রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


১৮৯০। ছবিটি লন্ডনে তোলা।

শুধু গুণবান নন, রূপবানও। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের কথা বলছি। মাতা সারদাসুন্দরীর যত্নআত্তির কোনও খামতি ছিল না। পুত্রের রূপচর্চা নিয়ে রীতিমতো তিনি চিন্তা-ভাবনা করতেন। পুত্রের গায়ের রং খোলতাই হোক, তাঁর জন্য এটা-সেটা যে মাখাতেন, সে সংবাদ আমাদের জানা আছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫২: বইয়ের সব কপি কবির নির্দেশে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দর কাঁকড়া

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৮: শ্রীপুরার কাহিনি

স্বর্ণকুমারী দেবীকে রবীন্দ্রনাথ কোনও বই উৎসর্গ করেননি। স্বর্ণকুমারী অবশ্য করেছিলেন। ‘গাথা’ কাব্যটি রবিকে উৎসর্গ করে তাঁর ‘ন দিদি’ লিখেছিলেন, ‘যতনের গাথা-হার কাহাকে পরাব আর?/ স্নেহের রবিটি, তোরে আয় রে পরাই।’ স্বর্ণকুমারী দেবীর স্মৃতিকথায় আছে তাঁর ছোট ভাইটির রূপসৌন্দর্যের কথা। ভাইটিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মুগ্ধতা, কতদূর বিস্তৃত ছিল, রয়েছে সে বিবরণ। দার্জিলিং ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তাঁরা। দল বেঁধে ভ্রমণ, সকলেই মহিলা, মৃণালিনী, মাধবীলতা, সৌদামিনী, স্বর্ণকুমারী, হিরণ্ময়ী, সরলা ও তাঁদের এক দাসী। এই মহিলা-দলে ‘একমাত্র পুরুষ অভিভাবক’, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এমনই মনে হয়েছিল স্বর্ণকুমারীর।
রবীন্দ্রনাথ তখন ছাব্বিশ বছরের যুবক। চোখে মুখে ঔজ্জ্বল্য, রূপ যেন ঠিকরে পড়ছে। স্বর্ণকুমারী লিখেছেন, ‘আমরা রেল হইতে নামিয়া দামোদিয়ার ঘাটে জাহাজে যখন উঠিতেছি, একজন লোক আমাদের কাছে জিজ্ঞাসা করিল : হ্যাঁ গা ওঁরা কোথা হইতে আসিতেছেন, কোথাকার রাজা বুঝি? এইখানে বলা আবশ্যক, আমাদের অভিভাবকটিকে সাজে গোজে অনেকটা রাজার মতোই দেখাইতেছিল। একে সুশ্রী সুন্দর মুখ। তাতে চুলগুলি কোঁকড়া কোঁকড়া লম্বা লম্বা তার ওপর হিন্দুস্থানী পাগড়ি— রাজা মনে করা কিছুই আশ্চর্য ছিল না।’

১৮৯৭, কলকাতা।

ঠাকুরবাড়ির জামাতা, কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল, হ্যাঁ, প্রমথ চৌধুরীর কথা বলছি। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্র-পরিচয়’ নামে একটি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ কতখানি সুদর্শন ছিলেন, তার শব্দছবি ধরা আছে, সে লেখায়। প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমি এর পূর্বে রবীন্দ্রনাথের মতো সুপুরুষ কখনো দেখিনি। তাঁর বর্ণ ছিল গৌর, আকৃতি দীর্ঘ, কেশ আপৃষ্ঠ-লম্বিত ও কৃষ্ণবর্ণ, দেহ বলিষ্ঠ, চরম মসৃণ ও চিক্কণ, চোখ-নাক অতি সুন্দর।’ বিক্ষিপ্ত সৌন্দর্য নয়, তিনি সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। প্রমথ চৌধুরী উল্লিখিত রচনায় জানিয়েছেন, ‘গৌরবর্ণ স্ত্রী-পুরুষ একান্ত বিরল নয় বিশেষত বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ সমাজে।’ সে গৌরবর্ণ তাঁর কাছে নিতান্তই ‘কটা’। লম্বা লোকও দু-চারজন তিনি দেখেছেন কিন্তু তাঁদের দেহ ‘সুগঠিত’ নয়, পদে পদে ‘দেহের ছন্দপতন’ ঘটেছে। সুন্দর মুখও তিনি দেখেছেন, ‘সেসব মুখ যেন প্রক্ষিপ্ত, দেহ থেকে উদ্ভূত নয়।’ রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য যেন সর্ব অঙ্গে, সর্বাঙ্গীণ। প্রমথ চৌধুরীর ওই লেখায় আছে, ‘তাঁর সর্বাঙ্গ ছিল প্রাণে ভরপুর, প্রাণ তাঁর দেহে ও মুখে টগবগ করত। তিনি ছিলেন একটি জীবন্ত ছবি। রূপের যদি প্রসাদগুণ থাকে তো সে গুণ তাঁর দেহে ছিল।’
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: চিকেন প্রিয়? তাহলে এমন হায়দরাবাদি চিকেনে জমিয়ে দিন দুপুর

