শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ঢাকায় প্রথম 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'। তখন নাম ছিল 'আনন্দ শোভাযাত্রা'।

বাংলা নববর্ষের চিরায়ত যে ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য তা হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, আদি ও অকৃত্রিম। যদিও বলা হয়ে থাকে যে, সম্রাট আকবরের খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এই ফসলি সনের সূচনা হয়েছে। কিন্তু বহু পূর্ব থেকেই শকাব্দ-সহ বিভিন্ন অব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলা মাস ও বাংলা সন জনসাধারণের জীবনাচারের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এক সময় পয়লা অগ্রায়ণ নবান্ন উৎসবের দিন থেকে বছর গণনা করা হতো। এছাড়াও চৈত্র ও জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে সন গণনার ইতিহাস রয়েছে। যেখান থেকেই গণনা শুরু হোক না কেন, নববর্ষে সবার ভাসনা থাকে, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’।
বাংলাদেশে বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ঢাকার রমনার বটমূল ও চট্টগ্রামের শিরিশতলায় বসে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। মেলা বলিখেলা-সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবের পাশাপাশি মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে জাঁকজমকপূর্ণ প্রধান মঙ্গল শোভাযাত্রাটি বের হয়। দ্বিতীয়টি হয় চট্টগ্রামে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংগঠন-সহ স্কুল কলেজ থেকেও আনন্দপূর্ণ শোভাযাত্রা বের করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় তুলে ধরা হয় বাঙালি সংস্কৃতির নানান দিক। ফুটিয়ে তোলা হয় চিত্র, মুখোশ আর নানা প্রতীকে। প্রতি বছরই এই মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি মূলভাব থাকে। মূলত তা সত্য ও সুন্দরের শক্তিতে সম্প্রীতি ও অশুভের বিনাশ প্রতীক হয়ে ফুটে ওঠে। লক্ষ জনগণ বর্নিল সাজে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। খুব অল্প সময়ে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা নববর্ষের মূল অনুসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যে ভাবে রমনা বটমূলে ছায়ানটের...

বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস পুরনো হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস নতুন বললেই চলে। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয়েছিল যশোরে ১৯৮৫ সালে। দেশের লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা ছিল মূল লক্ষ্য। এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন যশোরের চারুশিল্পী মাহবুব জামাল শামিম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে পড়াশোনা শেষে যশোরে চলে যান। সেখানে চারুপিঠ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। যশোরের সেই চারুপিঠ থেকে শোভাযাত্রার সূচনা হয়।

১৯৮৯ সালে পয়লা বৈশাখে ঢাকার চারুকলা থেকেও শুরু হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুরুতে এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থাকে মাথায় রেখে এমনটা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবেই পরিচিত লাভ করে। সেই শোভাযাত্রার মূলভাব ছিল অগণতান্ত্রিক শক্তির বিনাশ। ওই সময় সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। সবাইকে এক ছাতার নিচে আনার জন্য ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। সবার অংশগ্রহণে একটি বৃহত্তর প্রচেষ্টা হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে উপস্থাপন করা হয়। এখন মঙ্গল শোভাযাত্রা সব ধরনের মানুষের অংশগ্রহণে নববর্ষের প্রধান অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন:

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-১২: পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে

অজানার সন্ধানে: মুছে যাক গ্লানি মুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা…

