রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে, তেমন পতঙ্গের স্বভাব আলো দেখলেই তাতে পড়তে চাওয়া, তাতে তাদের প্রাণ যায় যাক। আলোর কোন অভিমান নেই যে পতঙ্গ আলোতে এসে পড়ে। “সেই রকম প্রকৃত ভক্ত ঈশ্বরে গিয়ে পড়েন তাতে তার প্রাণ যাক আর থাকুক ঈশ্বরের কোনও অভিমান নাই। যে তাঁর কাছে আসে তিনি তাকে গ্রহণ করেন। থোড়ের মাজ মাজেরই থোড়। ব্রহ্মই জগত জগতই ব্রহ্ম”।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “অমৃতকুণ্ডে যে কোনও প্রকারে পড়লে পারলেই অমর হওয়া যায়, সেই রূপ ভগবানের নাম যে কোনও প্রকারে নিলেই তাহার ফল হবেই হবে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মধ্যে মধ্যে ‘চৈতন্য চৈতন্য’ শব্দ উচ্চারণ করতেন। একজন তাহাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি চৈতন্য চৈতন্য বলে কাকে স্মরণ করছিলেন? তিনি বলেন, “যে চৈতন্যে জগৎ চৈতন্য আমি সেই চৈতন্যকে স্মরণ করছিলাম।” তিনি দেখতেন, চৈতন্য জগৎ জড়ে রয়েছে। সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় যা কিছু হয়ে চলেছে তা সেই এক চৈতন্য এর মধ্যে। তবে বাসনাশূন্য নির্মল হলে তা অনুভূত হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণে বলেছেন, “বাসনা থাকলে ঈশ্বর দর্শন হয় না। অতএব ছোট ছোট বাসনাগুলি পূরণ করে লবে এবং বড় বড় বাসনাগুলি বিচার করে ত্যাগ করবে।” একজন ভক্ত জিজ্ঞেস করলেন, “কি দিলে ঈশ্বর পাওয়া যায়?” “তন, মন, ধন এ তিন না দিলে হবে না।” কোন সাধক এক সময়ে জোর করে সাধনা করার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত হয়েছিলেন। পরমহংসদেব ওই সময় একদিন তাহার বাটিতে গিয়ে একটি শিশুকে দেখে বললেন, “হ্যাঁ গা এই মেয়েটি কার?” সাধক বিনীতভাবে বললেন “আঁগে আমারই।” পরমহংসদেব বলেন, “বটে বটে তোমার তো বেশ যোগ রয়েছে। তবে আমার তুমি যোগ যোগ বলে ব্যস্ত হও কেন?” শোনা যায়, সেই দিন হতে নাকি সেই সাধক, স্ত্রীসঙ্গ একেবারেই ত্যাগ করে ছিলেন।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১৬: বৈধীভক্তি ছাড়িয়ে রাগভক্তি লাভ হয়

মহাকাব্যের কথকতা,পর্ব-৭: ভারতের উত্তরাধিকার, কৌরব ও পাণ্ডবগণ

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২: এখানে দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, বাণিজ্যনীতি এবং বৈদেশিক নীতির চর্চা করা হয়েছে

স্বামী বিবেকানন্দ ভক্তের করণীয় কি বলেছেন, “ভক্তির প্রথম সোপান তীব্র ব্যাকুলতা। ভক্তি-ঈশ্বরের পরম অনুরক্তি। কিন্তু, মানুষ ঈশ্বরকে ভালোবাসবে কেন?… ভগবান যা হাকে ভালোবাসেন সেও ভগবানকে ভালোবাসে। সে সর্বান্তকরণে তাঁকে আকড়ে ধরে, প্রেমিক স্ত্রী যেভাবে তাহার মৃত পতির চিন্তা করে, পুত্রগণকে আমরা যেভাবে ভালোবাসে থাকি, ঠিক সেই ভাবে আমাদিগকে ভগবানের জন্য ব্যাকুল হতে হবে। তবেই আমরা ভগবানকে লাভ করব। এইসব বই, এইসব বিজ্ঞান, আমাদের কিছুই শেখাতে পারে না। বই পড়ে তোতা পাখি হই। বই পড়ে কেহ পণ্ডিত হয় না। যে ব্যক্তি প্রেমের একটি অক্ষর পাঠ করেছে তিনিই পণ্ডিত। প্রথমেই আমাদের চাই সেই আকাঙ্ক্ষা বা ব্যাকুলতা, আমাদের ঈশ্বরের প্রতি ব্যাকুলতা।”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬০: রাতদুপুরে বিপন্নকে বাঁচাতে হাটখোলার পাট আড়তের টাকা এসেছিল জোড়াসাঁকোয়

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৮: সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত গান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন পঞ্চম

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৩: সীতার মনে কি আশঙ্কার অশনি সংকেত?

আমাদের কাছে ভক্তি প্রার্থনা অনেকটা অর্থ, সম্পদ, খাদ্য চাহিদার মতো আর পাঁচটা বিষয় আমরা যেমন আকাঙ্ক্ষা করি সেই রকম। ভিতর থেকে ব্যাকুলতা বা প্রেম আসে না। প্রতি নিয়ত যেভাবে আমরা নিঃশ্বাস নিয়ে থাকি, প্রতিনিয়ত যেভাবে আমরা আলো নিই, খাদ্য জল গ্রহণ করি, যা ছাড়া আমাদের প্রাণ ধারণ অসম্ভব হবে, যা অভাবে প্রাণ সংশয় হবে, সেই রকম আমরা অভাব অনুভব করি না ঈশ্বরের প্রতি, যা ছাড়া আমাদের বাঁচা অসম্ভব।
আরও পড়ুন:

আমি বনফুল গো: তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৬: রতনপুর মহামায়া দর্শন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৬: গরমে কক্ষনও ডিম খেতে নেই?

ধর্ম বা ঈশ্বর লাভ আর পাঁচটা বিষয়ে লাভের মতো নয়, বা কোন নতুন সামগ্রী নয় যে আমরা দু’ দিনের আকাঙ্ক্ষা করি তারপরে ত্যাগ করে নতুন কিছু গ্রহণ করলাম। ঈশ্বর অনুভূতি বা ধর্ম লাভ, যেমন ছায়া আমরা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বহন করি, যা ক্ষণকালের জন্য আমাদের থেকে পৃথক থাকে না। চেষ্টা করলেও না। সেই রকম ঈশ্বর প্রেম আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আমরা চেষ্টা করলেও ত্যাগ করতে পারি না। চেষ্টা করলে এই শরীরটা, দেহটা ত্যাগ করিতে পারি কিন্তু আমরা ঈশ্বরকে কিছুতেই ত্যাগ করতে পারি না। ভগবানকে ভুলে আমরা থাকতে পারি কিন্তু তিনি কখনোই আমাদের ভুলে থাকেন না।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content