শনিবার ৫ অক্টোবর, ২০২৪


ছত্রিশগড়ের প্রকৃতিতে পরিবর্তনের রং নিশ্চয়ই লেগেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। চারপাশের পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ রাজ্যেও সভ্যতার আলো জ্বলে উঠছে। কিন্তু অসুবিধাজনক কিছু অবস্থান স্বীকার করে নিয়ে বলতে পারি ছত্রিশগড়ের অনেকাংশেই এখনও সভ্যতার সার্চলাইট সেরকম ভাবে প্রবেশ করেনি। চকচক শিল্পাঞ্চল একটু ছাড়িয়ে গেলে আপনি পাবেন অরণ্য ভূমি, নাগরিক সুখবিলাসের উপকরণ যেখানে নেই। সেখানে বহিরাগত সংস্কৃতির আগ্রাসী আক্রমণ এখনও অতটা প্রবেশ করতে পারেনি। তারা ছত্রিশগড়ের মূলধর্মটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। সেই কারণে যেখানে এত কিছু রয়েছে, সেইসব মানুষদের খোঁজে মাটির ঘ্রাণ নিতে প্রকৃতির টানে মানুষকে তো আসতেই হবে।
ছত্রিশগড়ে বেড়াতে গিয়ে তো আপনি যেকোনও জায়গায়, যেকোনও মাসে, বছরের যেকোনও সময় কোনও না কোনও ধর্মীয় পরব, উৎসব আনন্দে যোগ দিতেই পারবেন। এত বৈচিত্র্য সেখানে। কোন ধর্মমেলা, সরগুজার করম উৎসব, দান্তেওয়াড়াতে দন্তেশ্বরী মাতার পুজো এবং উৎসব, রাজিম কিংবা মালহারে শিব রাত্রির আয়োজন এবং আগেই তো বলেছি বাস্তারের দশেরা। এমন আরও অনেক ছোট বড় মেলা অনুষ্ঠান ছড়িয়ে আছে এ রাজ্যে। সারা বছরের দুঃখ কষ্টের দৈনন্দিনতাকে ভুলে গিয়ে ছত্রিশগড়ের মানুষ এগুলোর সঙ্গে নিজেদেরকে জড়িয়ে রেখেছে। তাদের নিজস্বতা ধরা পড়েছে পরব উৎসবে, লোকধর্ম উৎসবের সার্বজনীন আবেদন এখনও বোধহয় রয়েছে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৫: জনজাতি ও জনসত্ত্বা

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫: মেরুর দিকে পৃথিবী কিছুটা চাপা, তাই এখানে দুটি কাছাকাছি অঞ্চলের মধ্যেও সূর্যালোকের পার্থক্য অনেকটা

আদিবাসী গোষ্ঠীর জীবনকৃত্যর সঙ্গে ছত্রিশগড়ের অন্য মানুষেরা জড়িয়ে পড়ছে। যেমন ধরুন বৈশাখে কুমারী মেয়েদের প্রাক বিবাহের উৎসব, শ্রাবণে সবুজ বন্দনায় হারেলি উৎসব, শ্রাবণ ভাদ্রে বীজ উৎসব, ভাদ্র মাসে গরু মোষের পুজো উপলক্ষে পৌলা উৎসব, করম পুজো, আশ্বিন মাসে দন্তেশ্বরী পুজো তার পরে দশেরা বাস্তারের, কার্তিকে মড়ই উৎসব, শস্য দেবতার উৎসব, মাঘ মাসে রাজীবলোচন মহোৎসব, যেটা রাজিমে হয়, আশ্বিনে হোলি, চৈত্রে মাটি পুজো, ভীমপুজো, শিবপুজো। আপনি যেসময় ছত্রিশগড়ে আসুন না কেন কোনওরকম পরিকল্পনা না করে এলেও আপনি কোনও না কোনওভাবে এ রাজ্যবাসীর উৎসবের আনন্দের সঙ্গে, আদিবাসী জীবনের বিশেষ বিশেষ উৎসবের সঙ্গী হয়ে উঠতে পারবেন অনায়াসে। আর কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে না। পরিচিত জায়গাগুলোকে টার্গেট করে বেরিয়ে পড়ুন, কেন না নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার পথে কত যে অজানা জিনিস আপনার পথে ধরা পড়বে তা আপনি নিজেও জানেন না নিজে বুঝতেও পারবেন না। ক্রমশ তার থেকে আনন্দ আপ্যায়ন অনুভব করবেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৬: কানে খোল, তেল দেন?

