শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

আমাদের সমাজে লিঙ্গ বিষয়টি নিয়ে আপাত অর্থে আলোচনা করতে দেখা যায় না প্রতিদিনের দিনলিপিতে। কারণ, আমাদের সমাজ বিপরিতকামী লিঙ্গ বিভাজন বা সহজ করে বললে নারী-পুরুষের বিভাজনকে মনে করে স্বাভাবিক। এই ‘দুই’ এর আগে পরে যদি কিছু দেখা যায় সেগুলিকেও ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এই দুই ‘পরিচিতি’ এর মধ্যে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু যদি এই বিপরিতকামী লিঙ্গ বিভাজন নিয়ে আমরা সমাজ গড়ি, তাহলে সমস্যা কার হচ্ছে? আমার? সমাজের? রাষ্ট্রের?

সৌরভ কিরপালকে পাঁচ বছর ধরে দিল্লি হাই কোর্টের এর বিচারপতি করা হয়নি। কারণ, তিনি নিজেকে বিপরিতকামী পুরুষ না বলে সমকামি বলেছেন। সমাজ, রাষ্ট্র বারংবার আইনি পর্যালোচনা করে যাচ্ছে লিঙ্গ বিভাজনের বিষয়টি নিয়ে। কারণ, সমাজ একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গ কাঠামোর ঘেরাটোপ তৈরি করতে চায়, যাতে সমাজের সদস্যরা নির্দিষ্ট লিঙ্গ এবং সেই রকম যৌন আচরণ করবে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কোন অস্থিরতা পছন্দ করে না।
এখন সমস্যা হচ্ছে, সেই সব মানুষদের যাদেরকে আমরা বাধ্য করছি এই ‘দুই পরিচিতি’ এর মধ্যে নিজেদের অবস্থানকে সুনির্দিষ্ট করে নিতে। আমরা বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণাতে বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস শুধু নয়, আমরা এই দুই পরিচিতির মধ্যে থেকেও নিজেদের সমানাধিকার দিচ্ছি না। সেখানেও একজন ক্ষমতাশালী আর একজন ক্ষমতার নীচের সিঁড়িতে অবস্থান করছেন। তাই যিনি ক্ষমতার সিঁড়িতে উপরে উঠতে পারছেন না, তিনি সমাজের চোখে পুরুষ অঙ্গধারী হলেও তিনি পুরুষ নামে পরিচিত হতে পারছেন না! তিনি তখন মাঝামাঝি অবস্থানেও স্থান পাচ্ছেন না। তাঁকে তখন নারীর সঙ্গে এক আসনে নাবিয়ে আনা হচ্ছে। যে পুরুষ হতে পারছেন না সোজা কথায় সমাজ তাঁকে দুর্বল বলে ভাবে।

মানুষকে তাঁর পরিচিতি বা আইডেন্টিটি তৈরি বা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এতটা কঠোরতার সন্মুখীন হতে হয় কেন? আসলে সমাজে আমাদের লিঙ্গ পরিচিতির সঙ্গে কোথাও আমাদের সমাজ নির্দিষ্ট ভুমিকা পালন করছে? কতটা সমাজে নির্দিষ্ট পথে পারদর্শী হয়ে পালন করতে পারছি, তা খুব বড় ভুমিকা পালন করে। আরও একটু খুলে বলার চেষ্টা করলে, মনের মধ্যে সেই ছবিগুলো তুলে আনতে হবে যেখানে সমাজে কেউ গান গাইতে পারে। এটা বলা মাত্রই ধরে নেবেন যে তার গলার সুর ঠিক আছে, উচ্চারণ সুস্পষ্ট, কিন্তু সে যদি নিজের মতো করে আবৃত্তি করে গান গাইতে চায় অর্থাৎ তাঁর নিজের ভালোলাগার জায়গা সমাজ তাঁকে দিতে চায় না। সমাজ চাইছে যাকে নারীর ভুমিকা পালন করতে হবে তিনি যদি বলেন তিনি নারী পুরুষ কোনও ভূমিকা পালন করবেন না, সমাজ তা সহজে মেনে নেবে না।

