শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সূর্য নিয়ে খেলা। ছবি: প্রতীকী। সৌজন্যে: সত্রাগ্নি।

বম্বেতে মেজদিদি সুলক্ষণা মেজ জামাইবাবু চঞ্চলকুমার ঘোষের দাদারে ফ্ল্যাট ছিল। মেজ জামাইবাবু চাকরি করতেন সেঞ্চুরি কর্টন মিলসে। লোয়ার প্যারেলে ফ্যাক্টরি একেবারে শিবাজিপার্কের গায়ে পৈতৃক ফ্ল্যাট। মেজদিদির শ্বশুরমশাইও সেঞ্চুরি মিলসের কর্মী ছিলেন। বিড়লাদের সংস্থা। বাবার চাকরি ছেলে পেয়েছিল। মেজো মেয়ে সুলক্ষণার শ্বশুর শাশুড়ি মারা গিয়েছেন।

বড় দুই ননদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। মেজ জামাইবাবু ছোট ভাই। তার কাছেই বাবা-মা থাকতেন পাশের একটা জোড়া দু’ কামরার ফ্লাটে। এখন মেজদিদি অনেকটা ঝাড়া হাত-পা। দুই ছেলে দুই মেয়েকে নিয়ে গুছিয়ে সংসার করছে। নাতনিদের নিয়ে মা পাশের সেই দু’ কামরার ফ্ল্যাটে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবেন। তাই কণিকা মেজো মেয়ের কাছেই যেতে চান।

সেটাই খুব স্বাভাবিক ছিল। তিনমেয়ে জামাই সমান হলেও বিনয়কান্তির গুরুত্ব আনন্দমোহন বা কণিকার কাছে অনেকটা। কিন্তু তিনি যখন চাইছেন না বসুন্ধরা ভিলায় আসতে স্বর্ণ একটু ক্ষুব্ধ হলেও বিনয় সেই মতামতটাকে গুরুত্ব দিল। স্বর্ণকে বোঝালো যে বসুন্ধরা ভিলায় সব সময় লোকজন আত্মীয়-স্বজন যাওয়া আসা, বিয়ে, পুজো পার্বণের অনুষ্ঠান—সেখানে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকার ব্যাপারটা হয়তো কণিকাকে খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলবে। অতদিন আগেও প্লট করে করে চার তলা পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ি মেজো বোন সুলক্ষণার।।
ইংরেজি ডি অক্ষরের মতো শিবাজিপার্ক। বড় রাস্তার ওপরে শিবাজি মহারাজের স্ট্যাচু। সেটা ডি-এর সামনের সোজা দিক। আর পার্ককে বেড় দিয়ে একটা রাস্তা দিয়ে মাথা থেকে ডি-এর শেষটাকে জুড়েছে। শিবাজিপার্ক অঞ্চল বাঙালি অধ্যুষিত। এখানে রয়েছে বহুদিনের পুরনো বেঙ্গলি ক্লাব। তাদের নামকরা দুর্গাপুজো। এই শিবাজিপার্কেই ভারতীয় ক্রিকেটের দ্রোণাচার্য রমাকান্ত আর্চেকার সচিনের মতো অর্জুন বা একনাথ সোলকারের মতো কর্ণ গড়েছেন।

বম্বেতে বহুদিন থেকেই বাড়ি কেনাবেচা চলে। ঠিকানা বদলে বদলে যায়। একটু একটু করে অর্থসঞ্চয় করে লোকে ছোট থেকে বড় ভালো বাড়ি কেনে। মেজ দিদিদের নিচের তলাতেই একটা দু-কামরার একটু ছোট ফ্ল্যাট বিক্রির খবর পেয়েই যোগাযোগ হল। বরানগরের বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হল। সেই টাকা দিয়ে দাদারের ফ্ল্যাট কেনা হলো। উদ্বৃত্ত টাকাটা মায়ের নামে চিকিৎসা ইত্যাদির জন্য বিনয়কান্তি জমা করে দিলেন। আর ফ্ল্যাটটা কেনা হল মা আর স্বর্ণময়ীর বড় দুই দিদির নামে। যাতে মার অবর্তমানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে কোন মন কষাকষি তৈরি না হয়।

