বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


সীতা অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন আজ—সমস্ত ভক্তি আর শক্তি একত্র করে দেবতাদের ডাকছেন, প্রার্থনা করছেন পিতৃপুরুষদের কাছে, নির্বিঘ্নে অভিষেকের কাজকর্ম সেরে যেন স্বামী ফিরে আসেন। উৎকণ্ঠায়, অজানা আবেগে মন বারবার ছুটে যাচ্ছে প্রাসাদের দুয়ারে। কি জানি, কখন এসে পড়বেন রাম! রাম এলেন, মুখ তাঁর নত, বিমর্ষ, মনের দুঃখের ভার মুখে ফেলেছে ছায়া। এমন মুখে কেন এলেন রাম? ভয়ে কেঁপে উঠলেন সীতা। “রঘুনন্দন, আজ কি পুষ্যা নক্ষত্রের সঙ্গে বার্হস্পত্য যোগ হল না? তত্ত্বজ্ঞানী পণ্ডিতেরা কি আজ অভিষেক হবে না বলে ফিরিয়ে দিলেন? তোমার মুখ এমন মলিন কেন? না কি অভিষেকের কর্মকাণ্ড বিধি নিয়ম মেনে সঠিক ভাবে হয় নি?” নানান প্রশ্ন উঠে এল সীতার মনে।
আর দেরি নয়। এবার যে বলতেই হবে বৈদেহীকে। রাজ্যাভিষেকের দিন রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে নির্বাসনে — এ রূঢ় সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে তাঁকে। গলার কাছে কষ্ট যেন জমাট হয়ে ওঠে রামের। সীতার প্রশ্নের উত্তরে ধীর, গম্ভীর গলায় রাম বলে ওঠেন, “মৈথিলী, শোনো। তুমি সত্যবাদিনী, ধর্মজ্ঞা। মন দিয়ে আমার কথাগুলো শোনো।” সীতাকে সব ঘটনা জানিয়ে রাম বললেন, “বনবাসে যাওয়ার সময় হয়ে এল। আজই যে যেতে হবে আমাকে। মৈথিলী, তুমি ধৈর্যে বুক বাঁধো। আমাকে বনে যাওয়ার সম্মতি দাও। আমি না আসা পর্যন্ত আমার বৃদ্ধ পিতা, শোকার্ত মাকে তুমি দেখে রেখো। ব্রত, নিয়মে সংযমে দিন কাটিও। আর একটা কথা স্মরণে রেখো, আমার প্রশংসা ভুল করেও কখনো ভরতের সামনে করো না। ঐশ্বর্যের অহংকারে মত্ত যারা, তাঁরা কখনও অন্যের প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। আমি চলে গেলে ভরতই তোমার ভরণপোষণ করবে। তাকে কখনো অপ্রিয় কথা বলো না।”
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৪: শোকবিহ্বল মা, ক্ষোভে উত্তাল ভাই — তবুও কি বনবাস?

দশভুজাঃ ‘ওগো তুমি যে আমার…’— আজও তাঁর জায়গা কেউ নিতে পারেনি/২

বাইরে দূরে, ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৭: রঙের খেলা আর উইসকনসিনের আঁকাবাঁকা ফাঁকা রাস্তা—জীবনীশক্তিকে আরও উসকে দেয়

সীতা শুনলেন সব বৃত্তান্ত। কৌশল্যার মতো ভেঙে পড়লেন না। জীবনে যে ঝড় আসতে চলেছে, তাকে শান্ত মনে গ্রহণের চেষ্টা করলেন। দুঃখকে আত্মস্থ করেই যে জীবনের পথ চলা তাঁর। এ ভাবেই তার সূচনা হল বুঝি। সীতা কিছুটা অভিমানের সুরে বললেন, “আর্যপুত্র, এসব কি বলছ! আমাকে কি তোমার এত তুচ্ছ মনে হয়? তুমি যেখানে যাবে, আমিও সেখানে যাবো। তোমাকে ছাড়া স্বর্গবাসের সুখেও আমার কোনও রুচি নেই। আর তোমার সঙ্গে বনে বাস করলেও আমি ইন্দ্রভবনের সুখ অনুভব করবো। আমি যে অনন্যমনে তোমারই। কাজেই আমিও তোমার সঙ্গে বনে যাবো। তোমার কাছে প্রণত হয়ে এ আমার প্রার্থনা। আমি নিশ্চিত যে, বনবাসে তোমার বোঝা হয়ে উঠব না আমি।”
আরও পড়ুন:

শরীরচর্চাঃ ৫ ব্যায়ামে থাইরয়েডের সমস্যার সহজ সমাধান

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুনঃ ডায়াবেটিস থাকবে দূরে, জেনে নিন কোন ফল কতটা পরিমাণে খাবেন, আর কোনটা খেতে হবে সাবধানে, দেখুন ভিডিয়ো

