রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

রাম, লক্ষ্মণ, সীতা শেষে এসে পৌঁছলেন অগস্ত্য মুনির আশ্রমে। দণ্ডকারণ্যের বনরাজি যেন তার সমস্ত বৃক্ষসম্পদ একত্রিত করে বিরাজ করছে এই স্থানে। বিচিত্র সুন্দর বনজ গন্ধে ভরে আছে চারিদিক। চলার পথে রাম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে লক্ষ্মণকে দেখাচ্ছেন, চেনাচ্ছেন সে সকল বৃক্ষরাজি। তিনিশ, নিম, মহুয়া, আম, জাম, কাঁঠাল, আমলকি, তাল, শাল, পিয়াল, বদরী, দাড়িম, করবী, অশোক, শিরীষ, মুচকুন্দ, চাঁপা, সপ্তপর্ণী— কোনও গাছ নেই সেখানে! ফুলের ভারে নুয়ে আছে তরুলতা।

পুণ্যকর্মা মহাতপা মহর্ষি অগস্ত্য। তাঁর প্রবল প্রতাপে নিশাচর রাক্ষসেরা দণ্ডকারণ্যের এই দক্ষিণভাগকে সভয়ে পরিত্যাগ করেছে। ফলে এখানে নিশ্চিন্তে দিন যাপন করতে পারেন মুনি-ঋষিরা। রামের ইচ্ছা, বনবাসের বাকি দিনগুলো এই আশ্রমের কাছেই কাটিয়ে দেবেন। অগস্ত্য মুনি তাঁদের সাক্ষাৎ পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। নিজেই যথাবিধি অতিথিসেবা করলেন। বনের ফল-মূল, ফুল, জলের সঙ্গে অর্চনা করে রামকে তিনি দিলেন বিশ্বকর্মার সৃষ্ট বৈষ্ণব ধনু, ব্রহ্মদণ্ড নামক সূর্যপ্রভ অমোঘ বাণ, অক্ষয় বাণে পূর্ণ তূণীর, স্বর্ণময় কোষে বদ্ধ মহাখড়্গ। দেবরাজ ইন্দ্রের কাছ থেকে পাওয়া এই অস্ত্রসম্ভারের যোগ্য উত্তরসূরী তিনি রামকেই মনে করলেন। বিদেহরাজনন্দিনী সীতা স্বামীর প্রতি একান্ত অনুরাগবশতই দীর্ঘ বনবাসের দুঃখ হাসিমুখে সহ্য করছেন, একথা রামকে অগস্ত্য স্মরণ করিয়ে দিলেন। সীতার প্রশংসা করে মুনিবর বললেন, নিষ্কলুষ, অপাপবিদ্ধা সীতা অরুন্ধতীর মতোই প্রশংসনীয়া। বনে ইনি যাতে সুখে দিন কাটাতে পারেন, তার জন্য রামকে সচেষ্ট থাকার উপদেশ দিলেন তিনি।
অগস্ত্যের আশ্রমে থাকার অনুরোধ করলেও রাম তাতে সম্মত হননি। তার পরিবর্তে অগস্ত্যের কাছ থেকে জেনে নিলেন বসবাসের উপযুক্ত অপর একটি স্থানের কথা। অগস্ত্যের আশ্রম থেকে দুই যোজন দূরে পঞ্চবটী নামক স্থান। সেখানে রয়েছে অপর্যাপ্ত ফলমূল, খাদ্য সম্ভার, সুপেয় জলের সরোবর। আছে বন্য পশুর দল। আর অল্পদূরেই আছে গোদাবরী নদী। অগস্ত্য বললেন, সেখানে আশ্রম তৈরি করে তাঁরা সুখে দিন কাটাতে পারবেন। পঞ্চবটীর মনোরম পরিবেশ সীতার জন্যও আনন্দদায়ক হবে। আবার সেখানকার তপস্বীদেরও রাম রক্ষা করতে পারবেন। ফলে রামের মনোবাসনাও পূর্ণ হবে। অগস্ত্যের দিক নির্দেশে রমণীয় সেই স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন তিনজন।