জামাইবাবুরা স্বর্ণময়ীর অধিকারের কথা তুলেছিলেন বিনয়কান্তি সবিনয়ে জানিয়েছিলেন এমনিতেই পুরনো ফ্ল্যাট তার এতজন অংশীদার হলে কারও ভাগে তো কিছুই থাকবে না। বড় দুই জামাইবাবু এবং দিদিরা বুঝতে পেরেছিল। ঔদ্ধত্য প্রকাশ না করেও বিনয়কান্তি কি বোঝাতে চাইছেন। এ বিনয়ের মায়ের শিক্ষা। তোমার মতামত দেবার সময় যেন কোনও ঔদ্ধত্য না থাকে, কিন্তু তার জন্য মতামত যেন কখনও অস্পষ্ট না থাকে সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
আরও পড়ুন:

৩য় খণ্ড, পর্ব-২: স্বর্ণময়ী মাঝে মাঝে অবাক হয়ে বিনয়কান্তিকে দেখতো

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি

বিনয়কান্তি চেয়েছিলেন স্বর্ণময়ীর মায়ের যেন কোনওদিন কখনও কুণ্ঠাবোধ না হয়। শ্বশুরমশাই আনন্দমোহন তার শাশুড়িমাকে যে রাজকীয়তার মধ্যে রেখেছিলেন তা যেন বজায় থাকে।

এমন একজন আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে সংসার করার দুর্লভ সুযোগ একটু একটু করে কমে আসছে এই আতঙ্ক এই আশঙ্কা স্বর্ণময়ীকে দুর্বল করে দিত। তিনি জানতেন মানব জীবনে এটাই অমোঘ ভবিতব্য। কিন্তু জন্মান্তর যদি সত্যি হয় আর পরও জন্মে যদি আবার বিনয়কান্তির সঙ্গে দেখা না হয় তখন স্বর্ণ কি করবে?

ঠাকুরঘরে পুজো করতে করতে পিছনে বসে আরতি দেখতে থাকা বসুন্ধরা আচমকা হার্টফেল করবার ঘটনা স্বর্ণময়ীকে আরও দুর্বল করে দিল। বয়সজনিত তো কারণে বসুন্ধরার শরীর খারাপ ছিলই। কিন্তু একেবারে চলে যাবার মতো তো নয়।

এরমধ্যে আচমকা এল তন্ময়কান্তির ভয়ংকর মৃত্যু সংবাদ। স্বর্ণময়ী যেন একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। বিনয়কান্তির কথায় সুরঙ্গমার বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে স্বর্ণময়ী আর আপত্তি করেননি। তবে তিনি যে মনের ভেতর থেকে সবটুকু মেনে নিয়েছেন এমনটাও নয়। রোসিন আর শ্যাননের জন্যে দুটো বিছেহার ব্যাঙ্কের লকারে আলাদা করে রাখা আছে সেসব বলে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৪: সুন্দরবনের মৃত ও মৃতপ্রায় নদী

বসুন্ধরা ভিলায় জামাইদের জন্য সোনার কলম দেবার রীতি চালু করেছিলেন বসুন্ধরা দত্ত। সেই রীতি মেনে পারিবারিক জুয়েলার্সে একজোড়া সোনার কলমের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে সুরঙ্গমা স্বর্ণময়ীর প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছিল তার সঙ্গে তিনি আর প্রাণ খুলে কথা বলছেন না। সুরঙ্গমা যেন চোখ ফেটে জল আসতে চায়। কেন কোন পরিস্থিতিতে তাকে সব ছেড়েছুড়ে বিদেশে ছুটতে হচ্ছে সেটা তিনি কিছুতেই বলতে পারবেন না। আর বলতে পারবেন না বলেই স্বর্ণময়ী এই অভিমান তাকে সহ্য করতে হচ্ছে।

