শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

যতই নারী বাড়ি বসে বা চাকরি করে দৌড়ে, লাফিয়ে আচার, বড়ি, বসার আসন তৈরি করুন না কেন, পরিবারের সবাইকে খুশি করার জন্য, পুরুষকেই সমাজ স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। এই বলে স্বীকৃতি দেয় যে, পুরুষ সংস্কৃতি, আর নারী শুধুই প্রকৃতি। এখন আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন যে, এই সংস্কৃতি বিষয়টা কী? আর প্রকৃতি বলতেই বা কী বোঝানো হচ্ছে? এ কি গান গাওয়া বা নাচ করা মতো না কি? না, তা অবশ্যই নয়। না কি সমাজ নারীকে মানুষ বলে বুঝতে চায় না। যেমন কি না প্রকৃতিকে বুঝতে গিয়ে বিষয়টিকে এই ভাবে ভাবা হয় যে, পৃথিবী থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদকে এক জায়গায় জড় করে কীভাবে বেশি মুনাফা লুঠ করা যায়। আবার সমাজ মনে করে, মেয়েদের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় যোগাযোগ আছে চরিত্রগত কারণেই।
পৃথিবীতে সভ্যতা তৈরির কারিগর মনে করা হয় পুরুষকেই। পুরুষ নাকি বুদ্ধি দিয়ে শ্রমিকের কাজ করে দেয়, সে আসলে যোদ্ধা। পুরুষ সৃষ্টি করে। পুরুষ অনাবাদী জমিকে আবাদি জমিতে পরিণত করতে পারে। তাঁরা উন্নয়নের মূল কাণ্ডারি। তাই সমাজে পুরুষের গুরুত্ব অনন্য। মূলত পিতৃতান্ত্রিক সামাজে পুরুষ বিয়ের পরে গৃহত্যাগী হয় না। বরং সে আমাদের যৌথ পরিবার ব্যবস্থাকে মজবুত করে। খানদান বা নির্দিষ্ট পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখে। তাই পুরুষকে স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী মনে করা হয়। পুরুষ নাকি বাড়িঘর বানায়, কাঠামো নির্মাণকারি। আর নারী সেই সব পুরুষদের বাড়িতে বিয়ের পরে বাবার বাড়ি ছেড়ে, নতুন গোত্র গ্রহণ করে পুরনো আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে সারাজীবনের জন্য সেবা করে যান। তাঁর সেই সেবাদানের চুল-চেরা বিশ্লেষণ অবশ্য আমৃত্যু চলতে থাকে। কারণ নারীর কাজ লেপা পোছা করে সব ফাটল বন্ধ করা, সব কিছুর যত্ন নেওয়া, নিজে না খেয়ে বাড়ির সবাইকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২: গণমাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্য এবং রাজনীতি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩: টক খেওনা ধরবে গলা

এই অবধি পড়ে আপনার মনে হতে পারে আজকের বিষয়টি ঠিক কী? বৈষম্যের কোন দিকটি আমি তুলে ধরতে চাইছি? আমি আজ এই শীতের রাতে একটি বাড়ি আর তার মধ্যে একটি ঘরে নারীদের নিশ্চিন্ত মনে রাত কাটাতে পারার অধিকার নিয়ে বলতে চাই। শীতের দিনের কথা শুধু নয়, সারাজীবনের জন্য একটি মেয়েকে কী কী ভাবে আপোষ করে যেতে হয় একটি বাড়িতে থাকতে পারার অধিকারটুকু বজায় রাখার জন্য, সেটাও আমাদের জানা দরকার।