দশভুজা: সুন্দরবনের অনেক শিশুর শিক্ষার অধিকার রক্ষায় ব্রতী এই শিক্ষিকা

ছত্রিশগড় মানেই বাস্তার, আর বাস্তার মানেই চিত্রকূট জলপ্রপাত এ ভাবে ভাবলে কিন্তু ছত্রিশগড়কে চেনা যায় না। জঙ্গল, পাহাড়, নদী, অরণ্য, মন্দির, পুরাতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ, আদিবাসী লোকশিল্প সব মিলিয়ে ছত্রিশগড়ের একটা কমপ্লিট ফ্লেভার। তিন ভাগে ভাগ করে আপনি ছত্রিশগড় দেখতে পারেন। একটা পশ্চিম দিক থেকে অর্থাৎ বাস্তার, দান্তেওয়ারা, একটা উত্তর দিক থেকে অর্থাৎ রায়পুরের দিক থেকে আরেকটা পূর্বদিক থেকে। রায়পুর থেকে যদি আপনারা যাত্রা শুরু করেন তাহলে এই রাজ্যের বেশ কিছু স্মৃতিস্তম্ভ কারুকার্য প্রত্নতত্ত্ব যাদের আগ্রহের বিষয় সেই প্রত্নতত্ত্ব এবং জঙ্গল সব কিছুই কিন্তু আপনারা দেখতে পারবেন। যেসব রাজবংশ এখানে রাজত্ব করেছে তারা হল— পান্ডুবংশী, শোনবংশী, কলচুরি, নাগবংশী। রয়েছে অসংখ্য কারুকার্যমণ্ডিত মন্দির, বৌদ্ধবিহার, দুর্গ, রাজপ্রাসাদ এমনকি হিন্দু বৌদ্ধ জৈন খৃষ্ট মুসলিম সমস্ত ধর্মের মিলনক্ষেত্র এইরাজ্য। বৈষ্ণব সমাজের মহাপ্রভু বল্লভ আচার্য, বিখ্যাত কবি কবীর দাস, সৎনামি সমাজের গুরু ঘাসিদাস সকলেই কিন্তু এই ছত্রিশগড়ের মানুষ ছিলেন।
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন? সুস্থ থাকতে কোন ১০টি ফল খাবেন?

স্বাদে-আহ্লাদে: খুদের টিফিনে কী দেবেন ভেবেই মাথায় হাত? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন মুগ ডালের চিল্লা!

ছত্রিশগড়ে এমন কিছু কিছু বিখ্যাত তীর্থ ও মন্দির দেখার সুযোগ পাওয়া যায় যাদের নাম পশ্চিমবঙ্গ কেন ভারতবর্ষের পর্যটক মহলেই এখনও পর্যন্ত পরিচিত নয়। যাত্রা শুরু করা যায় যদি রায়পুর থেকে, তাহলে ২৫ থেকে ৩০কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামে এসে আপনি পৌঁছাবেন যে গ্রামটির নাম চন্দকুরী, চন্দ্রকুরীও কেউ বলে। ভারতবর্ষের একমাত্র কৌশল্যা মাতার মন্দির। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এ আর আলাদা কি? বিশাল একটি হনুমানের স্ট্যাচু বাইরে এবং একটি সুন্দর মন্দির পরিসর। ভেতরে গেলে দেখতে পাবেন কবেকার নির্মিত এবং মাটি খুড়ে পাওয়া কৌশল্যা এবং রামের একটি মূর্তি। চারপাশে শান্ত পরিবেশ আপনাকে নিশ্চয়ই শান্তি এনে দেবে মনে। চন্দকুরির মন্দিরের সামনে দেখবেন ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা অজস্র পদ্মফুল বিক্রি করছে নানারঙের। নীল পদ্ম, পাওয়া যায় লাল পদ্ম‌ পাওয়া যায় সাদাপদ্ম এবং এগুলোই মন্দিরে নিবেদন করা হয়।
আরও পড়ুন:

যোগা-প্রাণায়াম: বাহু ও পিঠে বেশ ফ্যাট জমছে? ছিপছিপে থাকতে নিয়মিত যোগাভ্যাস করুন

ডায়াবিটিস বাগে আনতে কোন প্রোটিন খেতেই হবে, আর কী কী এড়াতেই হবে?

