সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


সম্প্রতি কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রকের এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, অসম—এই পাঁচটি রাজ্যে আছে দেশের মোট জলাশয়ের ৬৩ শতাংশ! আবার এদের মধ্যে আমাদের রাজ্য আছে শীর্ষস্থানে। দেশের মোট জলাশয়ের ৩০.৮ শতাংশই রয়েছে বাংলায়।

জলাশয়ের নিরিখে বাকি রাজ্যগুলো কিন্তু এই মুহূর্তে খুব ভালো অবস্থায় নেই। অর্থাৎ পুকুর, খাল, বিল ইত্যাদি তুলনামূলকভাবে খুবই কম। এমনকি জলসংকট কোনও কোনও জায়গায় বেশ তীব্র আকার ধারণ করে গ্রীষ্মের শুরুতেই। এইরকম পরিস্থিতিতেও অর্থাৎ জল বিশেষ পাওয়া যাবে না বা স্বল্প জায়গার মধ্যেই আমাদের পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়ায় মাছ চাষ করতে হবে।
এ সব ক্ষেত্রে ইজরায়েলের বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত বায়োফ্লক প্রযুক্তির প্রয়োগে মাছের উৎপাদন করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি বজায় রেখে মিতানু বা প্রোবায়োটিক প্রয়োগে বড় ট্যাংক বা চৌবাচ্চায় প্রায় কোনও জল পরিবর্তন না করে মাছের উৎপাদন সম্ভব হয়। আসলে বায়োফ্লক হল একটি ভাসমান ভিন্ন ভিন্ন বেশ কয়েকটি উপাদানের সমষ্টি। এই উপাদানগুলির মধ্যে আছে যেমন— ক্ষুদ্র শৈবাল, প্রাণীকণা, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক আবার আছে বিভিন্ন খাদ্যকণাও। এমনকি মাছের বর্জ্য পদার্থও রয়েছে।

এই পদ্ধতিতে অনবরত অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় অক্সিজেন যোগান দিয়ে বায়োফ্লক বজায় রাখতে হয়। তাই বিদ্যুতের খরচ কিছুটা তো বেশি হবেই। এছাড়া শুরুতেই অনেকগুলো উপকরণ লাগে, যেগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করলাম। এদের সামগ্রিকভাবে মোট দাম ১০ হাজার টাকা বা তার কিছু বেশি হতে পারে। এর মধ্যে আছে এয়ার পাম্প মেশিন, সিলিকন পাইপ, এয়ার স্টোন, স্টোন অ্যাটাচমেন্ট, এয়ার কন্ট্রোলার, জল পরীক্ষার কিট, বিশেষত অ্যামোনিয়া নাইট্রেট, নাইট্রাইট ইত্যাদি। আর লাগবে ডিজিটাল থার্মোমিটার, ডিজিটাল পিএইচ মিটার, ডিজিটাল অক্সিজেন মিটার, টিডিএস মিটার, প্রোপেলার ট্যাংক, পাইপ কানেক্টর, গেট ভাল্ভ, জিআই নেট, মেমব্রেন শিট, ইম্হ্ফ কোন, মোলাসেস, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, প্রোবায়োটিক্স, মাছের খাবার, মাছের পোনা ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি সর্বক্ষণ ইলেকট্রিক সাপ্লাই অব্যাহত রাখতে একটি ইনভার্টার প্রয়োজন।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫২: প্রাকৃতিক উপায়ে মাছের ফলন বাড়াতে পুকুরে উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণার ভারসাম্য ঠিক রাখা জরুরি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮: রামচন্দ্রের কৈশোর, ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র: এক অনন্য উত্তরণ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬০: রাতদুপুরে বিপন্নকে বাঁচাতে হাটখোলার পাট আড়তের টাকা এসেছিল জোড়াসাঁকোয়

এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরুর আগে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা অর্জন অত্যন্ত জরুরি। দক্ষতা অর্জন না করে বিশেষ করে ফ্লকের সম্পর্কে ধারণা, তার ঘনত্বের পরিমাপ, জলের গুণমান পরীক্ষা, খাবারের পুষ্টিগুণ বিচার, সঠিক প্রয়োগ পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষ ধারণা দরকার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইউটিউবের প্রচার দেখে বিনিয়োগ করে অনেকে বিফল হয়েছেন। এর অন্যতম কারণ, বিষয়টিকে ভালোভাবে না জেনে, হাতেকলমে প্রশিক্ষণ না নিয়ে প্রচুর বিনিয়োগ করে মাছ চাষের উদ্যোগ নেওয়া অনুচিত।

রাজ্যের সিএডিসির তমলুক প্রজেক্ট সেন্টার, রামকৃষ্ণ মিশনের কেভিকের খামার, আইসিএ আর-এর ভুবনেশ্বর মত্স্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিয়ে যাঁরা কাজ শুরু করেছেন তাঁরা সকলেই সফল হয়েছেন।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৭: অর্থনীতির প্রান্তিকতায় নারী এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১২: সকালবেলার আগন্তুক

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

যে সমস্ত জায়গায় জল সংকট আছে, আমাদের রাজ্যে বিশেষত লাল মাটি অঞ্চলে—এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। বায়োফ্লকের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ইম্হফ্কোণের সাহায্যে। এখানে এক লিটার জল ভর্তি করে ৩০ মিনিট স্ট্যান্ডে রেখে তারপরে ফ্লকের আয়তন দেখা হয়। ফ্লকের আয়তন বা ঘনত্ব ঠিকমতো না হলে তা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন মতো মিতাণু, ইস্ট, চিটাগুড় ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। আবার মনে রাখতে হবে এর জন্যে অবশ্যই প্রাথমিক প্রশিক্ষণ চাই। এই ক্ষেত্রে এটি বিশেষ জরুরি।
বিভিন্ন দেশে বিশেষত সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, তাইল্যান্ড—এইসব জায়গায় এই চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। আমাদের দেশেও অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা, তামিলনাড়ু —এইসব জায়গাতেও এই পদ্ধতিতে সফলভাবে মাছচাষ বেশ ভালো হচ্ছে। মাছের উৎপাদনও আশানুরূপ।

এক এক জায়গায় এক এক ধরনের মাছের দাম বেশি। শোল, ল্যাটা, কই প্রভৃতির যেমন কোনও কোনও জায়গায় দাম ভালো পাওয়া যায়। আবার মনোসেক্স তেলাপিয়ার দামও ভালো পাওয়া যায়। এই সব কিছু নজর রেখে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে আয়ের একটা পথ নিশ্চয়ই পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৭: কোরবা হয়ে সাতরেঙ্গা

হাঁসফাঁস গরমে মুখে রুচি নেই, কোন কোন টক জাতীয় খাবারে স্বাদ ফিরে পাবেন?

উৎসবের উষ্ণতায় শারুল-শিমুল

সব থেকে সুবিধা হল অল্প জায়গায়, প্রয়োজনে বাড়ির ছাদেও বায়োফ্লকে মাছ চাষ করা সম্ভব। মাছ যেগুলি ছাড়তে হবে একটু বড় হলে ভালো হয়। কিছু মাছ আছে, যাদের পুরুষ মাছ খুব দ্রুত বাড়ে। সে ক্ষেত্রে পুরুষ মাছ বেছে বেছে নিয়ে ছাড়তে পারলে ভালো হয়। মাগুর, শিঙির সাধারণত খুবই মন্থর গতিতে বাড়ে। আবার কই মাছ বা ভিয়েত কই বা গিফট তেলাপিয়া খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। এই সব মাছগুলি যদি পাওয়া যায় বায়োফ্লক পদ্ধতিতে এদের চাষ করা যেতেই পারে।

মনে রাখতে হবে, মাছের বাজার দর তুলনামূলক ভাবে বেশি নয়, সেই মাছ বায়োফ্লক পদ্ধতিতে চাষ করলে লাভবান হওয়া কঠিন। তাই ভাবনাচিন্তা করে এই পদ্ধতি গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়। স্বনির্ভর কর্মসংস্থানের একটি নতুন দিশা এটি, বায়োফ্লক সম্বন্ধে একথা বলা যেতেই পারে।—চলবে
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content