হস্তীর বল দান করলেন ব্রহ্মা। যৌবনবতী কন্যা তাড়কাকে সুন্দ নামে জম্ভপুত্রকে সম্প্রদান করলেন সুকেতু।কালক্রমে তাড়কার গর্ভে শাপের প্রভাবে রাক্ষস পুত্র জন্ম নিল। তার নাম মারীচ।ঋষি অগস্ত্যের শাপে সুন্দ নিহত হওয়ার পর প্রতিশোধস্পৃহায় তাড়কা সপুত্র তাঁকে গ্রাস করতে উদ্যত হল।অগস্ত্য তাকে অভিশাপ দিলেন এই রূপ ত্যাগ করে বিরূপা বিকৃতবদনা ভয়ানক রূপ হোক তোমার। রাক্ষসীরূপ লাভের অভিশাপ দিলেন ঋষি।

রাক্ষসত্বং ভজস্বেতি মারীচং ব্যাজহার সঃ ।
মারীচকেও রাক্ষসত্ব লাভ কর এই মর্মে অভিশাপ দিলেন ঋষি অগস্ত্য। রাক্ষসী তাড়কা দারুণ ক্রোধে অগস্ত্যাশ্রম বিনষ্ট করে চলেছে তারপর থেকে। রামচন্দ্রকে বিশ্বামিত্র অনুরোধ করলেন সেই দুর্বৃত্তা রাক্ষসীকে হত্যা কর।

স্ববাহুবলমাশ্রিত্য জহীমাং দুষ্টচারিণীম্।
মানবিক গুণে সমৃদ্ধ কিশোর রামচন্দ্রের দ্বিধাদ্বন্দ্ব পাছে তাঁকে বিচলিত করে হয়তো সেই কারণে যুক্তি-নিষ্ঠ হলেন তিনি।

ন হি তে স্ত্রীবধকৃতে ঘৃণা কার্য্যা নরোত্তম। চাতুর্বর্ণ্যহিতার্থং হি কর্ত্তব্যং রাজসূনুনা।।
নারীহত্যাভয়ে তাড়কা বধকার্যে ঘৃণাবোধ করো না বৃহত্তর স্বার্থে চতুর্বর্ণের মঙ্গলার্থে রাজপুত্রের এটি কর্তব্য। নিষ্ঠুর বা দয়ার্দ্র যে কোন কাজ প্রজাহিতার্থে করণীয়। প্রজাপালনের স্বার্থে দোষযুক্ত পাতকসাধক কর্ম রাজাদের সনাতন ধর্ম।স্ত্রীবধের অনেক উদাহরণ দিয়ে বোঝালেন তিনি।

অধর্মসহিতা নার্য্যো হতাঃ পুরুষসত্তমৈঃ। তস্মাদবলাং জহি ঘৃণাং ত্যক্ত্বা মচ্ছাশনান্নৃপ।।

ছবি: সংগৃহীত।

অধর্মাচারিণী রমণীদের বিনাশ করেছেন অনেক পুরুষোত্তম মহাত্মা। আমার নির্দেশক্রমে ঘৃণা পরিহার করে তুমি তাকে হত্যা করো। রামচন্দ্র গুরুজনসমক্ষে পিতার আজ্ঞা পালন করবেন অঙ্গীকার করেছিলেন। রাজা দশরথের পুত্রের প্রতি আদেশ ছিল, বিশ্বামিত্রবচন রামচন্দ্রকে নির্দ্বিধায় পালন করতে হবে। অতএব পিতার আদেশে তিনি বিশ্বামিত্রের নির্দেশ পালন করবেন অবশ্যই।রামচন্দ্রের ধনুর টংকারে তারকা আবির্ভূত হল। রামচন্দ্র ভীষণদর্শনা ভীতি উদ্রেককারিণী তাড়কাকে দেখে নারী হত্যায় বিমুখ হয়ে তারকার নাক ও কান ছেদন করে তাকে পালাতে দিতে চাইলেন। তা পরোয়া না করে ধূলিজাল বিস্তার করে মায়াবলে শিলাবৃষ্টি শুরু করল তাড়কা। আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে আরও ভয়ংকর হতে পারে রাক্ষসী,তাই ঋষি বিশ্বামিত্র উপদেশ দিলেন, অবিলম্বে তাকে বধ কর।

বধ্যতাং তাবদেবৈষা পুরা সন্ধ্যা প্রবর্ত্ততে।
শরজালে তাড়কাকে অবরুদ্ধ করে রামচন্দ্র তার হৃদয় বিদ্ধ করলেন। তাড়কানিধন সম্পন্ন হল। নির্বিঘ্নে রাত্রি অতিবাহিত হল সেই আশ্রমে। রামচন্দ্র তাড়কা নামক অশুভ শক্তিবধে অতিপ্রাকৃত শক্তির পরিচয় রাখলেন। তবে তাঁর জীবনপথের এই অভিমুখে বিমুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়, প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রশ্নে প্রশ্নে মুখর এক সদ্য কৈশোরকাল সমুত্তীর্ণ ভাবী রাজা, অসীম তাঁর সোৎসাহ জিজ্ঞাসা। প্রশিক্ষক বিশ্বামিত্র, গুরুতুল্য শুভাকাঙ্ক্ষী। তিনি নদীর উৎসমুখ, বিশেষ বিশেষ স্থানমাহাত্ম্য, অরণ্য উদ্ভবের ঐতিহাসিক কারণ আন্তরিকভাবে বর্ণনা করেছেন নিষ্ঠাভরে। একজন কৌতূহলী বালকের অসংখ্য জিঙ্গাসার উত্তর দিয়েছেন পরম ধৈর্য্যে। সার্থক রামচন্দ্রের ব্রহ্মর্ষির পথনির্দেশে এই অভিযাত্রা। তাড়কা স্বামী হারিয়ে পাগলিনীপ্রায় হয়ে অগস্ত্য ঋষির আশ্রমে বিধ্বংসী আঘাত হেনেছে। তার স্বামী হত্যার এই প্রতিশোধস্পৃহা অমূলক নয়। তাড়কার নৈতিক অধঃপতন হয়েছে ঋষি অগস্ত্যের অভিশাপে।যক্ষিণী থেকে রাক্ষসী হয়েছে সে।তার মনে নৈরাশ্যের হাহাকার,প্রতিশোধস্পৃহা স্বাভাবিক।তবে হত্যার বদলে হত্যা কোন যুগে কোন সভ্যতাতেই সমর্থনীয় নয়। মানবিকগুণে সমৃদ্ধ কোমলপ্রাণ রামচন্দ্রকে কঠোর হতে শিখিয়েছেন বিশ্বামিত্র। প্রাণঘাতী যে হিংসা তাতে অংশ যে নেয় তার ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য নয়, নারী বলে সে ক্ষমাযোগ্য নয়। নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের দ্বন্দ্বে ভবিষ্যতে মানবধর্মকেই বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছেন রামচন্দ্র,দু একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছাড়া। রাজধর্মপালনের স্বার্থে কয়েকটি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রামচন্দ্র, এমনকি নিজের স্ত্রীর ক্ষেত্রেও কঠোরতা হ্রাস পায়নি তার। বিশ্বামিত্র কী নিরপেক্ষ রাজধর্মে দীক্ষিত করলেন প্রজানুরঞ্জক রামচন্দ্রকে?—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content