সাধারণত বাজারে কয়েক দিন আগের মৃত কোনও প্রাণীর মাংস বিক্রি করা হয় না। হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি দিনের দিন মেরে তার পরে মাংস হিসেবে বিক্রি করা হয়। মাছই সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম, যেখানে এই নিয়ম খাটে না। অর্থাৎ মরা মাছ বা তার কাটা অংশ বরাবরই বাজারে বিক্রি হয়। আমরাও নির্দ্বিধায় কিনেও থাকি। জ্যান্ত মাছ অবশ্য রোগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, আবার এমনিও খাওয়া হয়। সেক্ষেত্রেও যেটা জানা থাকলে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তা হল মাছটির বাইরের আকৃতি দেখে সেটি সুস্থ, সবল কিনা তা যদি জেনে নেওয়া যায়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ছকটি থেকে মাছ সম্পর্কে একটা ধারণা করা সম্ভব। জেনে রাখা ভালো, জল থেকে তোলার পরে মাছের পুষ্টিগুণ একটু করে হলেও কমতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। যেহেতু মাছ অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ, তাই এই পরিমাণ পুষ্টির কমতি, তেমন প্রভাব ফেলবে না। তবে মাছের বিভিন্ন অংশে পুষ্টিগুণের কিছুটা হলেও ফারাক থাকে।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৫: আমাদের পাতে মাছের বৈচিত্র্য থাকুক, আবার মৎস্যজীবিরাও রুই, কাতলার সঙ্গে এদের চাষের আওতায় আনুন
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৯: নদীর তীর, বনের পথ, শোক সামলে ছুটল রথ…
মাছে সবচেয়ে উচ্চমানের জৈবিক প্রোটিন যাতে সব অ্যামিনো অ্যাসিড (১০টি অত্যাবশ্য এবং চারটি একান্ত অত্যাবশ্যক), লাইসিন, মিথাওনিন, আরজিনিন, ট্রিপটোফ্যান প্রভৃতি নিশ্চিত ভাবে পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে মেলে অনুপুষ্টি বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টও। সঙ্গের ছবিতে যেটি দেখানোর চেষ্টা করেছি তা হল মাছের কোন কোন অঙ্গে কী কী পুষ্টিগুণের আধিক্য আছে। সুস্থ মাছে থাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ উচ্চ জৈবিক মানের প্রোটিন। অনুপুষ্টিতে ভরপুর থাকে লেজ। আর মুড়োতেই ভিটামিন-এ বেশি থাকে।
আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ম যা সবারই জানা—আমাদের বাজারগুলিতে তেমন পরিচ্ছন্ন পরিবেশ থাকে না। মাছ বিক্রেতারাও অনেক সময় সামনে রাখা পাত্রের জল বার বার ব্যবহার করে থাকেন। মাছ কাটার সময় এবং তার পরে ব্যবহৃত সেই জল যতক্ষণ না মাছ বিক্রি শেষ হচ্ছে ততক্ষণ ব্যবহার হতে থাকে। আর সে কারণেই নানা রকম সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই মাছ কিনে বাড়িতে আসার পরে আমাদের প্রথম কাজ হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘রানিং ওয়াটার’-এ তা ভালো করে ধুয়ে রাখা।
আরও পড়ুন:
ডায়াবিটিসে ভুগছেন? সকালের জলখাবারে কী ধরনের খাবার খেতে পারেন? রইল ডক্তারবাবুর জরুরি পরামর্শ
ডায়েট ফটাফট: নিয়ম করে খান আমন্ড? ভালো থাকবে হার্ট, এড়ানো যাবে রিঙ্কল! এর বহুমুখী পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানা আছে কি?
আরেকটি চিন্তার কারণ হল— মাছ লবণ, হলুদ ইত্যাদিতে মাখানোর পর অতিরিক্ত ভেজে ফেলার প্রবণতা অনেক বাড়িতেই দেখা যায়। এরকম ভাবে মাছ ভাজার কারণ হয়তো রসনাতৃপ্তির জন্যই। কিন্তু এটা জানা দরকার, এতে আমরা পুষ্টিগুণ হারিয়ে ফেলি। আর এই উচ্চ তাপমাত্রায় রান্নার জন্য ভোজ্য তেলে থাকা ‘সিস ফ্যাটি অ্যাসিড’, ট্রান্স ফ্যাট অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘদিন ট্রান্স ফ্যাট অ্যাসিড আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে তা থেকে নানা ধরনের প্রাণঘাতী শারীরিক সমস্যা দেখা যায়।
আরও পড়ুন:
ছোটদের যত্নে: শিশুর যত্নে কোন কোন দিকে বিশেষ নজর রাখবেন? জেনে নিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
সন্তান কথায় কথায় রেগে যাচ্ছে! এর পিছনে লুকিয়ে থাকা কোনও কারণ নেই তো?
তাই সতেজ মাছ, পরিষ্কার জলে ধুয়ে নেওয়া, হালকা আঁচে রান্না করে খেতে পারলে পুষ্টির যোগান হবে নিশ্চিত ভাবে। যে কোনও প্রাণীর মাংসের তুলনায় স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু হল সহজলভ্য মাছ। নিয়মিত মাছ খাওয়া যাঁদের অভ্যাসের মধ্যে রয়েছে, যেমন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশ এবং জাপানিদের মধ্যে দেখবেন তাঁরা অন্তত হৃদরোগে প্রায় আক্রান্ত হন না বললেই চলে। আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আমাদের রোজকার খাবারে খাদ্যগুণ বজায় রেখে এ ভাবে মাছের অন্তর্ভুক্তি করতে পারলে স্বাস্থ্য-সুন্দর কর তুলবে সবাইকে।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।