পথে দেখা হল বিরাটকায় পক্ষিরাজ জটায়ুর সঙ্গে। এমন বিশাল চেহারার প্রাণী দেখে কৌতূহল জাগল তাঁদের। রাম জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর পরিচয়। জটায়ু বললেন, প্রজাপতি কশ্যপের পত্নী ছিলেন দক্ষের আটজন কন্যা। তাঁদের মধ্যে তাম্রার কন্যা হলেন শ্যেনী, শ্যেনীর কন্যা বিনতা। বিনতার পুত্র গরুড় আর অরুণ। তিনি হলেন অরুণের পুত্র পক্ষিরাজ জটায়ু। তাঁর অগ্রজের নাম সম্পাতি। রাম আশ্চর্য হলেন শুনে, জটায়ু পিতা দশরথের বন্ধু ছিলেন। এই অপরিচিত পঞ্চবটী বনে জটায়ু তাঁদের রক্ষা করবেন বলে আশ্বাস দিলেন। পিতৃতুল্য পক্ষিরাজের প্রতি যোগ্য সম্মান জানিয়ে তাঁর সহায়তায় তাঁরা তিনজনে পঞ্চবটীতে প্রবেশ করলেন।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৪: ইল্বল-বাতাপির বিনাশ কাহিনি

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩: যার কাছে টাকা-পয়সা থাকে এ জগতে সেই হল পণ্ডিত

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন

রামের অভিমত নিয়ে উপযুক্ত স্থানে বিরাট এক পর্ণকুটীর গড়ে তুললেন লক্ষ্মণ। পঞ্চবটীর শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ। কুটীরের কাছেই এক পদ্মে ঢাকা সরোবর। বাতাস বয়ে আনে তার সুগন্ধ। চন্দন, পিয়াল, বকুল, শমী, পলাশ, পাটল- কত না বৃক্ষরাজি ঘিরে রয়েছে পর্ণশালা। উড়ে বেড়ায় ময়ূরের দল, লতাবিতানের চন্দ্রাতপের নিচে নিঃশব্দে আস্তরণ বিছায় ঝরে পড়া কুসুমরাজি। বনের পশুরা দল বেঁধে ঘোরাফেরা করে চারপাশে। কাছেই দীর্ঘদেহী গাছ আর সবুজ লতাগুল্মে ঢাকা মাথা-উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এক পর্বত। তার গায়ের ধাতুপ্রস্তরে সোনা, রূপো, তামা আর লোহার বিচিত্র বর্ণ। তার গুহাকন্দরে আশ্রয় নেয় কত পশুপাখি। অদূরে বয়ে চলে গোদাবরী নদী। সূর্যের কিরণে তার জলে সোনার রঙ ধরে। জলের ধারে উড়ে বেড়ায় শ্বেতহংস, সারস, চক্রবাক। দল বেঁধে জল খেতে আসে হরিণেরা। নদীর দুই তীরে কুসুমিত বৃক্ষরাজি তার শোভা আরো বাড়িয়ে তোলে। পঞ্চবটীর পাতায় ছাওয়া কুটীরে সুখেই দিন কাটতে লাগল তিন জনের। তাঁরা গোদাবরীর পুণ্যসলিলে স্নান করেন। রম্য এই বনে ঘুরে ফিরে খাদ্য সংগ্রহ করেন। নাগরিক বৈভবের থেকে অনেক দূরে প্রকৃতির পূর্ণ সৌন্দর্যের মধ্যে, শান্ত, রম্য এক বনস্থলীতে নিভৃতে দিন কেটে যায় কোশলরাজপুত্র দাশরথি রাম, লক্ষ্মণের, বিদেহরাজনন্দিনী, কোশলরাজপুত্রবধূ সীতার।

দিন যায়। শরৎ শেষে হেমন্ত আসে বনভূমিতে। এ সময় সূর্য আশ্রয় করেন দক্ষিণ দিক। হেমন্ত দিনে বাতাস হিমস্পর্শ, বসুন্ধরা শস্যপূর্ণ, জল অনুপভোগ্য আর অগ্নি সুখভোগ্য। শস্যক্ষেতে যব, গম আর পাকা ধানের পূর্ণ সম্ভার গৃহস্থের ঘরে ওঠার অপেক্ষায়। জনপদবাসী মানুষের ঘরে নতুন অন্নে হয় নবাগ্রয়ণ যজ্ঞ। ওদিকে ধরণীধর রাজারা প্রস্তুতি নেন যুদ্ধযাত্রার। উত্তরে পর্বতশ্রেষ্ঠ হিমালয়ের তুষারধবল রূপ আরও ঘনীভূত হয়।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩২: মঞ্জু ও অনুভা এসে বললেন, ‘আসুন বিকাশবাবু চু-কিত-কিত খেলি’

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৩: বায়োফ্লক পদ্ধতিতে সফলভাবে মাছচাষ করছে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও তামিলনাড়ু

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৮: গৃহ-সহায়িকার পাঁচালি এবং আমাদের ভদ্র সমাজ

