সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


‘তোমার অশোকে কিংশুকে, অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে।’
রবি ঠাকুরের বসন্তের এই গান খানা সকলেরই জানা। বসন্তের প্রায় অন্তিম প্রান্তে অর্থাৎ অপরাহ্নে পৌঁছে মন আবারও ফিরে পেতে চায় ছেড়া মেঘের ক্যানভাসে রক্তরাঙা অশোক মঞ্জরীর সুমধুর আন্দোলনে গা ভাসাতে।

অশোক কথাটির অর্থই হল যেখানে শোকের বাতাবরণ নেই। হিন্দু শাস্ত্রমতে অমৃত থেকে সৃষ্ট এই পুষ্প হল প্রেমের প্রতীক। তাই এই পুষ্প কামদেবকে উৎসর্গ করা হয়। বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরের চারপাশে অশোক বৃক্ষ লক্ষ্য করা যায়। মহাকবি কালিদাস তার লেখায় “ঋতু সংহারা” অশোক ফুলকে বারংবার ব্যবহার করেছেন। অনেকটা এইরকম বলেছেন—”প্রথম যৌবনের আবির্ভাবে যুবতী নারীর হৃদয়ে রাঙা রক্ত ক্ষরণ হয়।”

মথুরা নগরের এক ভাস্কর্যে অশোকবৃক্ষকে পরিবেষ্টন করে নারী মূর্তি দেখানো রয়েছে। যারা ভালোবাসা এবং কামের দেবতা অশোক-বৃক্ষকে পুজো করছেন। কারণ, প্রাচীন শাস্ত্রমতে এই বৃক্ষ হল নারী প্রজজনের দেবতা। আমাদের বাংলাতে অশোক গাছকে কেন্দ্র করে এও নারীরা এক বিশেষ ব্রত পালন করেন। চৈত্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে অশোক ষষ্ঠী ব্রত পালিত হয় বঙ্গদেশে। মহিলারা উপবাস ভঙ্গ করেন অশোক ফুলের কুঁড়ির সাথে কাঁচা দুধ অথবা দধি খেয়ে। এই ব্রতের সূচনা পর্বে ছিলেন দেবী সীতা। লঙ্কেশ্বর রাবণ সীতাকে অপহরণ করার পর তাকে অশোক বনে লুকিয়ে রেখেছিলেন। অশোক ফুল দেবী সীতার অত্যন্ত প্রিয় ছিল। বন্দিনী থাকাকালীন সীতা, ষষ্ঠীর উপবাস উদযাপনের জন্য অশোক ফুলকে বেছে নিয়েছিলেন। শ্রীরামচন্দ্র যতদিন সীতাকে উদ্ধার করে আনেননি, ততদিন সীতা লঙ্কায় অশোক বৃক্ষের নিচে বসে আপন সতীত্ব অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সতীত্বের অভিভাবক হিসাবে স্মরণ করা হয় তাই অশোক বৃক্ষকে।
চৈত্র মাসের ত্রয়োদশ দিবসে অশোকবৃক্ষকে হিন্দুরা দেবতা জ্ঞানে পুজো করেন। এদিন মন্দির অশোক ফুল দিয়ে সাজানো হয়। ভগবান রামচন্দ্রের অঞ্জলিতেও অশোকফুল অপরিহার্য। এক লৌকিক উপখ্যানে বর্ণিত আছে যে, ‘যখন কোন যুবতী সুন্দরী নারী অশোক গাছের মূলকে স্পর্শ করে অথবা ওই নারীর বাঁ পা আলতোভাবে অশোক গাছকে স্পর্শ করে, তখনই ওই গাছে ফুল ফোটে। তাই এই গাছ হল কাম ও ভালোবাসার প্রতীক’।

হিন্দু সংস্কার ও সংস্কৃতিতে তো বটেই বৌদ্ধধর্ম-সাধনাতে অশোক গাছ মিলেমিশে রয়েছে। বৌদ্ধ মন্দিরের সবসময় অশোক গাছ লক্ষ্যণীয়, কারণটা হল গৌতম বুদ্ধের মা মায়া দেবী যখন বুঝতে পারলেন তিনি আসন্ন প্রসবা তখন তিনি একটি অশোক বৃক্ষের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। লুম্বিনী বাগানে ওই অশোক বৃক্ষের নিচে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ভারতে এসে যে বৃক্ষের নিচে বিশ্রাম নিয়েছিলেন, সেই অশোক বৃক্ষের কথা তার বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে অশোক বৃক্ষের চারা খ্রিস্টপূর্ব আড়াইশ বছর আগে সম্রাট অশোক পুত্র মহেন্দ্র, শ্রীলঙ্কা থেকে এ দেশে নিয়ে আসেন এবং অনুরাধাপুরে এই গাছ প্রথম রোপন করেছিলেন। তাই তো ধর্মীয় আচারে অশোক বৃক্ষ যুগ যুগ ধরে নিজের স্থান অটুট রেখেছে।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: সারা বছরের বন্ধু ‘কলা’

