রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

প্রাচীনকাল থেকেই নারকেল গাছকে ভারতীয়রা প্রাচুর্য বৃক্ষ বলে মনে করেন। কারণটা অবশ্য এই গাছের ব্যাপক পরিমাণে ব্যবহার। নারকেল গাছের কাণ্ড, পাতা, ফল ,ফলত্বক প্রতিটি অংশই মানুষের খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র, জ্বালানি ইত্যাদির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

এই নারকেল গাছের উৎপত্তি নিয়ে একটি পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে যার সামান্য বিবরণ পাঠকদের শোনাবো। সূর্যবংশের এক প্রজাদরদী রাজা ছিলেন সত্যব্রত। তাঁর একটাই আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, তিনি মৃত্যুর পূর্বে এই নশ্বর দেহ নিয়ে একবার স্বর্গে আরোহন করবেন। মুনিবর বিশ্বামিত্র ছিলেন সত্যব্রত এর খুবই ঘনিষ্ঠ। তাই মুনিবর বিশ্বামিত্র সত্যব্রত এর মনোবাঞ্ছাপূরণে সাহায্য করলেন। একসময় সত্যব্রতর দেহ মেঘে রাজ্য ভেদ করে পৃথিবী পেরিয়ে স্বর্গলোকের দরজায় গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র ভীষণভাবে রুষ্ট হয়ে গিয়ে এক ধাক্কায় রাজাকে নিচের দিকে ঠেলে দিলেন। ফলস্বরূপ নীচের দিকে সত্যব্রত পড়তে লাগলেন। সেই সময় ভীত রাজা মুনিবরকে স্মরণ করতে থাকলেন। তখন বিশ্বামিত্র মুনি রাজাকে আকাশে ভেসে থাকার বরদান করলেন এবং নীচ থেকে লম্বা একটি স্তম্ভ দাঁড় করিয়ে দিলেন। এই ভাবেই সেই স্তম্ভ নারকেল গাছে এবং সত্যব্রত-র মস্তক নারকেলে পরিণত হল। ত্রিশঙ্কু হয়ে যুগ যুগ ধরে তাই ঝুলে আছে নারকেল ফল।
বিভিন্ন কারণবশতই বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের কাছে নারকেল খুবই পবিত্র বৃক্ষরূপে আজও পুজো পেয়ে আসছে। কেরলের সাধারণ মানুষের কাছে নারকেল গাছ হল দেববৃক্ষ অর্থাৎ স্বর্গের বৃক্ষ। ভগবান পরশুরাম, প্রথম মালাবার সমুদ্র উপকূলের লোকেদের বাঁচানোর জন্য এবং তাদের ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্য বৃদ্ধির জন্যই স্বর্গের দেবরাজকে মর্ত্যে আনেন। কেরল জায়গার নামকরণও সেই মতো হয়। ‘কেরল’ শব্দটির অর্থ হল নারকেল স্থল।

পশ্চিম ভারতের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা সমুদ্রের দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য নারকেল উৎসর্গ করেন। শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার মহারাষ্ট্রের মৎস্যজীবীরা, “নারকেল পূর্ণিমা উৎসব” পালন করেন। ওই দিন একটি নৌকাকে সুন্দর করে সাজিয়ে সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নারকেল উৎসর্গ করে এই আশা রাখা হয় যে, সারা বছর তাদের জালে যেন প্রচুর মাছ ধরা দেয়।

উত্তর ভারতে যখন কোনও নারী অন্তঃসত্ত্বা হতে চান, তখন তিনি মন্দিরে গিয়ে মন্দিরের পূজারীর হাতে থেকে একখানা নারকেল গ্রহণ করে, আসন্ন সন্তানের মঙ্গলার্থে। দক্ষিণ ভারতীয়রা বিয়ের রাত্রে অথবা নবরাত্রির সময় নারকেল বিতরণকে পুণ্য কাজ বলে মনে করেন।

গুজরাতে বিয়ের আচার অনুষ্ঠানের সময় কনে তার স্বামীকে একটি নারকেল প্রদান করে, যেই নারকেলটি স্বামী সারা জীবন ধরে নিজের কাছে একটি মূল্যবান স্মৃতিস্বরূপ সংরক্ষণ করেন। নারকেল হল শুভ প্রতীক। তাই এর মাধ্যমে নব দম্পতি নববিবাহিত জীবনের উর্বরতা কামনা করেন।