সমাজ সবসময় তার নির্দিষ্ট করে দেওয়া পথে তোমাকে, আমাকে দেখতে চাইবে। সেই রাজপথ ছেড়ে মেঠো পথ বা সমান্তরাল পথ ধরলেও আপত্তি ধেয়ে আসবে। প্রথমে সাবধান করতে চাইবে। তারপরও আপনি যদি তা না শোনেন, তাহলে সমাজ আপনাকে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে দেবে। তারপর এমন ভাবে আক্রমণ করা হবে, যা মানুষের বিচার-বিবেচনা বোধকে উপেক্ষা করে জীবন ঝুঁকির কারণ হয়েও দাঁড়াতে পারে। ডাইনি প্রথা, সতীদাহ প্রথার ইতিহাসে চোখ বোলালেই তা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৩: বাইরে ঘর, ঘরের মধ্যে ঘর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৯: গুরুদেবের দেওয়া গুরুদায়িত্ব

তাহলে এবার সমাজের লিঙ্গ নির্মাণ প্রক্রিয়াতে পুরুষলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ প্রক্রিয়ার আনাচ-কানাজগুলো বুঝে নেওয়া যাক। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যে ভাবে লিঙ্গ নির্মাণ করে সেখানে যে কাঠামো আমাদের সামনে দিয়ে দিয়েছে সেটা হল, যে পুরুষ রূপে জন্মেছে সে প্রথমে পুরুষ হবে। তারপর ক্রমেই নারীকে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ করবে। আসলে সমাজ চায় পুরুষ বাসনা করবে নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে। আর যে নারী রূপে জন্মেছে তাকে পুরুষ গ্রহণ করবে। অর্থাৎ নারী-পুরুষ এই বিভাজন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কাছে প্রাকৃতিক।

কিন্তু নারীবাদীদের একাংশের মতে, এই লিঙ্গ বিভাজন সমাজ নিজে করেছে। সচেতন ভাবে করেছে। খুব কঠোর এই বিভাজন, যা কোনও ভাবে প্রশ্ন করা যাবে না। কোনও ভাবেই ভাঙ্গা যাবে না বা পরিবর্তন করা যাবে না। কোনও কোনও সমাজে এই লিঙ্গ বিভাজন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকে। যে মুহূর্তে ডাক্তার জানাচ্ছেন, আপনি মা হতে চলেছেন সেই মুহূর্ত থেকেই আপনি ভাবতে শুরু করেন সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে? সেই সঙ্গে কোন লিঙ্গের সন্তান আপনার দরকার সমাজের বুকে সসম্মানে টিকে থাকার জন্য সেই সব জল্পনা এবং প্রস্তুতিও চলতে থাকে। আর যে সমস্ত পশু-পাখিকে মানুষ গৃহপালিত করেছে তাদেরও লিঙ্গ ভেদ করে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী আচরণ কেটে খাওয়া থেকে শুরু করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া পর্যন্ত সবই আছে।
আরও পড়ুন:

ডায়েট ফটাফট: সব খাবারের সেরা সুপারফুড কিনোয়া খান, ওজন কমান

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৩: বাবা বিশ্বনাথের দরবারে

তাহলে বলা যেতে পারে যে, লিঙ্গ শব্দটির উৎপত্তির সঙ্গে ভাষাতত্ত্ব এবং আইনি বিষয় জড়িত আছে। সমাজ শুধু নারী বা পুরুষ লিঙ্গ নির্মাণ করেই থেমে থাকেনি বরং সমাজ নারী লিঙ্গ নির্মাণ করেছে পুরুষ লিঙ্গের সাপেক্ষে। তার মানে হল, পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত না হওয়া অব্ধি নারীর অস্তিত্ত্ব বিপন্ন। আমাদের শাস্ত্রের কথাটা আবার মনে করিয়ে দিই। মনু স্মৃতি-এর নবম অধ্যায়তে বলা আছে, নারী কখনওই স্বাধীনতা পেতে পারে না। তাকে শিশু বয়েসে রক্ষা করবে তার বাবা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যকে পুত্র সন্তান। পুত্র সন্তান কেন দরকার আর তা নিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কেন এত মাতামাতি সেটা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা গেল। সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, নারী কখনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেনি।