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: জিন এডিটিংয়ে নতুন দিশা, ইঁদুর ফিরে পেল দৃষ্টিশক্তি! মানুষের অন্ধত্বে আলো দেখাবে এই গবেষণা

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১১: ফুটবলের ব্ল্যাক প্যান্থার: লেভ ইয়াসিন

 

এক নজরে

বিজ্ঞানসম্মত নাম: সারাকা অশোকা

গোত্র: লেগুমিনেসি

বাংলা নাম: অশোক

সংস্কৃত নাম: পল্লভদ্র (এর অর্থ ভালোবাসা প্রস্ফুটন বৃক্ষ)

গাছের প্রকৃতি: বৃক্ষ জাতীয়, গুপ্তবীজী, উদ্ভিদ হল অশোক। এটি বহু শাখান্বিত এবং বহুবর্ষজীবী। এই গাছের ফল অনেকটা সেগুন গাছের ফলের মতো।

পুষ্প বিন্যাস: অ্যাক্সিলারি কোরিম্বস ধরনের। পুষ্পবিন্যাস হলুদ কমলা বা লাল রঙের হয়। ফুল ফোটার সময় হল ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এপ্রিল মাস।

গাছের বিস্তৃতি: অশোক বৃক্ষের প্রাচীন উৎপত্তিস্থল হল দক্ষিণ ভারত,শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমার। তবে পরবর্তীকালে এই গাছ স্বাভাবিক নিয়মে ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমঘাট এবং পূর্ব হিমালয়ের বেশ কিছু অংশে। উড়িষ্যা ও অসম রাজ্যেও এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩০: দিনের পরে দিন গড়ে যায় ‘বিধিলিপি’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৪: সমাজে নারীর বন্ধ্যাত্ব এবং পিতৃতান্ত্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

অশোক গাছের ছালে আছে অ্যাপিক্যাটেচিন, প্রসায়ানিদিন, লিউকোপিলারগোনিডিন, লিউকোসায়ানিডিন যৌগ।

অশোক ফুলে উপস্থিত যৌগগুলি হল ওলিক অ্যাসিড, লিনোলিক অ্যাসিড, পামেটিক অ্যাসিড, স্টিয়ারিক অ্যাসিড, স্কুয়ারসেটিং, ক্যাম্ফরল ৩ ডিপিডি গ্লুকোসাইড, সায়ানিডিন, লিউকোসায়ানিডিন এবং গ্যালিক অ্যাসিড ইত্যাদি।

অশোক বীজ ও ফুলে উপস্থিত থাকে অ্যাপিক্যাটেহল, ওলিক অ্যাসিড,লেনোলেইক, অ্যাসিড পামেটিক অ্যাসিড, স্টারোরিক অ্যাসিড ইত্যাদি যৌগ।

আরও পড়ুন:

মনের আয়না: আপনার সন্তান কি মোবাইলে আসক্ত? এর থেকে মুক্তি পেতে জানুন মনোবিদের পরামর্শ

উপন্যাস: বসুন্ধরা, এবং ২য় খণ্ড, পর্ব-১১: রাত বাড়লে গুলি-বোমার শব্দ, দরজায় অচেনা লোক এলে সন্দেহ হতো

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

 

শ্বেতস্রাব এবং রক্তস্রাব প্রতিরোধে

যদি কোনও মহিলার বেশ কিছুদিন ধরে অল্প অল্প করে শ্বেতস্রাব বা রক্ত স্রাব নিঃসরণ হতে থাকে তাহলে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী অশোক গাছের ছাল কাঁচা হলে কুড়িগ্রাম আর শুকনো হলে বারো গ্রাম নিয়ে তার সঙ্গে ৫০০ মিলিলিটার জল এবং ১২৫ মিলিলিটার দুধ মিশিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ফুটিয়ে তা ১২৫ মিলিলিটার করে আনতে হবে। তারপর তা ছেঁকে ঠান্ডা করে অপরাহ্ণে খেতে হবে। এর ফলে এই অসুবিধা অনেকাংশে নির্মূল হবে।
 

