শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

ইনডাইজেশন একটি ইংরেজি শব্দ, যা বাংলায় অজীর্ণ, অপরিপাক বা বদহজম ইত্যাদির সমতুল্য। আয়ুর্বেদ মতে, পেটের মধ্যে পাকস্থলী থেকে নিঃসৃত পাচক রস বা পাচকাগ্নি যখন দুর্বল হয়, তখন ভুক্ত দ্রব্য পাক হতে পারে না বা খাদ্য ঠিকমতো হজম হয় না এবং পেটের নানান সমস্যার সঙ্গে এই অজীর্ণ রোগ নিয়ে আসে। ভারতের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন। সাধারণতঃ পাচকাগ্নি বা জঠরাগ্নি (অ্যাসিড পেপসিন মিশ্রণ) গুণগতভাবে চার রকম। যদি বায়ু, পিত্ত ও কফের সাম্যাবস্থা থাকে তাহলে তা সমাগ্নি বলে পরিচিত হয়, যে ক্ষেত্রে হজমের সমস্যা থাকে না। কিন্তু যদি রোগীর বায়ু দোষ বেশি হয় তাহলে জঠরাগ্নি বিষম হয় এবং বিষমগ্নি বলে পরিচিতি পায়। যদি পিত্ত দোষের আধিক্য হয়, তাহলে তা তীক্ষ্ণাগ্নি (হাইপার ক্লোরো হাইড্রিয়া)। কফ দোষের আধিক্য থেকে অগ্নি মন্দিভূত হয় এবং মন্দাগ্নি (হাইপোক্লোরো হাইড্রিয়া) নিয়ে আসে। তাই বিষমাগ্নি, তীক্ষ্ণাগ্নি ও মন্দাগ্নি হল রোগ উৎপত্তির বিশেষ কারণ। বিশেষ করে অজীর্ণ রোগের জন্য মন্দাগ্নি ই দায়ী। আয়ুর্বেদ অগ্নিবল রক্ষা করার জন্য বিশেষ বিশেষ খাদ্য, পানীয়, আচার-আচরণের নির্দেশ পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছে। কারণ সুস্থ থাকতে গেলে সম্যক ভাবে আহার পাক (ডাইজেশন) প্রয়োজন, না হলে ধাতুপাক (মেটাবলিজম) ও ঠিকমতো হবে না। ফলে রোগীর বল, বর্ণ, উৎসাহ, রস, রক্ত, মাংস,মেদ, অস্থি, মজ্জা, শুক্র ইত্যাদি ধাতুর ঠিক মতো পোষন হবেনা এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বা ওজঃ প্রস্তুত হবেনা।
 

অজীর্ণ রোগের নিদান বা কারণ

আয়ুর্বেদে সমস্ত রোগের কারণই হল খাদ্য খাবার বা পানী্য়ের অপব্যবহার এবং জীবনশৈলীর ত্রুটি-বিচ্যুতি বা মানসিক কিছু বিষয়। সেই রকম অজীর্ণ রোগেও খাদ্য খাবারের অনিয়মের মধ্যে— বেশিক্ষণ খিদে চেপে রাখা, বেশি খেয়ে ফেলা, কড়াপাক, তৈলাক্ত মশলাদার খাবার, বেশি গুরুপাক যেমন পায়েস ইত্যাদি, আগের খাবার হজম না হওয়া সত্ত্বেও খাবার খেয়ে নেওয়া, খাবারের সময় ঠিকমতো মেনে না চলা, বেশি জলীয় খাবার খেয়ে নেওয়া, রীতি বিরুদ্ধ খাবার যেমন মাংসের সঙ্গে দই, মাছ-মাংসের সঙ্গে পায়েস, তেলেভাজা, শুকনো খাবার বেশি খাওয়া, বাসি পচা খাবার খাওয়া, দূষিত খাদ্য বা জলপান, জীবনশৈলীর ত্রুটিগুলি যেমন অত্যধিক পরিশ্রম, দুপুরে ঘুম,অতি শীতল জল পান বা অতি শীতল বাতাসের সংস্পর্শে থাকা, বমন বিরেচন ইত্যাদি ক্রিয়ার অপযোগ। মানসিক বিষয়গুলি যেমন অত্যাধিক ভয়, শোক, ক্ষোভ, চিন্তা, উদ্বেগ, ত্রাস ইত্যাদি কারণে পাচকাগ্নি বা জঠরাগ্নির গুণের বৈষম্য ঘটে এবং অজীর্ণ রোগের উৎপত্তি হয়।

আরও পড়ুন:

জন্ডিসে ভুগছেন? আয়ুর্বেদ মতে ঘরোয়া উপায়ে হবে এর সমাধান!