তাহলে তাদের কি পরিচিতি দেওয়া হবে? সে কি নারী নয়? যে পুরুষ নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় না তাকেই বা সমাজ কি নামে ডাকবে? সে কি তাহলে মেয়েলি পুরুষ? পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এই ধরনের অস্থিরতা পছন্দ করে না। তাই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সম্পর্ক স্থাপন করাতেই জোর করতে থাকে। তাই বলা হয়, যা কিছু সমাজে আছে, নারীও আছে সেই লিস্টে। সবই পুরুষদের নির্মাণ। নারীর কোনও অস্তিত্ত্ব নেই। কিন্তু সম্পূর্ণ অস্তিত্ত্বহীন, তাই আবার নয়। নারীর শরীর, নারীর কথা বলা, চলা অর্থাৎ প্রতিটি বিষয় সমাজের স্ক্যানারের মধ্যে দিয়ে যাবে, সেখানে পুরুষ যেন শরীরহীন।

কারণ, তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। যা বলা আছে সেগুলো সবই সূক্ষ্ম বিষয়। খালি চোখে তা ধরা পড়ে না। সে যেন সাধারণ মানুষ। সমাজ নির্দিষ্ট দল ভুক্ত মানুষ। এই দলের সদস্যদের প্রশ্ন করার অধিকার নেই পরস্পরকে। এই মানুষগুলো তর্ক করবে না কখনও। এই সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ না নেওয়ার মধ্যে দিয়ে আসলে নিজেদের দমন করতে থাকে। নিজেদের মধ্যে যে সমস্ত বৈচিত্র্য আছে সেগুলো কোনওভাবেই স্বীকৃতি পাক তা চায় না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২১: কে তুমি নিলে আমার চিরসবুজের ‘অগ্নিপরীক্ষা’

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৯: মিশ্র মাছ চাষের অভিনবত্ব

আসলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ গণতান্ত্রিক নয়। সেই জন্য যখন নারী প্রতিবাদী হয়, পুরুষ এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজ অস্থির হয়ে ওঠে। তারা তখন যৌথ ভাবে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। তখন তারা বলে ওঠে ‘লেডিজ কামরাতে গিয়ে বসুন’ অকারণ হেসে উঠে নারীর অভিযোগকে হাওয়াতে উড়িয়ে দেয়। বলে যায়— বুদ্ধি কম, বিয়ে করেনি তাই খিটখিটে। নারী যদি উচ্চপদাধিকারিনী হন তাহলে পুরুষ অধস্তন কাজের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে চেষ্টা করবেন নির্দেশ অমান্য করতে। এর পর যদি নারীবাদিরা আন্দোলন করেন নিজেদের স্বাধীনতা বুঝে নেওয়ার জন্য তাহলে সমস্যা না হওয়ার কথা।

কিন্তু সমস্যা আছে। কারণ, এই ‘নারী’ বিষয়টি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নির্মাণ। যদি আমাদের সত্যি স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করতে হয়, তাহলে এই নারী পরিচয়টি ধরে রাখা সমীচীন হবে? নারীদের আন্দোলন মানে কোথাও আমরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নির্মাণকেই বারংবার অনুসরণ করে ফেলছি না তো? তাহলে কি আমরা শুধু মানুষ সেই পরিচয় ধরে এগোব? সেখানেও কিন্তু ভাবনার সম্ভাবনা এসে যাচ্ছে। কারণ, মানুষ কারা হবে সেটাও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ভাবনাকে আরও গভীরে নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে।

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content