রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


কী পরিমাণ আত্মত্যাগ ও মানুষের জীবনের বিনিময়ে আমাদের এই মহান স্বাধীনতা, তা ভারতের তরুণ বন্ধুরা অনুধাবন করতে পারেন না। তাঁরা অনেকে জানেন না যে, ২৬ মার্চের আগের দিন বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা কেমন গণহত্যা চালিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ একটি বুক ভাঙা হাহাকারের দিন, একটি নিষ্ঠুরতম রাত। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংসতম গণহত্যা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে এমন বিভীষিকাময় রাতের নৃশংস স্মৃতি শত বছরেও বিস্মৃত হওয়ার নয়। পাক হানাদার বাহিনীর জিঘাংসার শিকার শত শত নিরপরাধ মানুষের প্রতিধ্বনিত আর্তনাদ যেন আজও কান পাতলে শুনতে পাই। বাংলার মাটি জলে সাগরে সমীরে মিশে থাকা সেই আর্তনাদ বারবার মনে করিয়ে দেয় মহান স্বাধীনতার মূল্যের কথা। পাকিস্তানিদের জঘন্যমত হীন মানসিকতার পরিচয় এই রাতের হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচিত হয়। এই নির্লজ্জতা শুধু বর্বর পাকিস্তানকেই মানায়। তাদের নৃশংসতার নিন্দা জানানোর ভাষাহারা একটি দিন ২৫ মার্চ ১৯৭১।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করার প্রয়াসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত সামরিক অভিযানের সাংকেতিক নাম ‘অপারেশন সার্চলাইট’। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মূল পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই রাত থেকে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে কার্ফিউ জারি করা হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ সব যোগাযোগের মাধ্যম বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। আনুমানিক রাত ১১টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় বিক্ষোভকারী বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে আক্রমণ চালায়। এটি ছিল অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম হামলা। এরপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙালি পুলিশ ও ইপিআরদের হত্যার উদ্দেশ্যে পিলখানা ও রাজারবাগে একযোগে হামলা চালানো হয়।

অল্পসময়ের মধ্যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা ঢাকা শহরে ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)-এর বাঙালি সদস্য এবং পুলিশসহ হাজার হাজার ছাত্র শিক্ষক এবং সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হল (বর্তমান শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ছিল অভিযানের মূল লক্ষ্য।

ট্যাঙ্ক, অটোমেটিক রাইফেল, রকেট লঞ্চার, ভারী মর্টার, এবং মেশিনগানের মতো ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। রাত ১২টার পর সেনাবাহিনী মর্টারের গোলা ও অবিরাম গুলিবর্ষণের মাধ্যমে জগন্নাথ হলে হামলা চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই রাতে দখলদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ঘুমন্ত ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের হত্যা করে।
পাকিস্তানিদের অবস্থা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডিতে তাঁর ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে ইপিআরের ওয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপরেই তিনি সামরিক জান্তার হাতে গ্রেফতার হন। তাকে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

সে রাতে দেশের বিখ্যাত সব পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ এবং পিপলের মতো জাতীয় সংবাদপত্রের কার্যালয়গুলোতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিপুল সংখ্যক শীর্ষ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীকে কার্যালয়ের ভেতরেই পুড়িয়ে মারা হয়। কালী মন্দির এবং কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার মাটিতে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এমনকি রাজপথের সাধারণ নাগরিক, রিকশা চালক, মজুর, ভবঘুরেরাও বাদ যায়নি এই চরম জিঘাংসা থেকে। রিকশার হুড তুলে সিটে শুয়ে থাকা চালকদের ঘুমের মধ্যেই গুলি করে হত্যা করা হয়।
আরও পড়ুন:

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-১০: ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১০: রেমন্ড কোপা এক কিংবদন্তি ফুটবল বাদশা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৮: পূর্ণ অপূর্ণ-র মাঝে পথ দেখায় ‘দেবত্র’

এই হত্যাকান্ডের নীলনকশা পাকিস্তানিদের পরিকল্পনায় ছিল। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বৈঠকে ২৫ মার্চকে সামনে রেখে করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে ষোড়শ পদাতিক ডিভিশন এবং খারিয়ান থেকে নবম ডিভিশনকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। পরিকল্পনা কার্যকর করার আগে পূর্ব পাকিস্তানের সিনিয়র পাকিস্তানি অফিসারদের মধ্যে যারা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সামরিক আক্রমণে সমর্থন করেননি, তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও জেনারেল অফিসার কমান্ডার হন।

১৭ মার্চ মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান টেলিফোনের মাধ্যমে অপারেশন পরিকল্পনা করার ক্ষমতা প্রদান করেন। অতঃপর ১৮ মার্চ সকালে ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি অফিসে অপারেশন সার্চলাইনের একটি খসড়া তৈরি করা হয়। খসড়াটি তৈরি করেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি এবং ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা। ১৬ অনুচ্ছেদের মোট পাঁচ পৃষ্ঠার পরিকল্পনাটিতে অপারেশন সফল করতে করণীয় এবং দায়িত্বরত ইউনিটগুলোর কাজের বণ্টন স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ ছিল।
হাতে লেখা পরিকল্পনাটি জেনারেল আবদুল হামিদ খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ২০ মার্চ ফ্ল্যাগস্টাফ হাউসে পর্যালোচনা করেছিলেন। জেনারেল আবদুল হামিদ খান নিয়মিত সেনা বাঙালি ইউনিটের অবিলম্বে নিরস্ত্রীকরণে আপত্তি জানালেও ইপিআর, সশস্ত্র পুলিশ এবং অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনীকে নিরস্ত্র করার অনুমোদন দেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গে বৈঠকের সময় আওয়ামি লিগ নেতাদের গ্রেপ্তারের অনুমোদন দিতে অস্বীকার করেন। পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর বিভিন্ন এরিয়া কমান্ডারদের কাছে বিতরণ করা হয়। ঠিক হয় ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় অপারেশন শুরু হবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য গ্যারিসনকে তাদের কার্যক্রম শুরু করার জন্য ফোনের মাধ্যমে জানানো হবে। ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইটের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল রাও ফরমান আলি। বাকি সারাদেশের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল খাদিম। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং তার কর্মীরা ৩১তম ফিল্ড কমান্ড সেন্টারে উপস্থিত থেকে ১৪তম ডিভিশনের কমান্ড স্টাফদের তত্ত্বাবধান করছিলেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ঠিক ১টায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের জন্য ৪০ জনের ৩টি কমান্ডো ব্যাটালিয়ন নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেড এ (জিয়াউল্লাহ) খান। তারা তা দ্রুত বাস্তবায়ন করে।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: খুদের টিফিনে কী দেবেন ভেবেই মাথায় হাত? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন মুগ ডালের চিল্লা!