একটি মেয়ে বিয়ের আগে থেকে শুনে বড় হচ্ছে যে, তাকে বিয়ে করে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেই সঙ্গে শেখানো হতে থাকে, তাকে কী ভাবে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হবে। অর্থাৎ একজন নারীর জীবনে দুটি ভৌগলিক সীমানা, যাকে বলা যেতে পারে একটি চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ বা বাড়ি তাঁর পুরো জীবনকে নির্ধারণ করে দিচ্ছে। আর কোনও বিষয় সেখানে গুরুত্ব পাচ্ছে না। তিনি যে সবাইকে জুড়ে নিয়ে পৃথিবীতে মানুষ প্রজাতির টিকে থাকাকে বাস্তবায়িত করছেন সেই বিষয়ে কেউ ভাবে না। নারী একা সন্তানকে বড় করছে। একা হাতে দশ রকমের কাজ করছে সেটা খুব সাধারণ একটা ঘটনা—এটাই ভাবা হয়। ভাবা হয় বিয়ের পর সে নিজের ঘর খোঁজার চেষ্টায় পরিবারে ভাঙন ধরাবে। বিয়ের পর অন্য একটি বাড়িতে প্রবেশ করছে এমন একজন অপরিচিত মানুষ যাকে প্রতিনিয়ত সন্দেহ করা হয়। এই সন্দেহ বেশি বেড়ে যায়, যখন তিনি স্বামীর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই ঘনিষ্ঠ হতে চান। চারদেয়ালের মধ্যে নারীকে কতগুলি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে যেতে হয়। আর তা না হলেই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি আসতে থাকে তাঁর প্রতি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৮: খোকা নয়, খুকি নয়

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৩: নিয়মিত সাধন ভজন সাধককে ঈশ্বরের স্বরূপ চিনিয়ে দেয়

এই নির্দিষ্ট ভুমিকা পালন করতে গিয়ে নারীদের বসার ভঙ্গিমা থেকে সুরু করে কথা বলার ধরনও পরিবর্তিত হতে থাকে। শরীর-মন রক্তাক্ত হয়ে গেলেও মুখ ফুটে বলেন না তাঁরা কাউকে।

বাড়ি বলতে সমাজ ধরে নিচ্ছে এটি একটি কংক্রিটের কাঠামো মাত্র। সেই কাঠামোকে ধরে রাখতে হলে কতগুলো নিয়ম থাকা দরকার। বাড়ি থাকা মানেই নিয়মের বেড়াজাল থাকা। আর বাবা-মায়েরা মনে করেন এই নিয়মের বেড়াজালে তাঁদের মেয়ে সুরক্ষিত থাকবে। সেই কারণে এখন বা এমনকি আগেও ছিল, মেয়ের বিয়ের সময় বাবা-মা পাত্রের বাড়ি আছে কিনা, পাকা বাড়ি কিনা এসব বিষয়ে বিশদে খোঁজ করেন। তখন পাত্রপক্ষ খুব বেশি অন্য মত প্রকাশ করতে পারে না। তবে কাঠামো না থাকলে নিয়মের বেড়াজাল পরানো কঠিন। কিন্তু সবক্ষেত্রে নারীর প্রতি যে দরদ থাকে তা কিন্তু নয়। পাত্রপক্ষ হয় টাকা দাবি করে বাড়ি সারানোর নাম করে, নয়তো সরাসরি জানিয়ে দেয় এই ভাঙা বাড়িতেই মেয়েকে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হবে। সেখানে বাথরুম ভাঙা হলেও চলবে। কারণ মেয়েটিকে কোনও ভাবেই নিয়মের শিথিলতা দিলে হবে না। মেয়েটির বাবা-মা যদি সম্পদশালী না হন, তাহলে সেই মেয়েটিকে শ্বশুরবাড়িতে তাঁকে রান্নাঘরের বাইরে আলাদা স্থান দেওয়া হবে না।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-গন্ধে: মুরগির ঝোল কিংবা ঝাল নয়, এবার বানিয়ে ফেলুন দই মুরগি

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২: এই প্রথম বার মনে হল জীবন কঠিন হতে চলেছে, তাই মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম

এ রকম বক্তব্যও শোনা যায়, ‘মেয়েটি কোন লাট সাহেবের মেয়ে যে তার জন্য লোন নিয়ে ঘর সারিয়ে দিতে হবে’। আবার যেখানে সাংসারিক কারণে বাড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে সেখানে রান্নাঘরের জন্য চার হাত জায়গা মনে হয়েছে তাঁর জন্য যথেষ্ট। আবার সিঁড়ির একটি কোনও দেখিয়ে বলা হয়েছে, এখানেই রান্না করে নিতে। অর্থাৎ নারীকে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখার কৌশলগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, যে করেই হোক শরীরকে ভেঙেচুরে দাও। কোন এক অদৃশ্য দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখো যাতে নারী কখনওই নিজের অধিকার বা বলা যায় ভালো করে হাত-পা ছড়িয়ে নিজের মতো করে থাকতে না পারে।