অণুগল্প: কাজু বরফি

মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্ণিল রঙে রঙিন থাকে। আবহমান বাংলার বিভিন্ন লোকজ উপাদান এই শোভাযাত্রায় ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রা উপলক্ষে হাতে তৈরি করা হয় বিভিন্ন মুখোশ, মূর্তি, ট্যাপা পুতুল, নকশি পাখি, বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। এই শোভাযাত্রাকে শোভিত করার জন্য যে উপাদানগুলো লাগে, সেগুলো শুরু থেকেই নেওয়া হয় দেশের লোকশিল্পের নানা ধরনের খেলনা থেকে। এর বাইরে ঘোড়া, নকশি পাখা, ফুল, প্রজাপতি, মানুষ, প্রকৃতি এগুলো শোভাযাত্রায় স্থান পেতে থাকে।
১৯৮৯ এর প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া ও হাতি। ১৯৯০-এর আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তার নতুন মাত্রা লাভ করে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পী-সহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেন। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালাকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশ খচিত প্ল্যাকার্ড-সহ মিছিলটি নাচে-গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। দিনদিন এই শোভাযাত্রা আরো বর্ণিল হচ্ছে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৪: কাওয়ার্ধা পরিভ্রমণ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৫: শরীর ফিট রাখতে রোজ ভিটামিন টনিক খাচ্ছেন?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

মঙ্গল শোভাযাত্রা ইতিমধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদন ক্রমে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।
ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তাদের ‘রিপ্রেজেনটেটিভ লিস্ট অব ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফলে পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা। এখন এটি বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ। বাঙালি সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।

ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, এটা শুধু একটা সম্প্রদায় বিশেষের নয়, এটা গোটা দেশের মানুষের, সারা পৃথিবীর মানুষের। ২০১৭ সাল থেকে পশ্চিম বঙ্গের বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রচেষ্টায় ‘বাংলা নববর্ষ উদযাপন পরিষদে’র উদ্যোগে কলকাতায়ও মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। কলকাতার গাঙ্গুলিবাগান থেকে শুরু হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাপীঠ ময়দানে যেয়ে শেষ হয় বর্নিল এই মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬: রামচন্দ্রের আবির্ভাব ও বসুন্ধরাকন্যা সীতার অনুষঙ্গ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩১: মরুভূমির উপল পারে বনতলের ‘হ্রদ’

ডায়েট ফটাফট: ডায়াবিটিসে ভুগছেন? সুস্থ থাকতে কী কী ফল খাবেন, আর কোনগুলি এড়িয়ে চলবেন?

বাংলাদেশের কিছু পশ্চাদপদ ধারণার অন্ধ গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে বাঙালির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি এখনও সক্রিয়। তাদের দৃষ্টিতে এবং তাদের পরিভাষায় বাঙালি সংস্কৃতি মানেই হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। তাই তা পরিত্যাজ্য। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জার। এরাই ২০০১ সালে পয়লা বৈশাখের দিন ভোরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই নৃশংস হামলায় ১০ জন মৃত্যুবরণ করে। আহত হন আরও অগণিত মানুষ। এই অপশক্তি চেয়েছিল ভয় এবং ত্রাস সৃষ্টি করে সাধারণ বাঙালিকে নববর্ষ থেকে দূরে রাখা। কিন্তু তাদের সেই লক্ষ্য অপূর্ণই থেকে গিয়েছে।

পরের বছর ২০০২ সালে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আরও বেশি মানুষের সমাগম হয়েছিল। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্রের অন্ত নেই। এ বছর তারা আইনি নোটিশ দিয়েছে। আর ঘরে ঘরে বাঙালি জেগেছে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কীভাবে আরও সুন্দর ফলপ্রসু অসম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত নিদর্শন হিসেবে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। যে ভাবে বাঙালির একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বে পালিত হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, পহেলা বৈশাখের এই মঙ্গল শোভাযাত্রা একদিন অসম্প্রদায়িক চেতনার ঐতিহ্য হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করবে।

ছবি: সংগৃহীত।
* সোনার বাংলার চিঠি (Letter from Sonar Bangla, Sonar Banglar Chithi, Bangladesh) : অরুণ শীল (Arun Shil) কবি ও সাহিত্যিক। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক। শুরুতে গণমুখী ছড়া লিখে তুখোড় ছড়াকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও মায়াবী, কোমল এবং স্বপ্নময় কিশোর কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ, ফিচার লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।

Skip to content