রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


বৃষ্টির জলবিন্দু সাগরে পড়তে পড়তে বিষাদে কেঁদে ওঠে, আমি হারিয়ে গেলাম! সাগর উত্তর দেয়, তুমি হারালে না, তুমি আমি হয়ে গেলে, আজ থেকে তুমিও আমি, আমিও তুমি। তুমি আজ থেকে সাগর হলে। শ্রীরামকৃষ্ণ নাম মাহাত্ম্য বিষয়ে বলছেন, “নামের ভারী মাহাত্ম্য। শীঘ্র ফল না হতে পারে, কিন্তু কখনও না কখনও ফল ফলেই ফলে। যেমন কেউ বাড়ির কার্নিশের উপর বীজ রেখে গিয়েছিল, অনেকদিন পরে বাড়ি ভূমিস্মাৎ হয়ে গেল। তখন সে বীজ মাটিতে পড়ে গেল ও তার ফল হল।”

ঈশ্বরের নামের শক্তি অমোঘ, হতে পারে তা সাধারণভাবে গোচর হয় না। কিন্তু তা কালে ফল প্রদান করে, আমরা বুঝি বা না বুঝি। নামের প্রভাব এত যে আমার জানতে পারি না যেমন তিনি যেন ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যান। তার নামে অরুচি হল তাহলে আর বাঁচাবার থাকে না। যদি একটু রুচি থাকে তবে বাঁচার খুব আশা। “তাই নামে রুচি, ঈশ্বরের নাম করতে হয়, দুর্গা নাম, কৃষ্ণ নাম, হরিনাম, যেকোনও নামে রুচি হয়। যদি নাম করতে অনুরাগ দিন দিন বাড়ে, আনন্দ হয় তাহলে আর কোনও ভয় নাই। বিকার কাটবেই কাটবে। তাঁর কৃপা হবেই হবে।”
শ্রীমদ্ ভগবত্গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “স্বল্পমপস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।” সল্প ধর্মের সাধন ও মহান ভয় থেকে রক্ষা করে। সমস্ত ভয়ের নাশ হয়। ভক্ত নিশ্চিন্তে তার পথে গমন করে। “বাঘ যেমন কপকপ করে জানোয়ার খেয়ে ফেলে, তেমনই অনুরাগ বাঘ কাম ক্রোধ এসব রিপুদের খেয়ে ফেলে। ঈশ্বরের একেবারে অনুরাগ হলে কাম-ক্রোধাদি রিপুগণ আর থাকে না।”— শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন। গোপীদের ওই অবস্থা হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণে অনুরাগ। শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য শিক্ষাষ্টকম-এ বলেছেন, “ন ধনং ন জনং বা সুন্দরীং কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে, মম জন্মনি, জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি।” হে জগদীশ্বর আমি ধনজন পরমা সুন্দরী স্ত্রী অথবা পাণ্ডিত্য কিছুই কামনা করি না জন্মে জন্মে তোমাতে যেন আমার অহৈতুকি ভক্তি থাকে। বিশ্বাস এক রকম।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১৩: জ্ঞানের আলো আপনার অন্ধকারকে মুছে অদ্বৈত আনন্দ উপভোগ করায়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪: অপবাদ এবং রামচন্দ্রের সুশাসনের রামরাজত্ব

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছিলেন, “ভক্তের হৃদয় তার আবাস স্থান। তিনি সর্বভূতে আছেন বটে কিন্তু ভক্তহৃদয় তার বিশেষ প্রকাশ। যেমন কোন জমিদার তার জমিদারির সকল স্থানে থাকতে পারে। তবে তিনি অমুক বৈঠকখানা তে প্রায় থাকেন। হৃদয় ভগবানের বৈঠকখানা।” যখন এই অবস্থায় লাভ হয় তখন মানুষ সর্বভুতে ঈশ্বর এবং ঈশ্বরে সর্বভুতকে দর্শন করে। আবার স্বামী বিবেকানন্দ ভক্ত ও ভক্তি প্রসঙ্গে বলেন, “তখনই সে পূর্ণ ভক্তি লাভ করে। তখনই সে অভ্রম্ভ স্তম্ভ পর্যন্ত সর্বভূতে বিষ্ণু কে অবতীর্ণ দেখতে পায় তখন সে প্রাণে প্রাণে বুঝতে পারে ঈশ্বর ব্যতীত আর কিছুই না।”
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৯: দ্রৌপদীর জন্য স্বর্গীয় ফুলের খোঁজে ভীমসেন কোনও পথে পাড়ি দিলেন!