প্রতি বছর প্রতিমা নিরঞ্জনের পর জলে মাটি ধুয়ে গেলে কাঠামোগুলো তুলে আনা হয় আবার প্রতিমা গড়া হবে ভেবে। আর আমরা সমাজে দেখি একটি নারী প্রতিবাদ করলে, কিছু বললে সরিয়ে দিয়ে, ফেলে, ঠেলে, বিভিন্ন ভাবে নিগৃহীত করে অন্য প্রতিমার খোঁজে চলে যাওয়ার কথা বলে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো। নারীকে সবসময় অস্থির, ভয়ার্ত করে রাখতে চাওয়া হয় আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়। আর সেখানে বাড়ি হয়ে যায় জেলখানার মতো।
আরও পড়ুন:

ফিজিওথেরাপি: কেউ ঠান্ডায় জব্দ, কেউ গরমে, কোন ব্যথায় কোন ধরনের সেঁক কাজে লাগে?

ছোটদের যত্নে: সুস্থ ও পরিপুষ্ট সন্তানের জন্য এগুলি মেনে চলছেন তো? সন্তানসম্ভবাদের জরুরি পরামর্শে শিশু বিশেষজ্ঞ

একটি ভৌগলিক সীমানার মধ্যে বন্দি জীবন কাটানো নয়, নিজের অধিকার বলে জীবন কাটানোটাই নারীর জীবনের একটি মৌলিক বিষয় হওয়া দরকার। সে গ্রামেই হোক বা শহর, সে উচ্চ জাতের হোক বা নিচু জাতের নারী হোক পরিস্থিতি একই। নারী কেনই বা শুধু ঘেরাটোপে জীবন কাটাবে? শুধু কী তাঁদের নিরাপত্তার প্রশ্ন? এই নিরাপত্তার বিষয়টিও কিন্তু সমাজেরই নির্মাণ।

নারীকে বার বার আক্রমণ করে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যে, সে দুর্বল এবং সে জন্মগত ভাবে দুর্বল। তাই সে পুরুষের সাহায্য ছাড়া কোনও ভাবেই নিজের সতীত্ব রক্ষা করতে পারবে না। কোনও কারণে সমাজে নারীকে নিজস্ব কোনও ঘর দেওয়া হয় না। তাদেরকে সমাজ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে দিতে চায় না সহজে। এখনও বহু নারী রান্নাঘরেই সময় কাটিয়ে দিয়ে থাকেন। ভেবে নেন এই রান্নাঘরেই তার জগৎ।

সমাজের আনাচে কানাচে ‘লেডিস ওনলি’ ঘেরাটোপ দিয়ে কিছু ভৌগলিক স্থান বানিয়ে নারীদের বোকা বানানোর প্রচেষ্টা চলে আসছে। ট্রেন, বাস সবেতেই একটি করে জায়গা নির্দিষ্ট করে বলা হচ্ছে নারীরা কেন চারদেওয়ালে মধ্যে আটকে থাকবেন। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কী? এই ‘লেডিস ওনলি’ ঘেরাটোপ আসলে আপনাকে সবসময় মনে করিয়ে দিচ্ছে আপনাকে সমাজের নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হবে। ট্রেনের মধ্যে দুটি কামরাতেই আপনাকে কষ্ট করে যেতে হবে। অথচ পুরুষকে কখনই বলা হবে না, আপনি সঠিক আচরণ করুন। উলটে তাঁরাই আপনাকে ‘জেনেরাল কামরা’তে দেখে বলবে, আপনাদের জন্য তো কামরা রয়েছে, তা সত্ত্বেও এখানে এত ভিড় করেছেন কেন?

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content