মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর, ২০২৪


সাবিত্রীকে নায়িকা করে অগ্রদূতের এই প্রথম ছবি তৈরি। উত্তম-সুচিত্রা-র একচেটিয়া ফিল্মের দাপটে যখন প্রেক্ষাগৃহের পর প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ, সেই সময় পাশাপাশি অন্য নায়িকাদের ছবিও সমান তালে চলছিল। কিন্তু একটা সময় যখন ‘সাবিত্রী-উত্তম’ একটা জুটি বাজারে বেশ নাম করেছিল কিছুদিনের জন্য যেন মনে হয়েছিল তাঁদের জুটিটা ধাক্কা খেয়েছে। সপ্তাহে কয়েকটা দিন স্টারে ‘শ্যামলী’ নাটক করার মাধ্যমে দর্শকদের মনোরঞ্জন করছিলেন এ জুটি।

এই ফাঁকে সুচিত্রা সেন এবং অন্য নায়িকারা যেমন সন্ধ্যারানি, অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা ধীরে ধীরে উত্তম কুমারের পাশে পরীক্ষিত হচ্ছিলেন। কিন্তু আবার পুরনো অবস্থায় যে জুটি নির্মল দে ‘চাপাডাঙ্গার বউ’, ‘বসু পরিবার’ বা আরও দু’ একটা ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন সেই রেওয়াজটা ফিরিয়ে আনেন পরিচালক অগ্রদূত গোষ্ঠী।
এ বছরই অন্যান্য পরিচালকের হাত ধরে সুচিত্রা সেন উত্তম কুমার ফিল্মের জগতে স্থায়ী আসন পাকা করে নেবেন। কিন্তু সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন শক্তিমতী, দক্ষ অভিনেত্রীর পাশাপাশি কীভাবে উত্তম কুমার সে সময় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেটা কিন্তু বেশ ভেবে দেখার।

যথারীতি ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র একটা প্যারালাল সিকুয়েন্স তৈরি করার জন্য অগ্রদূত গোষ্ঠী উঠে পড়ে লেগেছিলেন। অগ্নিপরীক্ষার পরবর্তী আবার যাতে ব্লকবাস্টার একটা ছবি তৈরি করা যায় সে চেষ্টাতে তাঁরা বদ্ধপরিকর ছিলেন।

কিন্তু নায়িকা হিসেবে যদি নতুন মুখ না আনা যায় তাহলে একটা প্রোডাকশন হাউসের কাছে চমক থাকে না। সেই সুবাদে আমরা যদি লক্ষ্য করি দেখতে পাব যে, এমপি প্রোডাকশনের তত্ত্বাবধানে অগ্রদূত গোষ্ঠী ‘অগ্নিপরীক্ষা’ হিট দেবার পরই আবার সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ছবি করছেন একেবারে বছরের শেষের দিকে; ‘সবার উপরে’ তার মাঝে তাঁরা মানুষের স্বাদবদল করার জন্য নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে মনোনয়ন করেছিলেন, যা এর আগে ভেবে দেখেননি।
অর্থাৎ একদিকে যেমন সুচিত্রা উত্তমের জোয়ারে বিভিন্ন পরিচালক হাত পাকাচ্ছেন। দর্শকরা তাদের মনোমতো জুটির অভিনয় দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন, ঠিক সেই ফাঁকেই সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন সর্ব অংশে পারদর্শী অভিনেত্রীকে উত্তমবাবুর পাশে দিয়ে ‘অগ্নিপরীক্ষা’র সমতুল্য একটা ছবি নির্মাণের চেষ্টা হয়েছিল।

আমরা ছবিটার আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে দেখলেই বুঝতে পারব। ছবির গান লিখেছেন ‘অগ্নিপরীক্ষা’-সফল গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ছবিতে সুর করার দায়িত্ব পেয়েছেন ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র মতোই অনুপম ঘটক। ছবিটি সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়েছেন সন্তোষ গঙ্গোপাধ্যায়। ছবিটিতে শব্দ যন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন যতীন দত্ত। এ ভাবে ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র আরেকটা সেম সিকুয়েল তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন।

কিন্তু কপাল এমনই যে ছবিটি সারস্বত মর্যাদায় অনেক এগিয়ে থাকলেও অগ্নিপরীক্ষার সমতুল্য জনপ্রিয়তা পেল না। কারণ সেই সত্যজিৎ বাবু নায়কের মুখ দিয়ে যা বলিয়েছিলেন ‘পাবলিক এক অদ্ভুত জিনিস’। তারা যখন যেটাতে মজে যান সেটা থেকে বেরোতে অনেক সময় লাগে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৫: আঁধার ভূবনে আবার কে তুমি জ্বেলেছ ‘সাঁঝের প্রদীপ’ খানি

