সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি সংগৃহীত। সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

চিত্রকূটের শান্ত সুরম্য বনভূমি। তার বুক চিরে পায়ে পায়ে তৈরি হয়েছে চলার পথ। পিতার পারলৌকিক ক্রিয়া সেরে সে পথ দিয়ে রাম ফিরে এলেন পাতায় ছাওয়া কুটিরের ঘরখানিতে। তাঁর সঙ্গ নিয়ে ফিরলেন সীতা, এলেন অন্যান্য প্রিয় পরিজনেরা। রামের মনের মধ্যে যেন বর্ষার কালো মেঘ আঁধার করে আসছে। দশরথকে হারানোর বিয়োগ ব্যথায় গুমরে উঠছে সকলের মনে। বশিষ্ঠকে প্রণাম করে রাম বসলেন ঘরের মধ্যে। তাঁকে ঘিরে বসলেন অন্য তিন ভাই, বসলেন মন্ত্রী, অমাত্য, সেনাপতি, বিশিষ্ট পৌরপ্রধানেরা। ভরতের যে অনেক কথা বলার আছে রামকে।

ভরত তার মাকে তুষ্ট করার জন্য পিতা যে রাজ্য তাকে দিয়েছিলেন, সে রাজ্য ফিরিয়ে দিতে চাইলেন রামকে। ভরতের বিশ্বাস, বর্ষাকালে সেতু ভেঙে গেলে যেমন হয়, ঠিক তেমন হয়েছে অরাজক অযোধ্যার অবস্থা। এই কঠিন অবস্থা থেকে বর্তমানে রাজ্যকে উদ্ধারের কাজ আর কার পক্ষেই বা সম্ভব, রাম ছাড়া! সকলের উপস্থিতিতে কাতর হয়ে অনুনয় করতে লাগলেন ভরত— “আর্য, ফিরে চলুন অযোধ্যায়। পিতা যে রাজ্য আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন, সে রাজ্য আপনি নিষ্কণ্টক ভাবে ভোগ করুন। পিতা আমাদের গুরু, দেবতা। এ জন্য তাঁর নিন্দা করব না এই সভাস্থলে। কিন্তু প্রবাদ আছে, অন্তিম কালে মানুষ মোহগ্রস্ত হয়। এ প্রবাদ পিতার ক্ষেত্রে সত্য হয়েছে। আপনি রাজ্য গ্রহণ করে আমার মায়ের অপবাদ মোচন করুন। পরম পূজ্য পিতাকে এ পাপের ভার থেকে মুক্ত করুন। মহেশ্বর যেমন সকল লোক জগৎকে করুণা করেন, সেভাবে আপনি আমাদের সকলকে করুণা করুন।”
উত্তরে রাম সান্ত্বনা দিলেন ভরতকে। বুঝিয়ে বললেন, “তুমি নৃপতিশ্রেষ্ঠ পিতা দশরথের উপযুক্ত পুত্র ভরত। কিন্তু পিতা এ রাজ্যভার তোমাকে দিয়ে গিয়েছেন, তিনি আজ ইহলোকে নেই। তাঁর বাক্যকে শ্রদ্ধা করে তুমি রাজ্যভার গ্রহণ কর। আর এ ভাবেই পিতাকে ঋণমুক্ত কর। মাকে অভিনন্দিত কর। আর তুমি যেমন রাজ্যের রাজা হবে ভরত, আমিও তেমন এই বিরাট বিপুল অরণ্যানীর রাজাধিরাজ। বনের প্রাণীরাই আমার প্রজা। তুমি কিছুতেই শোক করো না আমার জন্য। খুশি মনে ফিরে যাও রাজ্যে। আর আমিও তুষ্ট মনে দণ্ডকারণ্যে প্রবেশ করি।

