মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

এখন হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ খুবই পরিচিত একটি সমস্যা। একে নীরব ঘাতক বা সাইলেন্ট কিলারও বলা হয়। এখন অল্পবয়সীরাও নিজেদের অজান্তেই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এই উচ্চ রক্তচাপ নীরবে তাঁদেরকে নানান শারীরিক অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা বেশিরভাগ মানুষই যতক্ষণ না শারীরিক কোনও সমস্যায় পড়ছি বা আমরা কোনও রকম অসুস্থতার সম্মুখীন হচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের রক্তচাপ মেপে দেখি না। অথচ এই অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ কিন্তু বিভিন্ন কার্ডিওভাসকুলার রোগের যেমন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে। এমনকি, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
 

উচ্চ রক্তচাপ ঠিক কী?

আগে সাধারণত রক্তচাপ ১২০/৮০ এমএমএইচজি (mmHg) হলে স্বাভাবিক রক্তচাপ বলা হতো। ১২০/৮০ এমএমএইচজি-এর থেকে বেশি হলে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ বলে চিকিৎসকরা মনে করতেন। এখন হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ আমরা তখনই বলবো, যখন ওপরের প্রেশার অর্থাৎ সিস্টোলিক প্রেসার ১৪০ এমএমএইচজি (mmHg) বেশি এবং নীচের বা ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেশার ৯০ এমএমএইচজি (mmHg)-এর বেশি হবে।

একটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে সুবিধা হবে। এখন ভারতে ৬৩ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রমিত রোগের কারণে হয়। এর মধ্যে ২৭ শতাংশ কার্ডিওভাসকুলার সমস্যার জন্য এবং যা প্রায় ৪০ থেকে ৬৯ বছর বয়সি মানুষের ৪৫ শতাংশকে আক্রান্ত করে। সর্বোপরি বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের সচেতনতার অভাবের জন্য অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ ক্রমশই বেড়েই চলেছে। অথচ খুব সহজ কিছু পদ্ধতি রয়েছে যেগুলো মেনে চললেই আমরা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি।

আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: কোন সময় গর্ভধারণ করলে সুসন্তান লাভ সম্ভব? নব দম্পতির মা হওয়ার আগের প্রস্তুতির পরামর্শে ডাক্তারবাবু

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৩: রবীন্দ্রনাথের পোশাকআশাক

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দর কাঁকড়া

 

ভারত সরকারের বিশেষ প্রকল্প

উচ্চ রক্তচাপের সমস্যার গুরুত্ব বুঝে ভারত সরকার বিশেষ পদক্ষেপ করেছে। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে যাতে এই সমস্যা ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে ইন্ডিয়ান হাইপারটেনশন কন্ট্রোল ইনিশিয়েটিভ (আইএইচসিআই) নামক জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা মিশনের অধীন দেশব্যাপী একটি বিশেষ প্রকল্প শুরু করেছে। প্রকল্প অনুযায়ী, প্রায় ২২ কোটি মানুষ, যাঁরা উচ্চ রক্তচাপের শিকার, তাঁদের চিহ্নিত করে সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে আনা হবে। এই ২২ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রাদুর্ভাব ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আইএইচসিআই-এর এই প্রকল্পটি ২০২২ সালে ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় ইন্ট্রাজেন্সি টাস্ক ফোর্স (Interagency Task Force) এবং ‘হু’ (WHO) এর প্রাইমারি হেলথ কেয়ার পুরস্কার পায়।

অনেকেরই হয়তো জানা নেই, ভারতের মৃত্যুর এক তৃতীয়াংশই এই উচ্চ রক্তচাপের জন্য ঘটে থাকে। আইএইচসিআই এই প্রকল্পটি ভারতের ২৩টি রাজ্যের ১৩৮টি জেলায় এখন চলছে। প্রায় ৩৪ লাখের ওপর মানুষ এই প্রকল্পের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা সরকারি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রগুলি থেকে পাচ্ছেন।

আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৯: জলে হরি, স্থলে হরি, হরিময় এ জগৎ

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৯: অষ্টবক্র শরীর— পুরুষের সমাজে পুরুষ শরীর

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩: কালাদেওর বলি

 

কখন সতর্ক হবেন?

