রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


ছবি: ডাঃ অর্কমিতা ভট্টাচার্য

শুঁটকি মাছ। নাম শুনলেই নাক সিটকোন অনেকেই। পাড়ায় কোনও বাড়িতে শুঁটকি মাছ রান্না হলে আশেপাশের বাড়িতেও সেই ঘ্রাণ ছড়িয়ে যায়। এই মাছের প্রিপারেশন বাঙালদের মধ্যে বেশি প্রিয় হলেও বাঙাল-ঘটি সবার কাছেই দিন দিন এই মাছের ডিশের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। যে কোনও মাছই বাঙালিদের কাছে একটি ভীষণ প্রিয় খাদ্য। শুধু স্বাদ নয়, এর পুষ্টিগুণেরও কোনও তুলনা নেই। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সাধারণ মাছের পুষ্টিগুণগুলো কি শুঁটকি মাছেও পাওয়া যায়, নাকি শুঁটকি মাছ লোকে নিছক মুখের স্বাদেই খায়!
মাছ একটি প্রোটিন প্রধান খাদ্য, কিন্তু মাংসের থেকে অনেক বেশি পুষ্টিকর। এতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রোটিন ছাড়াও পর্যাপ্ত ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, লোহা, ফ্লোরাইড ইত্যাদি নানা ধরনের খনিজ লবণ থাকে। কার্বোহাইড্রেট থাকে খুব সামান্য পরিমাণে, দুই থেকে আট গ্রামের মতো। ইলিশ মাছ (১৯ শতাংশ) বাদে সব মাছে ফ্যাট থাকে সামান্যই। সামুদ্রিক মাছে প্রচুর আয়োডিনও থাকে। ১০০ গ্রাম মাছ থেকে শক্তি পাওয়া যায় ৭৫ থেকে ২৭৫ কিলো ক্যালরি। ছোট মাছে কম ক্যালরি মেলে। সবথেকে বেশি ক্যালরি পাওয়া যায় ইলিশ মাছ থেকে, প্রতি ১০০ গ্রামে ২৭৩ কিলো ক্যালরি।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৭: গরমে পান্তা ভাত কি সত্যিই শরীর ঠান্ডা করে?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩: যার কাছে টাকা-পয়সা থাকে এ জগতে সেই হল পণ্ডিত

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন

শুঁটকি মাছ মানে কিন্তু নষ্ট হয়ে যাওয়া মাছ নয়। এ হল তাজা মাছে নুন মাখিয়ে কড়া রোদে শুকনো মাছ। কাজেই এতে মাছের সব পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন থাকারই কথা এবং ভালো করে শুকোনো হলে খুব বেশি গন্ধ থাকারও কথা নয়। তবে ঠিক মতো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এতে নানা বিপত্তি দেখা দেয়। মাছ গেঁজিয়ে উঠে জীবাণু সংক্রমণও হয়। তাছাড়া শুঁটকি মাছকে মুখরোচক করতে যে পরিমাণ তেল ঝাল মশলা এতে দেওয়া হয়, তাতে রসনা পরিতৃপ্ত হলেও, শরীরের পক্ষে সেগুলো ভালো নয়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১২: সকালবেলার আগন্তুক

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৩: বায়োফ্লক পদ্ধতিতে সফলভাবে মাছচাষ করছে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও তামিলনাড়ু

দশভুজা, জীবনে যা কিছু করেছি, প্রত্যয়ের সঙ্গে করেছি: কানন দেবী/২

তবে ঠিক মতো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে শুঁটকির মতো পুষ্টিকর খাদ্য খুব কমই আছে। এর থেকে আশি শতাংশ প্রোটিন পাওয়া যায়, অর্থাৎ সাধারণ মাছের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি। থাকে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা দেহকোষের ক্ষয়রোধ করে এবং আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। পাওয়া যায় প্রচুর সোডিয়াম, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং নার্ভ ও পেশির স্বাভাবিক কাজকর্মের জন্য দরকার। ফসফরাসের পরিমাণও শুঁটকিতে অনেক বেশি থাকে।

আমাদের হাড় এবং দাঁতের গঠনের জন্য ফসফরাস অবশ্যই দরকার, দরকার মস্তিষ্কের বৃদ্ধি এবং কার্যক্ষমতা ঠিক রাখার জন্যও। সেলিনিয়াম নামক আরেকটি জৈব উপাদান শুঁটকিতে প্রচুর পাওয়া যায়। দেহ কোষের ক্ষয় আটকাতে এবং প্রোটিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইম তৈরি করতে এরা সাহায্য করে। বিশেষ ধরনের ভিটামিন নিয়াসিন শুঁটকিতে পাওয়া যায়, যা আমাদের নার্ভ এবং হজমের স্বাভাবিক কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, ত্বকেও পুষ্টি যোগায়। স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ শুঁটকিতে কম থাকে। এক কথায় সাধারণ মাছের তুলনায় শুঁটকিতে প্রোটিন, বিভিন্ন খনিজ লবণ এবং ভিটামিন খুব বেশি পরিমাণে থাকে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৭: কোরবা হয়ে সাতরেঙ্গা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট

ডায়াবিটিস বাগে আনতে কোন প্রোটিন খেতেই হবে, আর কী কী এড়াতেই হবে?

নানা ধরনের মাছের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের চিংড়ি, লইট্যা, টেংরা, ভোলা, খয়রা, নোনা ইলিশ শুঁটকিতে বেশি ব্যবহার হয়। এছাড়া বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ তো আছেই। এই রাজ্যের মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় বহু জায়গায় শুঁটকি মাছের বহু উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। এখানে উৎপাদিত শুঁটকি শুধু এই রাজ্যে নয়, প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশও চালান হয়।

ছবি: ডাঃ অর্কমিতা ভট্টাচার্য

১০০ গ্রাম লইট্যা মাছের শুঁটকিতে প্রোটিন থাকে ৬১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৭৮১ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ২৪০ মিলিগ্রাম, লোহা ২০ মিলিগ্রাম এবং শক্তি মেলে ২৯৫ কিলো ক্যালরি। ১০০ গ্রাম কুচো চিংড়ি থেকে প্রোটিন মেলে ৬২.৫ গ্রাম, ক্যালশিয়াম ৩৫৩৯ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৩৫৪ মিলিগ্রাম, লোহা ২৮ গ্রাম এবং শক্তি মেলে ২৯২ কিলো ক্যালরি।

কাজেই শুঁটকি মোটেও ফ্যালনা খাবার নয়। সপ্তাহে একদিন আপনার খাবার পাতে শুঁটকি মাছ রাখতেই পারেন। একবার ভালোবেসে ফেললে সারা বছর ধরেই খেতে ইচ্ছে করবে। তবে যারা উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির অসুখ বা কোনও জটিল অসুখে ভুগছেন, তারা অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে শুঁটকি মাছ খাবেন।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content