সভায় উপস্থিত জাবালি মুনি শুনছিলেন রাম ও ভরতের বাক্যালাপ। তিনি এবার রামকে উপদেশ দিতে শুরু করলেন— “রাঘব, তোমার জন্য শোকাতুরা নারীর মতো অপেক্ষারত অযোধ্যা। তুমি রাজ্যভার গ্রহণ কর। দশরথ তোমার কেঊ নন, তুমিও তাঁর কেউ নও। জীব এই পৃথিবীতে একাই জন্মায়, একাই মরে। অতএব পিতা, মাতা, ভাই, ভগ্নী— এসব সম্পর্ক আসলে একটা লৌকিক সংস্কার মাত্র। এঁদের সকলের সঙ্গে সম্পর্ক দু’ দণ্ডেরই। এ পৃথিবীতে কে কার? কীই বা মূল্য এসব সম্পর্কের? এঁদের প্রতি যে আসক্ত হয়, সে আসলে উন্মত্ত। আসলে কিছু চতুর মেধাবী মানুষ লোক ঠকানোর জন্য ভাবনা চিন্তা করে শাস্ত্র তৈরি করেছেন। সেসব গ্রন্থে বলা হচ্ছে, যজ্ঞ কর, দান কর, ত্যাগ কর, ধর্ম পথে চল। ইহলোক, পরলোক নিয়ে কত কথা সেখানে বলা হয়েছে। এসব আসলে জনসাধারণকে বশে রাখার জন্য। এই যে তুমি পিতার বাক্য মেনে নিয়ে বৃথা এত কষ্ট করছ। পিতার রাজ্য ফেলে এই গভীর অরণ্যে এসে একটা দুঃখময় জীবন কাটাচ্ছ। এর কোনও সার্থকতা নেই। রাম, তুমি ফিরে যাও। ভরতের অনুরোধ মেনে নিয়ে তুমি রাজ্য গ্রহণ কর।”
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৭: অবশেষে অগ্রজের দেখা মিলল বুঝি…

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৬: বেদজ্ঞান লাভের জন্য কঠোর তপস্যায় ব্রতী হলেন যবক্রীত

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১: আর্ষ মহাকাব্যের স্রষ্টাদ্বয়ের কথা

জাবালির বক্তব্যে যেন ঘোর ভোগবাদী জীবন দর্শন ঠিকরে উঠছে। এসব কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন রাম— “আপনি আমার হিত কামনায় আমার কর্তব্য সম্পর্কে বললেও আমার কাছে এ হল অকর্তব্য। ধর্মনিন্দিত এসব কাজ করে আমার লোকনিন্দা হবে, স্বর্গভ্রষ্ট হব আমি। পিতার কাছে যে সত্য প্রতিজ্ঞা আমি করেছি, তা এখন আর ভঙ্গ করতে পারব না আমি। আপনার মতো এমন বেদবিরোধী নাস্তিককে পুরোহিত ও মন্ত্রী পদে নিযুক্ত করে পিতা অন্যায়ই করেছেন।”

কিন্তু কেন এমন বাক্য বললেন জাবালি মুনি? তিনি কি প্রকৃতই বেদবিরোধী নাস্তিক? না কি রামকে রাজ্যে ফেরানোর জন্য তাঁর এই বাক্‌চাতুর্য? এ প্রশ্নের উত্তর জাবালি স্বয়ং দিয়েছেন। সবিনয়ে বললেন তিনি রামকে, আমি নাস্তিকের বাক্য বলছি না, রাম। আমি নাস্তিক নই। আমি পরিস্থিতি বুঝে আস্তিক বা নাস্তিক হই। তোমাকে বনবাস থেকে ফেরাতে চাই সেজন্য আমি নাস্তিক বাক্য বলেছি আবার তোমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য অন্য রকম বাক্য বলছি এখন।”

রামকে ক্রুদ্ধ দেখে কুলপুরোহিত বশিষ্ঠ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। বোঝালেন তিনি রামকে—“রাম, জাবালি যথেষ্টই জানেন পরলোক বা পুনর্জন্মবিধির বিষয়ে। কিন্তু তিনি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এসব কথা বলেছেন। তবে আমিও বলব, তুমি ফিরে চল। ইক্ষ্বাকু বংশে জ্যেষ্ঠ পুত্র থাকতে অনুজ রাজা হতে পারে না। কুলধর্মকে লঙ্ঘন করা হয় এতে। তুমি কুলধর্ম নষ্ট করো না। আমি তোমার পিতার এবং তোমারও আচার্য। আমার কথা শুনে তোমার অধর্ম হবে না, রাম।”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৬: যিনি নিরূপমা তিনিই ‘অনুপমা’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১: শচীন ও মীরা দেব বর্মনের ঘর আলো করে এল এক ‘দেব শিশু’

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৮: সপ্তপদী: মূল কাহিনিতে দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পুরুষ ও নারীর ভালোবাসার মধ্যে মিলন রাখেননি তারাশঙ্কর

কিন্তু আচার্যের কথাতেও নিজের সিদ্ধান্তে অচল রইলেন রাম। রামকে অনড় থাকতে দেখে ভরত এবার মাটিতে বসে পড়লেন কুশ বিছিয়ে। মরণ পণ করে অনশনের সিদ্ধান্ত নিলেন। রাম বিচলিত বোধ করলেন ভাইয়ের এমন কঠিন সংকল্পে — “ভাই, আমি কি অন্যায় করেছি তোমার সঙ্গে, যে, তুমি আমার কুটিরের দ্বারে এ ভাবে অনশনে বসে থাকবে? এ ব্রত ক্ষত্রিয়ের উপযুক্ত নয়, ভরত।”
ভরত তখন উপস্থিত পুরবাসীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনারা নীরব হয়ে আছেন কেন? কেন রামকে ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন না?” উত্তর এল, “আপনার কথাও ন্যায্য আবার রাম যে পিতৃসত্য রক্ষার কথা বলছেন, তাও ন্যায্য। আমরা বুঝতে পারছি না, এক্ষেত্রে কি বলা উচিত আমাদের।”