গর্ভবিনাশ প্রতিরোধে

যে সকল নারীর গর্ভসঞ্চার হলেও কোনও কারণবশত তা নষ্ট হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে ১৪ থেকে ১৫ গ্রাম অশোক ছাল নিয়ে চার কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপে নামিয়ে আনতে হবে। তারপর ছেঁকে একটু দুধ মিশিয়ে, ঋতুচক্র বন্ধ হওয়ার পর থেকে প্রায় ২৬ থেকে ২৭ দিন একটানা প্রত্যেকদিন একবার করে খাওয়ার পর এই অসুবিধা অনেকাংশে দূর হয়ে যাবে।
 

হৃদস্পন্দন কমাতে

এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের যে কোনও তীব্র শব্দে হৃদকম্পন হয়, এই রকম হৃদদৌর্বল্যের ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে সাত গ্রাম অশোক ছাল গুঁড়ো করে একটা গরম জলে ভিজিয়ে রেখে, ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর থেকে নিয়ে খেলে এই অসুবিধা কেটে যায় বলে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের বিশ্বাস।
 

রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করতে

কোন স্থানে কেটে গেলে বা ক্ষত সৃষ্টি হলে অশোক ছালের গুঁড়ো সেখানে টিপে লাগিয়ে দিয়ে, তারপর শক্ত করে বেঁধে দিলে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়।
 

কৃমি বিনাশে

কৃমির উপদ্রব রোধে অশোক বিচূর্ণ করে আদ-গ্রাম মাত্রায় দু’ বেলা একটু গরম জল সহযোগে খেতে হবে। এর দ্বারা এই অসুবিধা দূর হয়ে যায়। সুশ্রুত সংহিতাতেও বলা হয়েছে অশোক হল কৃমি বিনাশকারী।

 

উজ্জ্বলহীন ত্বক

খসখসে উজ্জ্বলহীন ত্বকের জন্য যদি অশোক বীজ বেটে হলুদের মতো মাখা যায় তাহলে ত্বক নিজের উজ্জ্বলতা ফিরে পায়। এমনকি অশোক ছালের ঘন নির্যাস গায়ে লাগিয়ে এক দেড় ঘণ্টা রেখে তারপর স্নান করলে স্কিন তার ঔজ্জ্বল্য ফিরে পায়।
 

বিষাক্ত কীটের দংশন জনিত ব্যথার উপশমে

যদি দেহের কোনও স্থানে বিষাক্ত কোনও পোকামাকড় কামড়ায় তবে সেই স্থানে তৎক্ষণাৎ অশোক গাছের ছালের কিছুটা অংশ বেটে বারবার করে লাগিয়ে দিলে সেই বিষ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায় এবং জ্বালা যন্ত্রণার উপশম হয়।
 

অর্শ নিরাময়ে

যেখানে অর্শের কারণে মলদ্বার থেকে রক্ত বের হতে থাকে কিন্তু ব্যথা যন্ত্রণা খুব একটা বেশি থাকে না, সে সকল ক্ষেত্রে ১০ গ্রামের মতো অশোকছাল গুড়ো করে তা এক গ্লাস গরম জলে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে, তারপর তা ছেঁকে, প্রতিদিন সকালে ও বিকালে খেলে ওই স্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে।
 

শ্লেষ্মা রোগ নিরাময়ে

চরকের বিধান অনুযায়ী অশোক শ্লেষ্মা রোগ এবং বমনোপযোগী দ্রব্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
 

স্ত্রীরোগ প্রতিরোধে

বর্তমান বিজ্ঞানে আধুনিক প্রযুক্তিতে দেখা গিয়েছে যে, অশোক গাছের বিভিন্ন অংশের মধ্যে উপস্থিত যৌগগুলি ব্লিডিং জনিত সমস্যা, ইউটেরাস জনিত সমস্যা, ডিপ্রেশন, এমনকি লিউকোমিয়া প্রতিরোধেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। তাইতো সুশ্রুত-এর সূত্রস্থানের ৩৮ সংখ্যক অধ্যায়ে অশোককে যোনি দোষের এবং বিশবনাশক বলা হয়েছে।

এই সকল কারণবশতই হয়তো অশোক বৃক্ষ স্ত্রীলোক দ্বারা ব্যাপকভাবে পূজিত হয়। স্বাভাবিক নিয়মেই ধর্মীয় আচারে অশোক বৃক্ষ তাই নিজের স্থান অটুট রাখতে পেরেছে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content