পূর্ব এবং উত্তর ভারতের ধর্মীয় আচরণে ডাব অর্থাৎ কচি নারকেলকে সৌভাগ্য ও ঐশ্বর্যের প্রতীক হিসাবে মানা হয়। একটি ঘটকে জলপূর্ণ করে বা কখনও ধান পূর্ণ করে তার মাথায় একটি আম্রপল্লব রাখা হয় এবং আম্রপল্লবের ওপর একটি শীর্ষ যুক্ত ডাব রাখার প্রথা প্রচলিত আছে। একে বলা হয় পূর্ণকুন্ড যা হলো দেবী লক্ষ্মীর প্রতিরূপ।

মহীশূরের লোকজন নারকেল বৃক্ষকে পারিবারিক দেবতা বলে গণ্য করেন এবং তার পুজো করেন। মহারাষ্ট্রের কোঙ্কন অঞ্চলের মানুষজন নারকেল বৃক্ষকে দেবতার রূপে সংরক্ষণ করেন, পুজো করেন। কারণটা হল তাঁদের পূর্বপুরুষকে স্মরণে রাখার জন্য। এই ভাবেই সমগ্র ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন লোকসংস্কৃতিতে নারকেল গাছকে দেবতা স্থানে উন্নীত করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:

রোজ খাওয়ার পরে পান খান? অনেক ওষুধ কেনার খরচ বেঁচে যেতে পারে

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: উদ্বেগের সমস্যায় ভুগছেন? এতে আপনার পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে না তো?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৭: গরমে পান্তা ভাত কি সত্যিই শরীর ঠান্ডা করে?

 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: কোকস নুসিফেরা।
● গোত্র: অ্যারিকেসি।
● বাংলা নাম: নারকেল।
● ইংরেজি নাম: কোকোনাট।
● গাছের প্রকৃতি: নারকেল গাছটি হল গুপ্তবীজী, একবীজ এবং শাখান্বিত উঁচু বৃক্ষ। উদ্ভিদের শীর্ষে চারিদিকে ছড়ানো বড় বড় পাতা থাকে যা, এক পক্ষল প্রকৃতির। পুষ্পবিন্যাস যৌগিক মেসামঞ্জরি বা স্প্যাডিক্স ধরনের হয়। ফলের অভ্যন্তরে ডাবের জল ও শাঁস হল আসলে শস্য।
● গাছের বিস্তৃতি: নারকেল গাছ এশিয়া মহাদেশ-সহ প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী প্রায় ৯০% দেশগুলোতে বিস্তৃতি লাভ করেছে। সমগ্র পৃথিবীজুড়ে উৎপাদিত নারকেলে প্রায় আশি শতাংশ জন্মায় ফিলিপিনস, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মেলানেশিয়া, তাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নিউগিনি ইত্যাদি দেশে।
 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

প্রতি ১০০ গ্রাম নারকেলে উপস্থিত কার্বোহাইড্রেট পরিমাণ ১৫ গ্রাম, প্রোটিন আছে ৩.৫ গ্রাম, ফ্যাট আছে ৩৩ গ্রাম, সোডিয়াম আছে ২০ মিলিগ্রাম এবং পটাশিয়াম আছে ৩৫৬ মিলিগ্রাম। এছাড়াও রয়েছে ক্যালশিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-বি৬ এবং ভিটামিন বি১২। ১০০ গ্রাম নারকেলে মোট শক্তির পরিমাণ ৩৫৪ ক্যালরি।

আরও পড়ুন:

পর্ব-৮: সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত গান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন পঞ্চম

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬০: রাতদুপুরে বিপন্নকে বাঁচাতে হাটখোলার পাট আড়তের টাকা এসেছিল জোড়াসাঁকোয়

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৭: অর্থনীতির প্রান্তিকতায় নারী এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে এর ব্যবহার

 

প্রোস্টেটের সমস্যায়

আয়ুর্বেদশাস্ত্র মতে নারকেলের গুণ নিয়ে বহু মতামত রয়েছে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের কথায়, প্রোস্টেট গ্রন্থি স্ফীত হলে নারকেল গাছের কচি মূল ছেঁচে রস করে, সকালে ও বিকালে এক চা চামচ করে দুধ মিশিয়ে খেলে সাত থেকে আট দিনের মধ্যে উপকার পাওয়া যাবে।
 

আমাশয় রোগ প্রতিরোধে

আমাশয়ের ফলে পেটে বায়ু সৃষ্টি হলে এবং পেট ভার হয়ে থাকলে কচি ডাবের জল খেলে তা থেকে উপকার পাওয়া যায়। কিন্তু জল মিষ্টি হয়ে গেলে এই উপকার পাওয়া যায় না।
 