হেমন্তকাল রামের বড় প্রিয়। ভোরবেলা গোদাবরীর পথে চলেছেন তাঁরা তিনজন। তখন নদীর জলে হিমকুয়াশার উত্তরীয়। বনের ঘাসে শিশিরের রেখায় যেন বিন্দু বিন্দু সোনা। রাতভর হিম ঝরেছে পদ্মের গায়ে। হৈমন্তী স্পর্শে তার রূপ আজ মলিন। এমন দিনে লক্ষ্মণের মনে পড়ছে, নন্দিগ্রামে ভরতের কৃচ্ছসাধনের কথা। এই হিমেল দিনে রাজসুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে সেও তো কত কষ্ট করছে। তার কষ্টও তো কিছু কম নয়।

স্নান সেরে ফিরে এসে কুটীরে পূজাহ্নিক সমাপ্ত হয়েছে। দুই ভাই আর সীতা পর্ণকুটীরে বসে কথা বলছেন। এমন সময় জটায়ু এলেন সেখানে। বিদায় নিলেন তাঁদের কাছে। তিনি কিছুদিনের জন্য নিজের আবাসে যাবেন তাঁর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। বারবার সাবধানতা অবলম্বনের উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন জটায়ু।

এমন সময় সেখানে উপস্থিত হল বিকটদর্শনা রাক্ষসী শূর্পনখা। সম্পর্কে রাক্ষসরাজ রাবণের বোন সে। বিকট আকৃতি তার, বয়সে সে বৃদ্ধা, অপ্রিয় তার দর্শন, তাম্রবর্ণ কেশপাশ, কর্কশ তার মুখের ভাষা। আড়াল থেকে রামের প্রতি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। দেবতুল্য এই মানবপুত্রের রূপে আবিষ্ট হল তার মন। তার দৃষ্টিতে কামনার স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু রামের পাশে শ্রীমণ্ডিতা পত্নী সীতাকে দেখে জেগে উঠল তার ঈর্ষ্যা। শূর্পনখা জানে রাক্ষসদের আছে মায়াশক্তি। তার সাহায্যে সে হয়ে উঠল পরমা সুন্দরী মোহিনী নারী। সে ভাবতে লাগল, শর্মিষ্ঠা রাজা যযাতিকে যেভাবে রূপের মোহে বশীভূত করেছিলেন, আমিও সেভাবে রামকে বশ করব। তারপর রামের সামনে আবির্ভূত হল সেই মায়াবিনী রূপ ধরে। রামকে প্রশ্ন করে জানল তার পরিচয়। রামও অরণ্যে একাকী নির্ভয়ে ভ্রমণকারী এই নারীর পরিচয় জানতে চাইলেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৮: শুঁটকি মাছে কি আদৌ কোনও পুষ্টিগুণ আছে?

হেলদি ডায়েট: এই গরমে চুলের যত্ন নেওয়ার জন্য রইল ১০টি জরুরি টিপস

বিবাহিত? প্রেমের সম্পর্কে রয়েছেন? জেনে নিন গ্রহের স্থান কিরকম থাকলে সম্পর্ক মজবুত ও মসৃণ হয়

তখন রাক্ষসী বললে, “আমি শূর্পনখা। এই বনে একাই ঘুরে বেড়াই আমি। মহাবলী রাক্ষসরাজ রাবণের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। আমি তাঁরই বোন। প্রচণ্ড শক্তিধর, দীর্ঘনিদ্র কুম্ভকর্ণ, রাক্ষস-আচাররহিত ধর্মাত্মা বিভীষণ, বিকটদর্শন মহাশক্তিশালী খর এবং দূষণ—এঁরাও আমার অগ্রজ। এই বনে সকলে আমাকে ভয় পায়। রাম, আমি তোমার প্রতি কামাসক্তা। তুমি সীতাকে ত্যাগ করে আমাকে পত্নী রূপে গ্রহণ করো। সীতা কুশ্রী, বিকৃত আকৃতির নারী। রূপে গুণে সে তোমার যোগ্য নয় বলেই দেখতে পাচ্ছি। তোমার সহচর ভাই আর কুদর্শনা সীতাকে আমি খেয়ে ফেলব। তারপর তুমি আর আমি ইচ্ছা মতো ঘুরে বেড়াব দণ্ডকারণ্যের বনে বনে, পাহাড়ের শিখরে শিখরে।

মায়ারূপধারিণী রাক্ষসী, কিন্তু তার প্রেম নিবেদন অকপট। সে ভাবের প্রকাশে কিছু মাত্র দ্বিধা নেই, জড়তা নেই। রাক্ষসীর প্রেম বিপদের অশনি সংকেত নিয়ে এল রামসীতার নিভৃত বনবাস জীবনে। পঞ্চবটীর শান্ত স্নিগ্ধ দিনের আয়ু কি ফুরিয়ে এল তবে? রামের ক্রোধ না কি পরিহাসের তীক্ষ্ণ বাণে বিদ্ধ হল রাক্ষসীর হৃদয়?—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content