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১২: বাইগা রিসর্ট ও বস্তি

কেন এই গনহত্যা? কেন এই জিঘাংসা? ১৯৭০ সালের পাকিস্তান সংসদীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামি লিগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করার পর, বাঙালি জনগণ ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামি লিগের কাছে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর আশা করেছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ তারিখে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চাপে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মার্চের জন্য নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করেন। ভুট্টো ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থানকে দুর্বল করার জন্য লবিং শুরু করেছিল। স্থগিতকরণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে আওয়ামি লিগ অসহযোগের আন্দোলনের ডাক দেয়। ৭ মার্চে ঢাকার রেসকোর্সে ঐতিহাসিক ভাষণে ”এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। ”যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে”। ”দেশ আমার কথা মতো চলবে” বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার ফলে পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানে শুধু সামরিক সেনানিবাস এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাঙালি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানের সমর্থক বিহারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন এবং পরে ভুট্টোর সঙ্গে যোগ দেন।

অধিকাংশ পাকিস্তানি জেনারেলরা ভুট্টোকে সমর্থন করেছিলেন। কারণ তাদের ভয় ছিল যে, বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় এলে বহুজাতিক পাকিস্তানি ফেডারেশন ধ্বংস হয়ে যাবে। এই অসমর্থনের সূত্র ধরে অবশেষে পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহী বাঙালিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অন্য দিকে মার্চের শুরুতে চট্টগ্রামে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গায় ৩০০ জনেরও বেশি বিহারি নিহত হয়। এই ঘটনার রেশ ধরে পাকিস্তান সরকার অপারেশন সার্চলাইটকে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য এই সামরিক হস্তক্ষেপের নেপথ্যে ঘটনা হিসেবে ‘বিহারি গণহত্যা’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছিল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১২: ঘাম কমাতে পাউডার ব্যবহার করেন?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩: আর্ষ মহাকাব্যদ্বয়ের আদি প্রচারমাধ্যম

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭: ওখানে কে?

অস্ট্রেলিয়ার “সিডনি মর্নিং হেরাল্ড” পত্রিকার ভাষ্যমতে শুধু পঁচিশে মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পরবর্তী নয় মাসে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা এবং ২ লক্ষ মা বোনকে ধর্ষণ নির্যাতনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর বাঙালি কুলাঙ্গার রাজাকার আলবদরেরা পূর্ণতা দিয়েছিল সেই বর্বর ইতিহাসকে।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সর্ম্পকে লিখেছেন, “সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হল। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের লাশ। পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক কুকুর ও শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।”

পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তনের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ব চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়, “১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।”

১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামি লিগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর এই গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামি লিগ-সহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।
পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।
বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত আবাসনের ২৪ নম্বর বাড়িতে। ওই বাড়ির নিচে দু’ পায়ে গুলিবিদ্ধ দুই মা তাদের শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সিঁড়ি ভেসে যাচ্ছিল তাদের রক্তে। পাক হায়নাদাররা ভেবেছিল অন্য কোন দল হয়ত অপারেশন শেষ করে গিয়েছে। তাই তারা আর ওই বাড়িতে ঢোকেনি। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তখন প্রাণে বেঁচে যান।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, তাদের বাড়ির নিচে আর একজন অবাঙালি অধ্যাপক থাকলেও তিনি ২৫ মার্চের আগে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার সব অবাঙালি পরিবার তাই করেছিল। এ থেকেই ধারণা করা যায়, ২৫ মার্চের এই হত্যাযজ্ঞের পূর্বাবাস অবাঙালিরা জানতো। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চুড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান।

পাকিস্তানি জান্তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণায় শেষ শত্রু বিদায় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

পাকিস্তানিদের এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ড বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূত্রপাত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের। প্রায় এক কোটি অসহায় বাঙালি ভারতে শরনার্থী হয়। প্রায় ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর নিকট পাকিস্তানি বাহিনী নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর চুড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। তাই, ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। আর ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে আমরা পালন করি।

২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৫ মার্চ কালোরাতের তথ্য-উপাত্ত জাতিসংঘ-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে কুটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। এই গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে একদিন ক্ষমা চাইতে হবে।

ছবি: সংগৃহীত।

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* সোনার বাংলার চিঠি (Letter from Sonar Bangla, Sonar Banglar Chithi, Bangladesh) : অরুণ শীল (Arun Shil) কবি ও সাহিত্যিক। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক। শুরুতে গণমুখী ছড়া লিখে তুখোড় ছড়াকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও মায়াবী, কোমল এবং স্বপ্নময় কিশোর কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ, ফিচার লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।

Skip to content