শাশ্বতী রামায়ণী, শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪১: চরৈবেতি—গভীর বনপথে জীবন বহমান

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৩: বাইগা বস্তি হয়ে ভোরামদেব মন্দির

নারায়ণ আঙ্গার শ্রী শ্রীমাকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘মা, শুধু নাম মন্ত্র জপ করব?’ শ্রী শ্রীমা বলছেন, “হ্যাঁ মন্ত্র জপ করবে বৈকি। তবে মনস্থির করে একবার ডাকলে লক্ষ্য জপের কাজ হয় নতুবা সারাদিন জপ করছো কিন্তু মন নেই তাতে ফল কি? তবে তার কৃপা।”

এখানে শ্রীশ্রী ঠাকুরের জীবনের একটি ঘটনা বললে বেশ হয়। তাঁর জীবনে জগতমাতার নাম সুধা পান করে যে ঈশ্বর তন্ময়তা লাভ করেছিলেন তা এই ঘটনার মধ্যে হরিস্ফুট হয়, একদিন ঠাকুর লীলার ছলে মাতা ঠাকুরানীর সম্মুখে উচ্চ ভাব অবস্থা অভিব্যক্ত করে সে বিষয়ে তার ধারণা শক্তি পরীক্ষা কর ছিলেন। সেদিন দিনের বেলায় শ্রীমাকে পান সাজিতে ও বিছানা ঝেড়ে ও ঘরখানি পরিপাটি করতে বলে ঠাকুর শ্রীশ্রী জগদম্বার দর্শনে কালী মন্দিরে গেলেন। শ্রীমা ক্ষিপ্র হস্তে গৃহকার্য প্রায় শেষ করেছেন এমন সময় ঠকুর মাতালের ন্যায় টলিতে টলিতে একেবারে শ্রী মায়ের নিকট উপস্থিত হলেন তার চক্ষু রক্তবর্ণ এখানে পা ফেলিতে সেখানে পড়ছে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩০: দিনের পরে দিন গড়ে যায় ‘বিধিলিপি’

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: রক্তাল্পতায় ভুগছেন? জানুন আয়ুর্বেদ মতে প্রতিকারের উপায়

কথা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, কর্মব্যস্ত শ্রীমা বুঝতেও পারেননি যে, ঠাকুর এত নিকটে এসেছেন। অকস্মাৎ ঠাকুর তাহার শ্রীশ্রী অঙ্গ ঠেলিয়া বললেন, ‘ওগো আমি কি মদ খেয়েছি?’ শ্রীমা পশ্চাতে চেয়ে স্তম্ভিত হলেন ও তখনই উত্তর দিলেন, ‘না না মদ খাবে কেন’ ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন ‘তবে কেন কথা বলতে পারছি না’ আমি কি মাতাল? শ্রীমা উত্তর দিলেন, ‘তুমি মদ কেন খাবে? তুমি মা কালীর ভাবামৃত খেয়েছ।’ ঠাকুর তাতে আশ্বস্ত হলেন, ঠিক বলেছ বলে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন।

শ্রীশ্রী ঠাকুর, শ্রীমাকে ও লক্ষ্মী দিদিকে একদিন উচ্চ ধর্মতত্ত্ব, শ্রীকৃষ্ণের লীলা বর্ণনা করে বলেছিলেন, “আমার কাছে যা সব শুনলি তোরা দুজনে বলাবলি করিস। গরুগুলো দিনের বেলায়
যা সব খায় রাত্রিবেলা সেগুলো জাবর কাটে। তুই আর তোর খুঁড়ি, দুজনে বলাবলি করবি। তা হলে কৃষ্ণের এসব লীলা কথা আর ভুলে যাবি না।” নাম জপ ও কীর্তন এর মধ্য দিয়ে তার সঙ্গে এক হয়ে থাকাই ভক্তের উদ্দেশ্য। প্রকৃত ভক্ত শত বিপদেও নামের সাধন করতে ছাড়েন না।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সচিব, রামকৃষ্ণ মিশন, নন্দী (Nadi), সাউথ প্যাসিফিক (South Pacific), ফিজি (Fiji)।

Skip to content