হাড় ও দাঁতের সমস্যায়

নারকেলে উপযুক্ত পরিমাণে ক্যালশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম থাকে, তাই নারকেল খেলে হাড়ের গঠন মজবুত হয়। নারকেল দাঁতের জন্যও উপকারী। দাঁতের মাড়ি ফুললে নারকেলের মূল পুড়িয়ে তাকে কয়লা বানিয়ে তার সঙ্গে ফটকিরি ও কর্পূর মিশিয়ে মিহি করে গুঁড়ো করে নিতে হবে। তারপর সেই মিশ্রণ দিয়ে ধীরে ধীরে দাঁত মাজলে এই সমস্যা দূর হয়ে যায় বলে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের ধারণা।
 

হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখতে

নারকেল রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখে। নারকেলে থাকে উপকারী ফ্যাট যা কোলেস্টেরল বাড়ায় না কিন্তু এথেরোসক্লোরোসিসের ঝুঁকি কমিয়ে হার্টকে স্বাস্থ্যবান করে তোলে।
 

ক্যানসার প্রতিরোধে

নারকেলে উপস্থিত যৌগ কোলন ক্যানসার এবং স্তন ক্যানসারের প্রবণতা অনেকাংশে দূর করে। এটি অনিয়মিত ঋতুচক্র কে মেরামত করতে সাহায্য করে।
 

লিভার সুস্থ রাখতে

নারকেলের কচি শাঁস কেটে এবং তারপর বেটে যে দুধ পাওয়া যায় তা লিভারের বিভিন্ন অসুখ নিরাময়ে খুবই কার্যকারী ভূমিকা নেয়। হেপাটাইটিস ও জন্ডিস নিরাময়ে এটি কাজ করে।
 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে

রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নারকেল কার্যকারী ভূমিকা নেয়। তাই ডায়াবেটিস রোগীরা নিয়ম করে পরিমিত পরিমাণে নারকেল খেতে পারেন।

আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১: নাথানিয়্যাল গোবিন্দ সোরেনের গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১২: সে এক ‘বউঠাকুরাণীর হাট’

দেখব এবার জগৎটাকে, পর্ব-১০: জলপথে আমাজন অরণ্যের গহনে

 

প্রস্রাবের সমস্যা নিরাময়

অনেকেরই প্রস্রাবের সঙ্গে চিনির দানার মতো সাদা ক্রিস্টাল বেরিয়ে আসে । এক্ষেত্রে তারা প্রতিদিন সকালে নারকেলের ফোপার দশ গ্রাম বেটে দই সহযোগে খেতে পারেন। তাহলে ক্রিস্টালারা নামক এই রোগ থেকে অনেকটাই মুক্ত হতে পারবে।
 

ত্বক এবং চুল সুন্দর রাখতে

নিয়মিত কাঁচা নারকেলের শাঁস খেলে আমাদের ত্বক কোমল ও সুন্দর থাকবে। এছাড়া ত্বকের বলিরেখাও অনেকটা কমিয়ে দেয় নারকেল। অধিক গরমের সময় নারকেল, ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রেখে আমাদের সৌন্দর্য বজায় রাখে। নারকেল তেল ও চুলের জন্য খুবই উপকারী। নারকেল তেল নিয়মিতভাবে মাথায় ব্যবহার করলে মাথার খুশকি শুষ্কতা এবং চুল পড়া অনেকটাই কমে যায়।
 

হজমের সহায়ক হিসাবে

কচি ডাবের জলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন মিনারেল এবং অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকায় এটি হজম ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। নারকেল রোগ প্রতিরোধেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।

নারকেলের জল থেকে শাঁস সবই বাঙালির প্রিয়। তাইতো ভোজনবিলাসী বাঙালি ঝাল থেকে মিষ্টি সব রকমের রান্নাতেই নারকেল ব্যবহার করে আসছেন সেই প্রাচীনকাল থেকে। ডাব চিংড়ি, নারকেল কুরো দিয়ে মোচার ঘন্ট, ছোলার ডাল বা চালকুমড়োর পদ, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, নারকেল পোস্ত কৌড়া যেমন ছোট বড় সব বাঙালির জিভে জল আনে তেমনিই নারকেলের রকমারির মিষ্টির পদ যেমন পিঠেপুলি, নাড়ু, নারকেলের সন্দেশ, নারকেল কুরো সহযোগে চিঁড়ে ভাজা রয়েছে বাঙালির খাদ্যতালিকার অন্তর্গত।

আর শুধু বাঙালির কথাই বা কেন বলবো? বহু প্রদেশের এবং দেশের লোকই নারকেলকে নিজেদের প্রতিদিনের খাবারে জায়গা দিয়েছে। তাইতো প্রতিবছর ২ সেপ্টেম্বর দিনটি উদযাপন করেন এশিয়ান প্যাসিফিক কোকোনাট কমিউনিটি সংস্থার লোকজনরা। ডাব ও নারকেলের ইতিকথা আজ এখানেই শেষ করলাম, বাকি কথা পরে হবে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content