সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘হামির’ বা ‘আনন্দে রহো’ নাটক দুটির অভিনয় দর্শকদের হৃদয় তেমন করে আকর্ষণ করতে পারেনি। সেই দেখে ধর্মপ্রাণ বাঙ্গালীদের প্রিয় সামগ্রী, পৌরাণিক চিত্র অঙ্কনে গিরিশচন্দ্র মনোযোগী হলেন এবং সেই সূত্রে তিনি রাবণ বধ নাটক লিখলেন। রাবণ বধ প্রথম অভিনীত হল ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৮৮১ সালের ৩০ জুলাই। বিভিন্ন চরিত্র এখানে অভিনয় করলেন রামের চরিত্রে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, লক্ষণের চরিত্রে মহেন্দ্রলাল বসু, ব্রহ্মার চরিত্রে নীলমাধব চক্রবর্তী, ইন্দ্রের চরিত্রে অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, হনুমানের চরিত্রে রঘুনাথ পাঠক, রাবণের চরিত্রে অমৃতলাল মিত্র, বিভীষণের চরিত্রে অমৃতলাল বসু, নিকষার চরিত্রে ক্ষেত্রমনি, সীতার ভূমিকায় বিনোদিনী, মন্দোদরীর চরিত্রে কাদম্বিনী।
নাটকের প্রত্যেকের ভূমিকা যেমন সুন্দর অভিনীত হয়েছিল, অভিনয় দর্শনের দর্শক হৃদয়ও ঠিক তেমনি রসাপ্লুত হয়ে উঠেছিল এটা বলাই বাহুল্য। এ পর্যন্ত গিরিশচন্দ্র সাধারণের কাছে একজন উৎকৃষ্ট অভিনেতা ও আচার্য বলেই পরিচিত ছিলেন। রাবণ বধ রচনার পর তিনি সাধারণের কাছে সুনিপুণ নাট্যকার বলে অভিনন্দিত হন। অমৃতলাল বসু মশাই বলছেন, “রাবণ বধ নাটক যেদিন প্রথম অভিনীত হয় আমাদের বড়ই ভাবনা হইয়াছিল—পৌরাণিক নাটক চলিবে কিনা? তবে দর্শক মন্ডলী ভক্তিবিহ্বল কণ্ঠে যেরূপ সমবেত উল্লাসধ্বনি করিয়া উঠিলেন তখন আমাদের মনে হইল এই নাটক চলিবে, ভক্তিপ্রধান বাঙালি তাহার জন্মগত সংস্কার ভুলে নাই—ধর্মপ্রাণ জাতির মর্মস্থান এ নাটক ঠিক স্পর্শ করিয়াছে।”
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-২৬: নসীরাম ও সোনা — দুটি চরিত্রই গিরিশচন্দ্রের অপূর্ব সৃষ্টি

‘রাবণ বধ’ নাটকে গিরিশচন্দ্র ভাঙ্গা অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রথম প্রবর্তন করেন। মধুসূদন তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রথম প্রবর্তন করেন। গিরিশচন্দ্রের মনে হয়েছে যে, এই চতুর্দশ অক্ষরে আবদ্ধ থেকে অনেক সময় ছন্দের স্বচ্ছন্দ গতি ব্যাহত হয়। মেঘনাদবধ অভিনয় ও তার শিক্ষাদানকালে গিরিশচন্দ্র এটা ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। চতুর্দশ অক্ষরের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করতে পারলে ছন্দ আরও স্বাধীনতা প্রাপ্ত ও সুমধুর হয় এবং তা অধিকাংশ অল্প শিক্ষিত শিল্পীদের আয়ত্তাধীন করবার পক্ষেও বিশেষ সুবিধা হয়, গিরিশচন্দ্রের এই ধারণা জন্মায়। সেই সূত্র ধরেই তিনি যে ছন্দ প্রবর্তন করলেন তার নাম গৈরিশ ছন্দ। ১৯০৬ সালের ২৩ এপ্রিল গিরিশচন্দ্র মহাকবি নবীনচন্দ্র সেনকে রেঙ্গুনে যে পত্র লেখেন তার মধ্যে গৈরিশ ছন্দ কেন তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন তার একটা দারুণ কৈফিয়ত দিয়েছিলেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক অক্ষয় চন্দ্র সরকার তাঁর সাধারণী পত্রিকায় গিরিশচন্দ্র প্রবর্তিত এই ভাঙ্গা ছন্দের উল্লেখ করে লিখেছেন, “এতদিনে নাটকের ভাষা সৃজিত হইয়াছে।”
আরও পড়ুন:

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৭: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ও মিত্র বাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগ

সীতা দেবীকে যখন শ্রীরামচন্দ্রের সামনে নিয়ে আসা হয় অশোক কাননে, তখন সীতা দেবীর সংলাপ অংশে লোকেরা চোখের জল রাখতে পারেননি। সেখানে সীতা তাঁর স্বামীকে বলছেন—
“কোন দোষে অপরাধী শ্রীচরণে?
কহ অধীনীরে কেন ত্যজ গুণনিধি?”

রাবণ বধ নাটকে বর্ণিত শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গোৎসবের কথা মূল বাল্মীকির রামায়নে নেই। এটা রয়েছে কৃত্তিবাসের রামায়ণে। গিরিশচন্দ্রের বাল্য ইতিহাস থেকে আমরা জেনেছি শৈশবকাল থেকেই কৃত্তিবাসের রামায়ণ এবং কাশীরাম দাসের মহাভারত তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। বাল্যকাল থেকেই এই দুই কবির কাব্য ভাষা তাঁর হৃদয়ে এতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল যে তিনি আজীবন কৃত্তিবাস ও কাশীরাম দাসের একান্ত অনুরাগী ছিলেন।
আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১: চায়ের দোকান থেকে বিশ্বজয়

গুণগ্রাহী মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর গিরিশচন্দ্রের নাট্য প্রতিভার বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন। যাঁদের চেষ্টায় ও উৎসাহে বাংলায় প্রথম থিয়েটারের সূত্রপাত হয়েছিল মহারাজার নাম তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের জন্য গিরিশচন্দ্র ‘রাবণ বধ’ নাটকটি সেই যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন। সেখানে তিনি লেখেন—

“পরম পূজনীয় শ্রীযুক্ত মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর বাহাদুর শ্রীচরণেষু।
দেব!
ক্ষুদ্র যজ্ঞের ফলাফলও যজ্ঞেশ্বর হরিতে অর্পিত হয়। এই দৃশ্যকাব্যখানি জনপালক রাজ—করে অর্পণ করিলাম। মহাত্মন! নিজগুনে গ্রহণ করিবেন, কমল ক্ষুদ্র হইলেও ভানু— করেই বিকাশ পায়।

ইতি
সেবক শ্রীগিরিশচন্দ্র ঘোষ।”
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content