খুব সাধারণ কিছু শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলেই আমাদের রক্তচাপ মাপা উচিত। যেমন দীর্ঘদিন ধরে মাথা ঘোরা, হঠাৎ চোখে দেখতে অসুবিধে হওয়া, মাথা ঝিমঝিম করা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, ঘাড় ও মাথা ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিলেই সতর্ক হতে হবে। এখন বাজারে নানান ডিজিটাল রক্তচাপ মাপার যন্ত্র পাওয়া যায়। এর সাহায্যে আমরা নিজেরাই ঘরে বসে খুব সহজেই নিজেদের বা প্রিয়জনের রক্তচাপ মেপে নিতে পারি। যদি দেখা যায়, রক্তচাপ খুব বেশি, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তিনি যে ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেবেন সেটি নিয়ম করে খেতে হবে। রক্তচাপ যদি সামান্য বেশি থাকে, তাহলে খুব সাধারণ কিছু জীবনযাত্রা পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা সেটিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারি। সেরকমই কয়েকটি বিষয় আমরা এখানে আলোচনা করে নিতে।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৫: আঁধার ভূবনে আবার কে তুমি জ্বেলেছ ‘সাঁঝের প্রদীপ’ খানি

ডায়াবেটিস থাকবে দূরে, জেনে নিন কোন ফল কতটা পরিমাণে খাবেন, আর কোনটা খেতে হবে সাবধানে, দেখুন ভিডিয়ো

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৮: শ্রীপুরার কাহিনি

 

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এগুলি মেনে চলতেই হবে

 

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

ওজন বৃদ্ধি রক্তচাপ বাড়ার একটি প্রধান কারণ। এখন অল্প বয়সিদের মধ্যেও অনেকে স্থূলতার সমস্যায় ভুগছে। ফলস্বরূপ নিজের অজান্তেই তারা উচ্চ রক্তচাপের শিকার হয়ে পড়ছে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে।
 

নিয়মিত শরীরচর্চা

অনেকেই নিয়মিত শরীরচর্চা নিয়ে মাথা ঘামান না। অথচ নানান সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে ৫ এমএমএইচজি (mmHg) পর্যন্ত রক্তচাপ কমানো সম্ভব। ফলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা এড়াতে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে।
 

স্বাস্থ্যকর ডায়েট

অতিরিক্ত তেল-মশলা জাতীয় খাবারের পাশাপাশি ভাজাভুজি, ফাস্টফুড বর্জন করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রাণিজ প্রোটিনের পরিবর্তে খাদ্য তালিকায় ভেষজ প্রোটিন রাখলে ভালো। এ ভাবেও রক্তচাপকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
 

লবণ খান নিয়ম মেনে

দৈনন্দিন খাবারে লবণের পরিমাণ কমাতে হবে। নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে লবণ খেলে রক্তচাপ প্রায় ৫ থেকে ৬ এমএমএইচজি (mmHg) পর্যন্ত কমানো সম্ভব। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ২,৩০০ মিলিগ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু রোজের ডায়েটে ১,৫০০ মিলিগ্রাম নুন রাখা বেশি নিরাপদ।
 

নেশা বর্জন

মদ্যপান এবং তামাক জাতীয় পদার্থ সেবন অবশ্যই বর্জন করতে হবে। অতিরিক্ত মদ্যপান রক্তবাহী শিরা ও ধমনীর ভিতরের গহ্বর অপ্রশস্ত করে। এর ফলে রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা দেখা দেয়, যা আমাদের রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। সেই সঙ্গে হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি অতিরিক্ত মদ্যপান বাড়িয়ে দেয় স্ট্রোকের ঝুঁকিও।
 

পর্যাপ্ত ঘুম

পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভীষণভাবেই জরুরি। জার্নাল অব ক্লিনিকাল হাইপারটেনশনের একটি গবেষণা পত্র বলছে, অনিদ্রার সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৪৮ শতাংশ। তাই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দিনে অন্তত ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। এর থেকে কম হলে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
 

মানসিক চাপ

অতিরিক্ত মানসিক চাপ রক্তচাপ বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ। মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে অধিকাংশ মানুষই আজ উচ্চ রক্তচাপের শিকার হচ্ছেন। সাধারণত মানসিক চাপ সংক্রান্ত উচ্চ রক্তচাপ ক্ষণস্থায়ী হয়। অর্থাৎ মানসিক চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপ বাড়লেও উত্তেজনা প্রশমিত হলে রক্তচাপ আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু কোনও ব্যক্তি দীর্ঘ দিন ধরে মানসিক চাপে ভুগলে ক্ষতি হতে পারে রক্তবাহের। তাই সতর্ক হতে হবে।

* প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান (health-science): ড. দোলন দাস, (Dolan Das) শারীরবিদ্যার অধ্যাপিকা, কল্যাণী মহাবিদ্যালয়।

Skip to content