বাইগা রিসর্টে অনেকগুলি ওয়াচ টাওয়ার আছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে আপনি যেমন চারপাশের প্রকৃতির অনবদ্য সৌন্দর্য উপভোগ করবেন, তেমন হঠাৎ দূরে দেখতে পাবেন সারদা দাদার ড্যাম। দূরে দেখতে পাবেন কোথাও একদল গরু চলছে, এগুলো দেখতে দেখতে লাল মাটির পথ ধরে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন বাইগাদের গ্রামে। বাইগা ভারতবর্ষের মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এদের বসবাস। এখান থেকে জানতে পারলাম, নৃতত্ত্বগত দিক থেকে মধ্যপ্রদেশের বাইগা আর আর ছত্রিশগড়ের বাইগার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। আমি যেহেতু মধ্যপ্রদেশের বাইগা সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিত হইনি, তাই সেই পার্থক্যের সন্ধান আমি দিতে পারবো না। কিন্তু আমি এই বাইগাজাতির সঙ্গে অনাহার ক্লিষ্ট ভারতবর্ষের অন্যান্য যে কোনও উপজাতির সঙ্গে বা সাধারণ মানুষের কোন পার্থক্য দেখলাম না। রিসর্টের কর্মী মঙ্গল (জাতিতে বাইগা) সে আমাদের নিয়ে গেল বাইগাদের গ্রামে। দরজা আছে কিন্তু জানালা বিহীন ছোট্ট ছোট্ট ঘরগুলো অন্ধকার। ঘরে নিচু হয়ে আপনাকে ঢুকতে হবে এবং প্রায় অনেক ঘরেই মঙ্গল আমাকে নিয়ে ঢুকে দেখালো নেশা করে পড়ে আছে ঘরের পুরুষটি আর নোংরা উঠোনটিতে বসে বাড়ির মেয়েরা ভুট্টা ছাড়াচ্ছে।
জিজ্ঞাসা করলাম: “এত ভুট্টা ছাড়াচ্ছ কেন?”
বললেন: “এটাই খাব সেদ্ধ করে।”
জিজ্ঞাসা করলাম: “এত ভুট্টা ছাড়াচ্ছ কেন?”
বললেন: “এটাই খাব সেদ্ধ করে।”
ওদের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই, ওরা যে ভাষায় কথা বলল সেটাই অনুবাদ করে দিল আমাকে মঙ্গল। প্রায় অনেকের বাড়িতে চালে মিষ্টি কুমড়ো আর চাল কুমড়ো গাছ হয়ে আছে। কোনও কোনও বাড়ির গাছে ফল ধরেছে। একটি বাড়িতে বয়স্ক মহিলা থাকার সুবাদে জিজ্ঞাসা করছিলাম, “আপনারা কী খান?” বললেন: “চেঞ্চ ভাজি, লাল ভাজি।” লাল ভাজি কী? দেখালো আমাদের যেটা লাল শাক সেটাই। আর চেঞ্চ ভাজি? গাছ খুঁজে দেখলাম নালতে গাছ। উঠোনে ছড়ানো রয়েছে কালো কালো শুকনো শুকনো কিছু পাতা। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম চিরতা গাছের শুকনো পাতা। যখন কোনও খাবার জোটে না, তখন এই পাতা সেদ্ধ করে খাওয়া টাই একমাত্র পথ। যে চিরতার জল ছোটবেলায় খাওয়ানোর জন্য মাকে যুদ্ধ করতে হতো, সেই চিরতা গাছের পাতা সেদ্ধ এই সময়ে কারও স্টেপল ফুড হতে পারে এটা ভেবে অসহায় বোধ করা ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
আরও পড়ুন:
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১১: বন থেকে বনান্তরে
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩: ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছিল পঞ্চমের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা
স্বাদে-গন্ধে: একঘেয়ে চিকেন কারি আর ভালো লাগছে না? বাড়িতেই রেস্তোরাঁর মতো বানিয়ে ফেলুন মুর্গ মালাই হান্ডি
হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে অনেক বাড়ির পাশে জবা ফুল দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ওদের বৈদ্যর বাড়ি। বাড়িটি একটু বড় বৈদ্যর পাঁচটি সন্তান, পর পর সন্তানগুলি হয়েছে। সবচেয়ে ছোট সন্তানটিকে কোলে নিয়ে তার স্ত্রী, তার মাস আষ্টেক বয়স। প্রত্যেকটি কন্যা সন্তান। বৈদ্য তার জীবনের কাহিনি শোনালেন। শোনাতে শোনাতে বললেন, কী করে গত বছর মোটর বাইক অ্যাক্সিডেন্টে তার হাত পা পুরো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো সে কী করে জোড়া লাগাচ্ছে কিংবা তার কর্মদক্ষতার কথা যে দক্ষতা নিয়ে নাকি দূর দূর প্রান্ত থেকে আসা লোকেদের ক্যানসারের চিকিৎসা করে দিচ্ছে। কিন্তু তারপরও তার দুরবস্থা।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়
হেলদি ডায়েট: দাঁতকে অবহেলা নয়, শিশুর দাঁতের যত্ন নিন গোড়া থেকেই, সতর্ক হন এই সব খাবারে
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১০: রেমন্ড কোপা এক কিংবদন্তি ফুটবল বাদশা
জিজ্ঞাসা করলাম: “আজ কী খেয়েছেন?”
বললেন: “ওই চেঞ্জ ভাজি আর ভুট্টা সেদ্ধ।”
“ডাল, চাল?”
বললেন: “যেদিন ডাল চাল পাই সেদিন তো উৎসব।”
বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে নিয়ে বসে আছে তাঁর স্ত্রী আমাকে বললেন একটু কিছু টাকা দেবেন বিস্কুট কিনে দেব। আমি তাঁকে দিলাম কিন্তু এটাই তো শেষ কথা নয়।
মঙ্গলের সঙ্গে কথা বলছিলাম। মঙ্গল বলল: “জল আনতে তিন কিলোমিটার নিচে নেমে যেতে হয়। জলের কোনও ব্যবস্থা নেই।”
বললেন: “ওই চেঞ্জ ভাজি আর ভুট্টা সেদ্ধ।”
“ডাল, চাল?”
বললেন: “যেদিন ডাল চাল পাই সেদিন তো উৎসব।”
বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে নিয়ে বসে আছে তাঁর স্ত্রী আমাকে বললেন একটু কিছু টাকা দেবেন বিস্কুট কিনে দেব। আমি তাঁকে দিলাম কিন্তু এটাই তো শেষ কথা নয়।
মঙ্গলের সঙ্গে কথা বলছিলাম। মঙ্গল বলল: “জল আনতে তিন কিলোমিটার নিচে নেমে যেতে হয়। জলের কোনও ব্যবস্থা নেই।”
২০২৩ সালের ভারতে এখনও একটি সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের জল আনতে তিন কিলোমিটার যেতে হয়। পাহাড়ি পথ পেরিয়ে ঝড়বৃষ্টি, শীত কোনও কিছুই মানবে না, যদি না জলটা আনা যায়। এটা তো জল, একদিন এনে সংগ্রহ করে রেখে দিল। কিন্তু অন্য কাজ? সেটা তো একদিনের ব্যাপার নয়। অর্থাৎ শৌচাগার, সেটার জন্যও কিন্তু একই পদ্ধতি।—চলবে
ছবি: লেখিকা
ছবি: লেখিকা
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।