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১: রাজার ছেলেদের রাজনীতি-কূটনীতি শেখানোর জন্যই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ

শাকুন্তলম্: প্রেমের পরবশ থেকে মাতৃত্বের উত্তরণ

 

অজীর্ণের প্রকারভেদ ও লক্ষণ

সাধারণত চার রকমের অজীর্ণ দেখা যায়
বিষ্ঠব্ধাজীর্ণ— বায়ু দোষের প্রকোপ জন্য।
বিদগ্ধাজীর্ণ — পিত্ত দোষের আধিক্য হেতু।
আমাজীর্ণ—কফ দোষের আধিক্য হেতু।
পাচকাগ্নির মন্দিভূত অবস্থা থেকে উৎপন্ন অপক্ক অন্নরস বা আম থেকে যে অজীর্ণ হয়।
রস শেষাজীর্ণ—খাদ্য সঠিকভাবে পাক হওয়ার পর ও কিছু অবশিষ্ট অংশ পাচিত না হয়ে থেকে যাওয়া।

এই চার ধরনের অজীর্ণ ছাড়াও দিনপাকি অজীর্ণ, প্রাকৃত অজীর্ণ ও অন্নবিষ অজীর্ণের উল্লেখ শাস্ত্রে আছে।
 

অজীর্ণের সাধারণ লক্ষণ

খাদ্য গ্রহণে অনিচ্ছা, অরুচি, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, পায়খানা না হওয়া বা বারবার পায়খানা হওয়া, পেট ভারবোধ, শরীরে ভারবোধ, মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, মূর্ছা যাওয়া, হাই তোলা, বেশি জল তেষ্টা পাওয়া, পেট ফাঁপা, পেটে ব্যথা, জ্বর ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১২: দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ঢুকে পড়লাম নিকটবর্তী একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭: পঞ্চমের কথা মতো ড্রাম ছেড়ে অমরুতের পিঠের উপর স্যাম্পল রিদম বাজাতে শুরু করলেন ফ্রাঙ্কো!

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১২: স্ট্যানলি ম্যাথুজ— একজন কিংবদন্তি, লড়াই আবেগ আর মেহনতী জনতার বন্ধু

 

চিকিৎসা

যেহেতু আয়ুর্বেদ মতে প্রথম চিকিৎসাই হল রোগ হওয়ার কারণ গুলি বর্জন করা। সুতরাং অজীর্ণের যে খাদ্য খাবার, আচার-আচরণ দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোকে ত্যাগ করতে হবে।
 

চূর্ণ হিসাবে

শিবক্ষার, পাচকচূর্ণ, অবিপত্তিকর চূর্ণ, লবণ ভাস্কর চূর্ণ, চতুঃসম চূর্ণ ইত্যাদি ৩ থেকে ৬ গ্রাম দিনে দু’বার গরম জল-সহ খাওয়া যায়।
 

ভস্ম হিসাবে

শঙ্খ ভস্ম ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার গরম জল-সহ খেতে পারেন।
 

ক্ষার হিসাবে

বজ্র ক্ষার বা শ্বেত পর্পটক দিনে দুবার ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম খাওয়া যায়।
 

বটি হিসাবে

সঞ্জীবনী বটি, গন্ধকবটি, অর্কবটি, মহাশঙ্খ বটি একটি (৫০০ মিলিগ্রাম) করে দিনে দু’বার খাওয়া যায়।
 

রসৌষধি হিসেবে

রসৌষধির মধ্যে অজীর্ণ কণ্টক রস, অজীর্ণাদি রস ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার দেওয়া যায়।

 

ক্বাথ বা পাচন হিসাবে

আমলক্যাদি পাচন, পিপ্পল্যাদি পাচন ১৫ মিলিলিটার করে দিনে দু’ বার খাবার পর সমপরিমাণ উষ্ণ জল মিশিয়ে খাওয়ানো যায়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ থাকে যে, দোষ বিচার করে অজীর্ণের প্রকার বুঝে ঔষধি খেলে ভালো ফল পাওয়া যাবে, অন্যথায় বিপরীত ক্রিয়া হতে পারে।

উপরিউক্ত ঔষধি প্রয়োগ ছাড়াও শোধন চিকিৎসা (ডিটক্সিফিকেশন থেরাপি) যেমন বমি করানো, পায়খানা করিয়ে দেওয়া ইত্যাদি ক্রিয়া ও বিশেষভাবে ফলপ্রদ।

আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫১: সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার প্রয়োজন, তবেই বাড়বে মাছ নিয়ে সচেতনতা, উপকৃত হবে আমজনতা

স্বাদে-গন্ধে: একঘেয়ে কাতলা? স্বাদবদল করুন ‘কমলা কাতলা’ রেসিপিতে! রইল সহজ রেসিপি

কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না ভুঁড়ি? অনিয়ন্ত্রিত মেদ কিন্তু ফ্যাটি লিভারের কারণ হতে পারে

 

পথ্য

হালকা সহজ পাচ্য খাবার, মুগ ডালের জল, তেতো স্যুপ, খইয়ের মণ্ড, সজনে ডাঁটা, পটল, আমলকি, মৌরি, শুকনো আদা চূর্ণ, গোলমরিচ, মেথি, ধনে, জিরে, হালকা গরম জল, লেবু নুনের জল, হালকা ব্যায়াম, পায়চারি করা ইত্যাদি।
 

অপথ্য

মটর ডাল, শিম, মাংস, গুরুপাক খাদ্য, মিষ্টি, পায়েস, আলু, জাম, দই, মদ, মলমূত্রের স্বাভাবিক বেগ ধারন করা, উপর্যপুরী খাবার খাওয়া, খাওয়ার সময় জ্ঞান ঠিক না রাখা ইত্যাদি।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content