প্রসঙ্গত বলে রাখি এ সব বাচ্ছারা তাদের পরিবারের আর্থিক উপার্জনের উৎস। কাছাকাছি পুকুর থেকে তারা পদ্ম তুলে এনে বিক্রি করে এবং এদের অনেকে ইস্কুলে পড়ার সুযোগ পর্যন্ত পায় না। খাবার সুযোগ পর্যন্ত পায় না। জিজ্ঞাসা করাতে একটি বাচ্ছা বলল, সকালবেলা ভাত হয়নি বাড়িতে পয়সা নিয়ে যাবে তবে ভাতের বন্দোবস্ত। মন্দিরের পাশে যে ডালাগুলো পাওয়া যায় সেগুলোর বিক্রেতাও কিন্তু মহিলারা। এটি একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, কারণ পুরুষেরা তারা হয়তো বা এই অঞ্চলে শিল্পের উন্নতির কারণে, কিংবা ফরেস্টের সম্পদ সংগ্রহের কারণে বেরিয়ে যায়। বাড়ি থেকে গ্রামের থেকে দূরবর্তী স্থানে থাকে। ফলে তাদের পরিবারকে প্রতিপালন প্রতিদিনের সমস্যা।
আরও পড়ুন:

গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৩: শোকস্তব্ধ অযোধ্যানগরী কি আপন করে নিল ভরতকে?

চন্দকুরি থেকে বেরিয়ে হাইওয়ে ধরলে এক অন্য ছত্রিশগড়। ঝকঝকে রাস্তা গাড়িতে স্পিড যথেষ্ট তুলে আপনি যেতে পারেন। তুলনামূলকভাবে টুরিস্ট এবং অন্যান্য লোকেরা কম বলে যানবাহনের সংখ্যা কম। রাস্তার দু’পাশে অজস্র রাইস মিল, জিন্দালদের কারখানা, আম্বানিদের কারখানা, ঝকঝকে ছত্রিশগড়। কিন্তু তার পেছনের গ্রামটি, শুধু একটি গ্রাম নয় আরও অজস্র গ্রাম তার মানুষগুলো অন্নাভাবে। এক অদ্ভুত বৈপরীত্য।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৮: মেয়ের জন্য হেমন্তবালা কবির পরা জোব্বা নিয়েছিলেন

ষাট পেরিয়ে, পর্ব-২৪: বয়সেও আসুক বসন্ত

রাস্তা দিয়ে মাইলের পর মাইল যাচ্ছেন কোথাও সহজে কোন চায়ের দোকান কিংবা ছোট খাটো খাবারের দোকান পাবেন না। যতটুকু বুঝতে পারা গেল স্থানীয় বাসিন্দারা চা খাওয়ার মতো সৌখিনতাকে প্রায় বর্জন করেছে। কারণ চা কেনার পয়সা বোধহয় তাদের অতটা নেই। একমাত্র স্টেপল ফুড ভাত। কারণ প্রচুর চাল উৎপন্ন হয়।
ডানদিকে বাঁদিকে রাস্তার দু’পাশে ক্ষেত জুড়ে ধান, বেগুন এবং ঢেঁড়স। এছাড়া কোনও সবজি আপনি দেখতে পারবেন না। ফলে তারা দিনের মধ্যে তিনবারই ভাত খায় সেটা শুধু ভাত, ভাত সেদ্ধ করবার মতো ক্ষমতা আছে তাদের। আর হয়তো কিছু জোগাড় করবার মতো ক্ষমতা নেই। চন্দকুরি থেকে কিছুটা দূর যাওয়ার পরেই আপনি পেয়ে যাবেন ছত্রিশগড়ের লাইফলাইন মহানদীকে। বিশাল ব্রিজ, সেই ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আপনি বর্ষাকালে তো বুঝতেই পারবেন মহানদী উদ্দামতাকে। বর্ষা ছাড়া অন্য সময় গেলে মহানদী আপনাকে আকৃষ্ট করবেই। ইচ্ছে করবে গাড়ি থেকে নেমে একটু দাঁড়িয়ে মহানদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে কিংবা ব্রিজ ধরে হেঁটে হেঁটে নেমে গিয়ে মহানদীর কাছে গিয়ে বসে তার ছোট ছোট ঢেউয়ের গুঞ্জন শুনতে।—চলবে

ছবি সৌজন্যে: লেখিকা
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content