জটিল কঠিন পরিস্থিতিকে হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে হালকা করে দেবার একটা প্রচেষ্টা অমলকান্তি সবসময় করতেন। সুরঙ্গমাকে তার স্বামী বললেন—

— সমস্যা কোথায় জানো, এই অভিমান ব্যাপারটা তুমি কীরাকে বোঝাতে পারবে না। আসলে আমরা বাঙালিরা অভিমান বলতে যেটা বুঝি আর কোন ভারতীয় ভাষায় সেটা ঠিক তরজমাও হয় না ইংরেজিতে তো নয়। Hurt আঘাত লাগা দুঃখ পাওয়া বোঝায়। মাকে দুঃখ দেওয়ার মতো কোনও কথাও তুমি বলোনি বা ধাক্কাধুক্কিও দাওনি। তুমি কেন সাত তাড়াতাড়ি কলকাতা ছেড়ে বিদেশ ছুটছো সেটা মাকে কেন কাউক্কে বলতে পারবে না। এদিকে মা তোমাকে ভুল বুঝছেন। কারণ মা তোমায় ভীষণ ভালোবাসেন। তিনি ভাবছেন আমি এত অসুস্থ এটা জেনেও বিয়েবাড়ির জন্য স্বর্ণ আমায় ছেড়ে যাচ্ছে। আর এই ভুল বোঝাবুঝি থেকেই একরাশ অভিমান জন্ম নিয়েছে। এই অভিমানটা তুমি কীরাকে কি করে বোঝাবে? তোমাকে বলতে হবে হোয়াট ইস অভিমান?
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান

না অভিমান ইজ আ টিপিকাল বেঙ্গলি এক্সপ্রেশন অফ ওয়ার্ড টু ডিসক্রাইব দ্য ডিগ্রি অফ আপসেটিং ফিলিং সামওয়ান হোলডস এগেন্সট সামওয়ান ভেরি ক্লোজ অর লাভড ওয়ান। ইট ইজ এ সফটার ফ্রম অফ অ্যাঙ্গার এন্ড ডিসঅ্যাপয়েন্টমেন্ট!

— সত্যি অভিমানের কোন ইংরিজিতে কোনও প্রতিশব্দ নেই।

— নাঃ। বাংলা থেকে হিন্দি ডিকশনারি দেখো। অভিমান বলতে অহংকার ক্ষোভ গর্ব গুসসা বা রাগ ঘমণ্ড মানে রকের বাংলায় রেলা বলতে পারো।

খারাপ লাগা ভুলে সুরঙ্গমা হেসে ফেললেন। অমলকান্তির চেষ্টা সফল।

— মেঘ কেটে গিয়েছে। ঈশ্বর যদি ইচ্ছে করেন মা ঠিক বুঝতে পারবেন কেন তুমি গিয়েছিলে। শুধু শুধু মনে কষ্ট কেন পাবে? তুমি কোনও অন্যায় করছো না। মনের মধ্যে কোন চাপ রেখো না। দুঃখ যন্ত্রণা কষ্টের ধুলো হাসির হর্স পাইপের ফোর্সে উড়িয়ে দাও। মন ঝকঝক করবে। শরীর ভালো থাকবে, মাথা ভালো থাকবে।

হঠাৎ সেদিন ঋতুর নামে ইনসিওরেন্স কোম্পানির থেকে একটা চিঠি এল। চিঠি নিয়ে ঋতু ছুটে এলো সুরঙ্গমার কাছে। হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লো।—চলবে।

মেঘের ফাঁকে আলো। ছবি: প্রতীকী। সৌজন্যে: প্রচেতা।

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content