শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


আবার সুচিত্রা সেন।
আগেই বলেছি আমরা যারা সর্বকালের সেরা জুটি নিয়ে দশকের পর দশক ধরে আহ্লাদিত হয়েছি এবং হব তার গোড়াপত্তন হয়েছিল ওই বছর অর্থাৎ ১৯৫৪ সালে।

পাশাপাশি একঘেয়েমি থেকে মুক্ত রেখেছিল উত্তম-সাবিত্রীর বৈচিত্র্যময় ছায়াছবিগুলো। উত্তম-সুচিত্রার পর্দার রসায়ন, যে ফর্মুলাতে বাজিমাত করেছে তার বাঁধুনিটা অনেকটা চেনা ছকে। সুচিত্রা সেন-র সিগনেচার ছবিগুলো কিন্তু উত্তম কুমার নামক হেভিওয়েটকে বাদ দিয়ে। কথাটা বদহজমের হলেও সত্য । সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, পঞ্চাশের দশকে পরের পর বছরগুলোতে শুধুই যদি ‘সুচিত্রা-উত্তম’-থেরাপি চলত, মানুষ একটা সময়ে মুখ ফিরিয়ে নিত। মাঝে মাঝে অন্য নায়িকাদের সঙ্গে ভিন্ন স্বাদের ছবি ছিল বলেই সুচিত্রা সেন-র সঙ্গে ছবিগুলোর কদর এত বেড়েছিল।
অন্যদিকে, ব্যক্তি উত্তমের পঞ্চাশ শতাংশ কেরানির জীবন, পঞ্চাশ শতাংশ ফিল্মের হিরো হওয়ার দিন শেষ হয়েছে। যে স্টার থিয়েটারের ‘শ্যামলী’ নাটকের দৌলতে উত্তমবিমুখ দর্শকদের হলমুখী করা গিয়েছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতাও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। দিন-রাত্রির শিফটে ইনডোর আউটডোর শুটিং-র ধকল সেরে আবার সন্ধেবেলা স্টারে হাজির, উত্তমের পক্ষে দুর্বিষহ হয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু করারও কিছুই ছিল না। পাবলিক জিনিসটাই বড় গোলমেলে। যদি তুমি নিজেকে সফল প্রমাণ করতে পার, তাহলে তার পরদিন থেকে তুমি পয়সার বিনিময়ে ব্যবহৃত হতে থাকবে। যতদিন না তোমার শেষ রক্তবিন্দু দেখা যাচ্ছে। খ্যাতির বিড়ম্বনাটাই এরকম।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের জীবনটাও এ ভাবে খরচ হয়ে গিয়েছে। তাঁর ক্ষণজন্মা প্রতিভার চূড়ান্ত নির্গমন আমরা কতটা পেলাম! বিশেষত নোবেলজয়ী হওয়ার পর। বিশ্বভারতীকে গড়তে গিয়ে তাঁর সারস্বতচর্চা, নিম্নমুখী হয়েছে। তার ওপর ছিল সভা-সমিতি, স্বদেশী আন্দোলন, বিভিন্ন পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানে পৌরহিত্যে করার দায়। সব মিলিয়ে শেষের কুড়ি বছর রবীন্দ্রনাথের নিজেকে খরচ করার ফিরিস্তি।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৭: মনের মাধুরী মিশায়ে রচেছি তোমারে ‘কল্যাণী’

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১: চায়ের দোকান থেকে বিশ্বজয়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৬: ছোটদের, একান্তই ছোটদের ‘ভাই-বোন সমিতি’

এ হেন পরিস্থিতির বীজবপনটা ওই সময়েই কিন্তু উত্তমের জীবনে হয়ে গিয়েছে। তাঁর হাজার রকমের ব্যস্ততা, সংসার জীবন থেকে একেবারে কক্ষচ্যূত করে দিয়েছিল।
একমাত্র ছেলে গৌতমকে শৈশবকে সঙ্গ দিতে না পারার বেদনা, যেমন উত্তমকে কুরে কুরে খেত, অন্যদিকে ছেলেকে কেন্দ্র করে মায়ের ইচ্ছাপূরণে ঘাটতি হলেই গৌরীর অবুঝপনা শুরু হতো।