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৬: রামের সন্ধানে ভরতের যাত্রা সফল হল কি?

ইংলিশ টিংলিশ, তোমরা কি জানো cakewalk বা icing on the cake —এই idiom গুলোর মানে কি?

কবি নবীনচন্দ্র সেনের ‘আমার জীবন’ বইতে আছে তরুণ রবীন্দ্রনাথের রূপ-বর্ণনা। খানিক আলংকারিক ভাষায় নবীন কবিকে ঘিরে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন নবীনচন্দ্র। তিনি লিখেছেন, ‘কী শান্ত, কী সুন্দর, কী প্রতিভাম্বিত দীর্ঘাবয়ব। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ। স্ফুটনোন্মুখ পদ্মকোরকের মতো দীর্ঘ মুখ, মস্তকের মধ্যভাগে বিভক্তকুঞ্চিত ও সজ্জিত কেশশোভা। …দীর্ঘ সমুজ্জ্বল চক্ষু, সুন্দর নাসিকায় মার্জিত সুবর্ণের চশমা। বর্ণগৌরব সুবর্ণের সহিত দ্বন্দ্বে উপস্থিত করিয়াছে। মুখাবয়ব দেখিলে চিত্রিত খ্রিস্টের মুখ মনে পড়ে।’

১৯০৫, সুকুমার রায়ের তোলা ছবি।

আমরা জোব্বা-পোশাকে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে অভ্যস্ত। জোব্বা পরে তো আর তিনি জীবনভর কাটাননি। ভিন্নতর পোশাকআশাক পরেছেন। সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হওয়ার ক্ষেত্রে পোশাকের ভূমিকা তো রয়েই যায়। তাই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, তাঁর পোশাক নিয়েও। প্রমথ চৌধুরী এই স্মৃতিকথাটি যে সময় লিখেছিলেন, সে সময় রবীন্দ্রনাথ গায়ে জামা পরতেন না। ওই লেখা থেকে জানা যায়, গায়ে জামা দিতেন না। পরতেন ধুতি, আর গায়ে দিতেন চাদর।’

১৯২৭,জাভায় তোলা

কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ পিতৃদেবকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাঁর লেখায় আছে পিতৃদেবের পোশাকআশাকের বিস্তৃত বিবরণ। পোশাকআশাক নিয়ে কবির উদাসীনতা ছিল, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। কেমন পোশাক পরবেন, তা নিয়ে কবি রীতিমতো ভেবেছেন। সে ভাবনা ছিল বড়ই ব্যতিক্রমী ও বৈচিত্র্যময়। পোশাকের সেই বৈচিত্র্য, পরিবর্তন ও প্রকারভেদ পুত্র রথীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে যায়নি। তাঁর লেখায় আছে, ‘তরুণ বয়সে তিনি (রবীন্দ্রনাথ) ধুতির ওপর সিল্কের ঢিলে পাঞ্জাবি পরতেন। গলায় ঝোলাতেন সিল্কের চাদর। এই বাঙালিবাবুর পোশাকে তাঁকে ভারি সুন্দর দেখাত। বাংলাদেশের বাইরে তিনি যখন বেড়াতে বেরোতেন, তাঁর পরনে থাকতো ট্রাউজার, গলাবন্ধ লম্বা কোট, অথবা আচকান, আর মাথায় থাকত ছোট্ট একটা পাগড়ি। এই ভাঁজে ভাঁজে সেলাই করা পাগড়ি ছিল নতুন জ্যাঠামশাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আবিষ্কার। লোকে এর নাম দিয়েছিল ‘পিরালি পাগড়ি।’