আর্থারাইটিসের ব্যথায় দীর্ঘ দিন কষ্ট পাচ্ছেন? স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে ভরসা রাখুন আয়ুর্বেদে

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১: শচীন ও মীরা দেব বর্মনের ঘর আলো করে এল এক ‘দেব শিশু’

দর্শক মঞ্চে উত্তম-সাবিত্রীর শ্যামলী নাটক যেভাবে আপন করে নিয়েছিলেন ফিল্মে এসে মঞ্চের অভিনয় মুক্ত কমপ্লিট ফিল্ম অ্যাক্টিং সম্পন্ন উত্তম সাবিত্রীকে দেখতে ততটা চোখ তাঁরা তৈরি করে উঠতে পারেননি।

ছবির কাহিনি অত্যন্ত সাদামাটা ঘরোয়া। লিখেছিলেন সুনীল জানা। চিত্রনাট্য অগ্রদূত নিজেই তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বারবার যে জায়গাটায় ধাক্কা খেয়ে গিয়েছে, সেটা হল উত্তম-সুচিত্রার ভরা বাজারে এই ছবি সেই অর্থে সেরকম জায়গা করতে পারেনি। কিন্তু সুশীল মর্যাদায় ছবি অনেক এগিয়েছিল। অভিনয়ের পাশাপাশি সঙ্গত করেছিলেন বিকাশ রায়, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, অনুপ কুমার, নীতিশ মুখোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুভা গুপ্তা, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা দেবী, যমুনা সিংহ প্রমুখরা। তবুও ছবি সেভাবে বাজার দখল করতে পারল না। তার কারণ উত্তম-সুচিত্রার ভরা জোয়ারে এ ধরনের ছবি সেই অর্থে দর্শকগ্রাহ্য ছিল না।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের মাছ বৈচিত্র্যের ক্ষতিকারক প্রজাতি হল ক্রোকোডাইল ফিশ

স্বাদে-আহ্লাদে: ম্যাগি ভালোবাসেন? এই রেসিপি ট্রাই করে দেখেছেন?

দশভুজা: এগারো রকমের ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তাঁর ঝুলিতে, একাত্তরেও তিনি গেয়ে চলেছেন জীবনের জয়গান

বলাবাহুল্য যদি সুচিত্রা সেনকে ছবিতে নেওয়া হতো তাহলে বোধহয় ছবিটি অন্যরকম ভাবে দর্শক গ্রহণ করতেন। অন্যদিকে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অন্যান্য ছবি, উত্তম কুমার যেখানে নেই সে ছবিগুলি কিন্তু সুন্দরভাবে রমরমিয়ে চলছে। আবার আবার সুচিত্রা সেনের যে ছবিতে উত্তম কুমার নেই সে ছবিগুলি মুখ থুবড়ে পড়ছে এরকম একটা ভয়ংকর ভাঙাচোরা অবস্থা দেখা দিয়েছিল।
মানুষ বড় অদ্ভুত চরিত্রের যখন যে অংশে তারা একবার নিজেদেরকে নিয়োগ করতেন বা করেন সেখান থেকে বেরোতে অনেক সময় লেগে যায় সেটা উত্তমবাবুর প্রথম জীবনেও ঘটেছিল। ছবি বিশ্বাস, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, ধীরাজ ভট্টাচার্য, নীতিশ মুখোপাধ্যায়দের জমানায় উত্তম কুমারের ফিল্ম অ্যাক্টিং বুঝতে মানুষের ৬ থেকে ৭ বছর সময় লেগেছিল। তারপর রমা অর্থাৎ সুচিত্রা সেনের মত সাপোর্টিং নায়িকার সঙ্গে পেতে উত্তমকে ক্যারিয়ারের শুরুতে পাঁচ থেকে ছয় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
তাঁদের দু’জনের রসায়ন যখন যুগ্মভাবে মানুষের কাছে জায়গা পেয়েছে তখন মানুষ এতোই তাতে বুঁদ হয়েছে এবং সেই আত্ম মগ্নতায় উত্তম-সুচিত্রা যত খারাপই করুক না কেন সেই ব্র্যান্ড ভ্যালু থেকে কখনওই বেরিয়ে যায়নি।

কারণ মানুষ আজও ব্র্যান্ড ভ্যালুকে বড্ড বেশি তারিফ করে, পছন্দ করে যা, সুচিত্রা-উত্তমের আমলে তৈরি হয়েছিল এবং বেশ কয়েক বছর একটানা জনপ্রিয়তার নিরিখে সকলকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল।

সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় পেটের দায় হোক বা অভিনয়ের তাগিদে হোক মঞ্চ অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে যেভাবে লঘু করে ফেলেছিলেন দর্শকদের কাছে, মানুষ তার ছবি টিকিট কেটে হলে দেখতেন বটে কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য অভিনেতাদের অভিনেত্রীদেরও দেখতেন অর্থাৎ একক সাবিত্রী বলে বলীয়ান ছবি মেনস্ট্রিম ছবির পাশাপাশি তৈরি হওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৮: যেখানে বাঘের ভয় সন্ধে ঠিক সেখানেই হয়, আমারও ঠিক তাই হল

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪: শিকারীর গোপন চোখ

হেলদি ডায়েট: সর্দি-কাশিতে ভুগছেন? জেনে নিন কোন ঘরোয়া টোটকায় মিলবে আরাম

সুচিত্রা সেন সে দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী ছিলেন। ক্যামেরা ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমেই নিজেকে তিনি খরচ করেননি। সে কারণে সেলুলয়েডে তাঁকে দেখতে বহু দর্শক বিনা কারণে সমাগম ঘটাতেন।

পরিচালক-প্রযোজক গোষ্ঠী সুচিত্রা সেন নামক অনিন্দ্যকান্তি একজন নারীর সৌন্দর্য নিয়ে ব্যবসা করতেন। তার সুন্দর মুখের নানা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি দেখিয়ে দর্শকদের ভুলিয়ে রাখতেন অর্থাৎ একটা ছবির নির্মাণ কৌশলে যদি কোনও ত্রুটি থাকতো সেটাকে চাপা দিতে পারতেন সুচিত্রা সেনের মুখের নানা রকম লেখা দেখিয়ে; যেটা সাবিত্রির বেলায় করা সম্ভব ছিল না।

তাই এক ঝাঁক বলিষ্ঠ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পাশাপাশি সাপোর্ট দিলেও শুধু কিছু ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে সে সময় অনুপমা ছবিটি মানুষের মনের দাগ কাটতে ব্যর্থ হয়েছি। এরপর পুনর্মুক্তিতে যখন অনুপমা আবার মার্কেটে এল তখন অগ্রদূত নিজেই সুচিত্রা সেনকে নিয়ে অনেকগুলো স্মরণীয় ছবি তৈরি করে ফেলেছেন কাজেই নিজেদের তৈরি ব্যর্থ ছবিকে আর বাজারে বেশিদিন রাখতে তারাও সচেষ্ট ছিলেন না।
এ ভাবেই সে সময় একটা চটজলদি হঠকারী সিদ্ধান্তের মাশুল দিতে হয়েছিল অগ্রদূতের মতো পরিচালক গোষ্ঠীকে এবং সঙ্গে সঙ্গে উত্তম কুমারের কেরিয়ারে। তার মানে এই নয় যার আগামী দিনে সাবিত্রী সঙ্গে কোন ছবি আর নির্মিত হবে না কিন্তু অগ্রদূত গোষ্ঠী যে ছবিটা শুরু করেছিলেন সে ধরনের সাফল্যের রূপরেখা স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি ছবির গান সে অর্থে মানুষের মনে দাগ কাটতে পারছিল না তখনও অগ্নিপরীক্ষার সেই হিট গানগুলো প্যান্ডেলের পর প্যান্ডেল অনুষ্ঠান বাড়ির পর অনুষ্ঠানবাড়ি সমস্ত জায়গাতে বেজে যাচ্ছিল। সেখানে আর কোনো ছবির গান পাশাপাশি জায়গা করে উঠতে পারেনি যতদিন না ‘শাপমোচন’ নামক একটি মিউজিক্যাল হিট মার্কেটে আসছে।

এ ভাবেই একটি ক্লাসিক ছবি শুধু বিচার বিবেচনার সাময়িক বিচ্যুতিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল এবং এখন যদি কেউ বসে উত্তম-সাবিত্রীর ‘অনুপমা’ ছবিটিকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন তাহলে মনে হতে পারে যে যখন উত্তম সুচিত্রার ক্যারিয়ার সেই অর্থে আর নেই; মার্কেটে সাবিত্রীর সঙ্গে অনেক প্যারালাল ফ্রিকোয়েন্স উত্তমবাবু অভিনয় করছেন সেই সময় যদি ছবিটা মুক্তি পেত বোধ হয় অনেকটা গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারতো।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content