ইংলিশ টিংলিশ: আজকে শিখবো IMPERATIVE SENTENCE-এর VOICE CHANGE

রাম মনে মনে বোধ হয় প্রস্তুত ছিলেন না সীতার এ প্রস্তাবে। “বনবাসের কত দুঃখ, সেসব তুমি জানোনা মৈথিলী। বনবাসের জীবনে পদে পদে ভয়, বিপদ। খিদে, তেষ্টা মেটে না দিনের পর দিন। কখনও খুব শীত আবার কখনো প্রচণ্ড গ্রীষ্মতাপ। ভয়াবহ অরণ্যজীবনে তুমি একেবারে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে যাবে। আমি তোমাকে এত কষ্ট দিতে পারবো না। তুমি বিশ্বাস করো, আমি পিতার আদেশে শুধুমাত্র শরীরটাকে বয়ে নিয়ে বনে যাচ্ছি। আমার সমস্ত মন পড়ে থাকবে তোমার কাছে।”

এবার সীতার চোখে জল ভরে এল — “আর্যপুত্র, তুমি বনবাসের যেসব দোষ বললে এতক্ষণ, তুমি কাছে থাকলে সেসবই গুণ হয়ে উঠবে। তোমার মতো ক্ষত্রিয় বীরের বাহুবলে সব ভয় দূরে চলে যাবে। তোমার সঙ্গে বনে যাওয়া, এ তো আমার কাছে হৃদয়ের উৎসব। এ বড় কাঙ্ক্ষিত আমার। আর্যপুত্র, আমি হয় তোমার সঙ্গে বনে যাবো, না হলে প্রাণ ত্যাগ করবো।”
আরও পড়ুন:

খাই খাইঃ চিতল মাছের তো খেয়েছেন, এবার চিংড়ির মুইঠ্যার স্বাদ নিন, রইল সহজ রেসিপি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১২: সে এক ‘বউঠাকুরাণীর হাট’ [১০/০৭/১৯৫৩]

হেলদি ডায়েট: বিয়ে আর বেশি দেরি নেই? স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুল ও ঝলমলে ত্বকের জন্য এই সহজ উপায়গুলি মেনে চলছেন তো?

এত অনুনয়েও রামের মনে কোনও পরিবর্তন এল না। সীতার শোক, দুঃখ, অভিমান এবার ক্রোধে পরিণত হল। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল তীব্র তিরস্কারের ভাষা— “আমার পিতা মিথিলেশ্বর কি জানতেন যে তিনি একজন পুরুষের আকৃতিধারী ক্লিবের সঙ্গে আমার বিবাহ দিয়েছেন? লোকে বলে, রামের তেজস্বিতা সূর্যের মতো— এ তো না জেনে তারা মিথ্যা বলে। তুমি আমাকে এখানে রেখে চলে যাবে, আর ভরতের অনুগ্রহে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে, এমন জীবন আমার চাই না। কুমারী অবস্থায় আমাকে তুমি প্রিয় ভার্যারূপে গ্রহণ করেছিলে, আজ কীভাবে নটের মতো আমাকে অন্যের হাতে দিয়ে চলে যেতে চাইছ?

আর্যপুত্র, তোমার সঙ্গে বনে গেলে পথের যত রুক্ষ কাঁটা, সবই নরম কৌষেয় কাপড়ের মতো মনে হবে, বনের ফলমূল অমৃত মনে হবে। আমাকে ছেড়ে যেও না রাঘব। আমি তোমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারব না।” সীতার সমস্ত শোক, ক্ষোভ, ক্রোধ এবার অশ্রুধারায় ঝরে পড়তে লাগল। রামের পায়ের কাছে মাথা দিয়ে বিলাপ করতে লাগলেন সীতা।
আরও পড়ুন:

পর্ব-৪৪: বনের পথে গল্প রাশি রাশি— যাত্রাপথ যত এগোয় তত অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে ওঠে পাণ্ডবদের

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪১: ঠাকুরবাড়িতে এসে সাহেব খেতেন ভাজা চিঁড়ের সঙ্গে কড়াইশুঁটি

ঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৩: খালেবিলে, ধানখেতে, পুকুরে, নদীতে ঘুরে বেড়ানো ‘ম্যাজিশিয়ান’ জেব্রা ফিশ ভবিষ্যতে রোগ নিরাময়ে নতুন দিশা দেখাবে

রামের বিক্ষত হৃদয় আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। দু’ চোখ বেয়ে নেমে এল জলের ধারা। প্রিয়া সীতার দুঃখ শেল হয়ে বিঁধছে তাঁরও হৃদয়ে। ধীরে ধীরে মধুর কণ্ঠে সীতাকে বললেন, আমি তোমাকে ছেড়ে স্বর্গবাসও কামনা করি না। আর পতিব্রতা পত্নীকে ছেড়ে চলে যাওয়া যে অধর্ম। আবার পিতার আদেশ অমান্য করাও ধর্মবিরুদ্ধ। আমি তোমার মন দেখছিলাম সীতা। তুমি কি চাও, সেও তো আমার জানা প্রয়োজন। আমিও তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। তুমি হলে আমার জীবনে যশস্বী ব্যক্তির যশের মতো, আমি কীভাবে ছেড়ে যাবো তোমাকে? মৈথিলী, চল আমার সঙ্গে— এহি গচ্ছ ময়া সার্দ্ধং যথা তে রুচিতং প্রিয়ে।”

রামের কথায় ভালোবাসা যেন উছলে উঠছে। আজ এমন দুঃখের দিনেও সীতার দুচোখে এবার আনন্দে জল এল।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content