পুরবাসীদের কথা শুনে রাম বললেন, “ভরত, প্রজাদের কথা শুনলে তো? এবার তোমার কঠিন ব্রত ত্যাগ করো।” কুশশয্যা ছেড়ে উঠে জলস্পর্শ করলেন ভরত। উপস্থিত মন্ত্রী, পুরোহিত, প্রজাদের দিকে ফিরে বললেন, “সকলে শুনুন, আমি পিতার রাজ্য কখনো চাইনি। এ বিষয়ে আমার মাকেও কোনও পরামর্শ দিইনি। ধর্মজ্ঞানী রামের বনবাস বৃত্তান্তের কথাও আমি জানতাম না। তাঁর অটল সিদ্ধান্তের বিষয়ও আমার জানা ছিল না। তবুও যদি পিতৃসত্য রক্ষার জন্য চোদ্দ বছরের বনবাস জীবন কাটাতেই হয়, তাহলে আমিই ওঁর প্রতিনিধি হয়ে বনে বাস করব।”
আরও পড়ুন:

দশভুজা: এগারো রকমের ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তাঁর ঝুলিতে, একাত্তরেও তিনি গেয়ে চলেছেন জীবনের জয়গান

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৯: মন্দির হয়ে বৌদ্ধবিহার

খাই খাই: অতিথি আপ্যায়নে চাই পাঁঠার মাংসের লোভনীয় পদ? চিন্তা নেই ১০ মিনিটেই জমে যাবে পুজোর ভূরিভোজ! কেমন করে?

রাম ভরতের কথা শুনে বিস্মিত, বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “পিতা জীবদ্দশায় যে সিদ্ধান্ত দিয়ে গিয়েছেন, তাকে লঙ্ঘন করা আমার বা ভরতের সাধ্য নয়। কাজেই এক্ষেত্রে প্রতিনিধি নিয়োগ হতে পারে না। কারণ সত্যের কোনও বিকল্প হয় না।” ভরতকে স্নেহভরে আলিঙ্গন করে বললেন, “ভরত, তুমি বুদ্ধিমান, বিনয়ী। তুমি রাজ্যশাসনের উপযুক্ত। মন্ত্রী, অমাত্যদের সহায়তায় তুমি ঠিক পারবে সুযোগ্য রাজা হয়ে উঠতে। আর আমার আর সীতার শপথ রইল, মা কৈকেয়ীর প্রতি কখনও রূঢ় ব্যবহার করো না।” ভরতের মনের অবরুদ্ধ বেদনা ও গ্লানিবোধ এভাবেই মুছে দিলেন অগ্রজ।

অযোধ্যায় ফিরে আসার জন্য কিছুতেই রামকে রাজি করাতে পারলেন না ভরত। এ যন্ত্রণার উপশম হল কই? শেষে উপায় না দেখে জড়িয়ে ধরলেন রামের দুটি চরণ— “আর্য, আপনার হেমভূষিত পাদুকা দুটিই দিন তাহলে। তারাই সমস্ত লোক জগতের কল্যাণ বিধান করবে। এদের উপর রাজ্যভার দিয়ে আমি চোদ্দ বছর জটা বল্কল ধারণ করে নগরের বাইরে আপনার জন্য অপেক্ষায় রইব। রাজ্যের সমস্ত কাজ আপনার পাদুকাকে নিবেদন করে সম্পাদন করব। কিন্তু চোদ্দ বছর অতিক্রান্ত হলেও যদি আপনার দেখা না পাই, তাহলে অগ্নিতে প্রাণ আহুতি দেব।” এবার ভরতকে আর ‘না’ বলতে পারলেন না রাম।

এক প্রকাণ্ড হাতীর পৃষ্ঠদেশে সেই পাদুকা রেখে রামকে প্রদক্ষিণ করলেন ভরত। এ বার বিদায়ের পালা। রামের আশীর্বাদ নিয়ে যাত্রা করলেন ভরত। বিরাট বাহিনী চলল ফিরে অযোধ্যার পথে। চিত্রকূটের অরণ্যে দাঁড়িয়ে রইলেন রাম, দু’ চোখে জল।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content