সাবিত্রীর সঙ্গে উত্তমের মানসিক নৈকট্য, সমস্ত ক্লান্তির যেন একঘটি শান্তিজলের মতো ছিল। দিনে একবার মঞ্চে একান্ত করে কাছে পাওয়া উত্তমকে অনেকটা রিলিফ দিত। তা বলে সংসারের প্রতি কর্তব্যে কোনও গাফিলতিই উত্তম দেখাননি।
যাইহোক, উত্তম কেরিয়ারের শুরুতে যেমন নীতিন বসুকে পরিচালক হিসাবে পেয়েছিলেন, সুচিত্রাও তেমনি দেবকী বসুকে পেয়েছিলেন। ওঁর ছবির মনোনয়ন দেখেই সুচিত্রা এক লাফে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। পরিচালক সতীশ দাশগুপ্ত তাঁর অন্যধারার ছবি ‘মরণের পরে’-র জন্য। নির্বাচন করলেন উত্তম-সুচিত্রা-কে। ব্যাপারটা কিন্তু একদমই জুটি তৈরির জন্যা নয়। সাধারণ গড়পড়তা নিয়মেই দু’জনে সুযোগ পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৮: অবশেষে বৃদ্ধ চ্যবনমুনি শর্যাতিরাজার কন্যার পাণিপ্রার্থী হলেন

শীতকালে শ্বাসকষ্ট বাড়ে? হার্ট ও কিডনির যত্ন নেবেন কীভাবে? চনমনে থাকতে জেনে নিন ডাক্তারবাবুর জরুরি পরামর্শ

ছবি মুক্তি যখন পেল। পত্র-পত্রিকা ঝলসে উঠল উত্তম-সুচিত্রার দেওয়া-নেওয়ায়। আজ এত বছর পর ছবিটিতে যে কয়েকটি প্রসাদগুণ দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো হল, ক্যামেরাকে তাক লাগিয়ে দু’জনের সৃজন। পরস্পর যখন পরস্পরের দিকে দৃষ্টিবিনিময় করছেন তখন মনে হচ্ছে দু’জনে যেন দু’জনের কত চেনা। অথচ ছবির থিম ডিমান্ড করছে, সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট। যার কুশীলবদের প্রধান হলেন শম্ভু মিত্র। তবুও প্রণয়ের ঘটস্থাপনে দু’জনের উদ্যোগ ছিল দেখার মতো।
দ্বিতীয়ত, কাহিনির বুনন। জন্মান্তরের সম্পর্কের দোটানা একটা বিশেষ বিন্দুতে এসে মিলবে যেখানে নায়ক-নায়িককা তাদের ঈপ্সিত তৃপ্তি খুঁজে পাবে এ ধরনের ঘটনাকে চিত্ররূপ দেওয়া সাহসের পরিচয় বলতে হবে।
তৃতীয়ত, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছবির নির্মাণ কৌশল। এখন মুম্বই বা চেন্নাই যেখানে যত অপরাধ জগত নিয়ে মুভি নির্মিত হচ্ছে সবকিছুর অগ্রদূত হতে পারে এ ছবি। সহশিল্পীদের দিয়ে কালজয়ী পারফরম্যান্স (বিশেষত হরিধন মুখোপাধ্যায় ও তুলসী চক্রবর্তী ) উত্তম-সুচিত্রাজুটিকে চোখে চোখ রেখে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, যা এখন সাউথের মুভির মূল কৌশল। কোনও একজন হিরো নন। সবাই পারফরমার। সবাই হিরো।
সব কিছুর মিলিত ফলে ছবি ব্লক ব্লাস্টার। ওদিকে আবার ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র শুটিং সবে শুরু হয়েছে।—চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content