১৯৩৪, জোড়াসাঁকো।

জোব্বা পরা যে পোশাকে আমরা রবীন্দ্রনাথকে চিনি, সে অনেক পরের কালের ঘটনা। এ পোশাক তাঁর উত্তর-পঞ্চাশের পোশাক। রবীন্দ্রনাথ এক সময় ধুতি চাদর বেশি পরতেন। জোব্বা পরা ছবি যতটা প্রচারিত, জোব্বা না-পরা ছবি ততটাই আড়ালে রয়েছে। পায়ে থাকত চটি। রবীন্দ্রনাথের যে বিয়ের ছবি পাওয়া যায়, তাতেও লক্ষ্য করি, অন্য বাঙালি বরের মতো তিনিও ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছেন। সঙ্গে গায়ে শাল দিয়েছেন। দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় গগনেন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। সে বইতে আছে এই জোব্বা-পোশাক গগনেন্দ্রনাথের নির্দেশনায়, ব্যবস্থাপনায় তৈরি হয়েছিল। প্রথমে সে পোশাক তিনি একান্তই তৈরি করিয়েছিলেন নিজের জন্য। পরে অবনীন্দ্রনাথ ও সমরেন্দ্রনাথের জন্য। একেবারে অন্যরকম পোশাক, দেখে তো চমকিত রবীন্দ্রনাথ। খুশি হয়ে গগনেন্দ্রনাথ কাছে এমন পোশাক পরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন কবি। অত্যন্ত স্নেহ করতেন তাঁকে। তাঁর কথা ফেলবেন কী করে গগনেন্দ্রনাথ! জোড়াসাঁকোয় আসা জাপানি শিল্পীদের ঝোলা-পোশাকের অনুকরণে নিজেই করেছিলেন এই জব্বার নকশা। সেই নকশা মিলিয়ে ঠাকুরবাড়ির দর্জি ফতেউল্লা তিন ভাইয়ের জন্য শুধু নয়, রবীন্দ্রনাথের জন্যরও বানিয়ে দিয়েছিল সেই জবর পোশাক। জোব্বা-পোশাক।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: শিশুকে কোন ওষুধ কখন খাওয়াবেন? ওষুধ খাওয়ার সঠিক নিয়ম কী? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৭: উত্তমের প্রশ্নে মজাদার জবাব ভানুর, হাসির বন্যা বয়ে গেল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো ফ্লোরে

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৮: হৃদয়মন্দিরে মন শুদ্ধ করে দেবতা প্রতিষ্ঠা করলে তবেই তো দেবতার পুজো হবে

রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, লম্বা কোট বা আচকান, মাথায় পাগড়ি — এসবের অনেক পরে জোব্বা পরা ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রথীন্দ্রনাথের লেখায় আছে, ‘বাবা আচকানের বদলে ঢিলেঢালা লম্বা জোব্বা ধরলেন। কখনও কখনও একটি জোব্বার উপর আর-একটা জোব্বা চড়ানো হতো। মাথায় পরতেন নরম মখমলের উঁচু গোছের টুপি। রঙিন কাপড়ে বাবার কোনও বিরাগ ছিল না। তার পছন্দ ছিল ফিকে বাদামি বা কমলা রঙ। পরিণত বয়সে যাঁরা বাবাকে দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয় মনে আছে এইসব হালকা রঙের পোশাকে বাবাকে কী সুন্দর মানাত।’

কবি-শিল্পীরা নিজের ভেতর মগ্ন হয়ে থাকেন। উদাসীন বাউলের মতো তাঁদের জীবনযাপন। একথার সত্যতা অবশ্য রবীন্দ্রনাথের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি রূপে সুন্দর। সেই সৌন্দর্যকে কীভাবে লালন করতে হয়, তা অজানা ছিল না তাঁর। সেই কারণেই ছিলেন এমন পোশাক-সচেতন। রূপ-সৌন্দর্যে ও পোশাক-অভিনবত্বে রবীন্দ্রনাথ সুন্দরতম হয়ে উঠেছিলেন।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content