সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


দে'জের কর্ণধার সুধাংশু শেখর দে-র সঙ্গে।

সুধাংশু শেখর দে। আইকনিক পাবলিশার অফ বেঙ্গল। দে’জ পাবলিশিং-এর কর্ণধার সুধাংশুবাবুর সাফল্যের মুকুটে আরেকটি নতুন পালক সংযোজিত হল সম্প্রতি। একটি বেসরকারি সংস্থা, ওঁর ৫০ বছর ব্যাপি প্রকাশনা জগতে উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য এই স্বীকৃতি দিল। এই সম্মান শুধু তাঁকে যে সম্মানিত করল তা নয়, সম্মানিত হল এই রাজ্যের প্রকাশনা সংস্থাগুলোও। এই মানুষটিকে আমি চিনি দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে। এই সংস্থার বয়স এখন ৫০। শুরুর ১৭ বছর বাদ দিলে বাকি বছরগুলো অর্থাৎ তিন ভাগের দু’ ভাগ সময় জুড়েই দে’জের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। শুরুতে এবং তার কয়েক বছর পর পর্যন্ত যা ছিল নিতান্ত লেখক-প্রকাশকের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক, তা এখন পারিবারিক সম্পর্ক শুধু নয়, আত্মিক সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে যখন সুধাংশুদার মুখোমুখি হয়েছিলাম, তখন দু’জনেরই ছিল যৌবন, বয়সের নিয়ম মেনে আমরা দু’জনেই এখন সিনিয়র সিটিজেন। বৃদ্ধ কথাটিতে আমার আপত্তি আছে, আপত্তি আছে জানি সুধাংশুদারও। কারণ, পেশার জগতে এবং ভালোবাসার জগতে আমরা দু’জন এখনও অক্লান্তভাবে ছুটে চলেছি। কী এমন কর্ম যাদু আছে এই মানুষটির মধ্যে, যে জন্য তাঁর পিতার তৈরি এই প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি এই অর্ধশতাব্দী ধরে লালন করে এমন একটি সুউচ্চ গরিমায় তুলে নিয়ে যেতে পারলেন!
একটু পিছন ফিরে তাকানো যাক। ১৯৮৭। আমি তখন সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এসে নিয়মিতভাবে লেখালেখি শুরু করেছি। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে আমার কভার স্টোরি। এরপর সানন্দা আনন্দলোক, আনন্দমেলা হয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রতি শনিবার নিয়মিত কলাম লিখছি, গৃহিণীরা শুনছেন। বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর সেগুলো নিয়ে একটি বই বার করা যায় কিনা, সে ব্যাপারে সঞ্জীবদার পরামর্শ চাইলাম। উনি একটি দু’লাইনের চিঠি লিখে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন দে’জ পাবলিশিং-এর কর্ণধার সুধাংশু শেখর দে-র কাছে। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরের কোনও একদিন আমি প্রথমবারের জন্য মুখোমুখি হয়েছিলাম সুধাংশুদার। ১৩, নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে দে’জের যে সুবিশাল কাউন্টার রয়েছে, তার ভিতর দিকে তখন বসতেন উনি। ফাইল আর বইপত্রে ঠাসা বিশাল এক টেবিল, তার এক প্রান্তে উনি, উল্টোদিকে তিন-চারটি চেয়ার, দর্শনার্থীদের বসার জন্য। আমার ফাইলটি হাতে নিয়ে উল্টাপাল্টে দেখার পর ওঁর সঙ্গে আধ ঘণ্টার আলাপচারিতায় উনি সেদিন অনেক কথাই বলেছিলেন। তার মধ্যে একটি কথা আমার আজও মনে আছে। সেটি হল, ‘সঞ্জীবদা যখন পাঠিয়েছেন তখন আপনার প্রথম বইটি আমরা নিশ্চয়ই প্রকাশ করবো, কিন্তু পরবর্তী কোনও বই প্রকাশের আগে পাঠকের কাছে আপনার গ্রহণযোগ্যতা আপনাকেই প্রমাণ করতে হবে।’ দেখতে দেখতে ৩৩ বছর কেটে গেল। হয়তো সেই গ্রহণযোগ্যতার কিছুটা প্রমাণ করতে পেরেছি বলেই আজ দে’জ-এর ৫০ তম বর্ষে আমারও ৫০তম বইটি এখান থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে।

দে'জ পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবার।

এই সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষে কত কথাই তো মনে পড়ে। দে’জ থেকে হাঁটা পথের দূরত্বে, শিয়ালদার শ্রদ্ধানন্দ পার্কের উল্টোদিকের একটি চেম্বারে আমি সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার এবং শুক্রবার প্র্যাকটিস করতাম। দীর্ঘ ৩০ বছর বসেছি ওই চেম্বারে। চেম্বার শেষ করে রাত ন’টা নাগাদ গিয়ে হাজির হতাম দে’জের ঘরে। তখন কাউন্টার ফাঁকা। বড় রাস্তা থেকে বাড়িতে ঢোকার সিংহ দরজা ভেজানো থাকত। দরজা ঠেলে কাউন্টারে গিয়ে আমার বন্ধু সুধাংশুদার ভাই সুভাষচন্দ্র দে, যাঁকে কলেজ স্ট্রিট পাড়া বাবু নামে চেনে, তাঁর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়তাম। চা আস তো, কখনও মুড়ি বাদাম। খেতে খেতে আড্ডা হতো। প্রায় দিনই দেখা হতো সুধাংশুদার সঙ্গে, বাইরের কাজকর্ম সেরে উনি হয়তো একটু আগেই ফিরেছেন, ফিরেই অফিসের কাজ নিয়ে বসে গিয়েছেন। আমি আমার প্রয়োজনীয় কাজকর্মের কথা তাঁকে নিবেদন করতাম। দে’জের কর্মচারীদের অসুখ- বিসুখের কথাও শুনতে হতো আমাকে, ওষুধ-পত্র লিখে দিতাম। তারপর আমার পছন্দমতো দু-একটি বই বগলদাবা করে দে’জ ছেড়ে যখন বের হতাম, তখন ঘড়িতে প্রায় রাত দশটা।

দে'জের নতুন কান্ডারি অপু (শুভঙ্কর দে)-র সঙ্গে।

দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত আমার প্রথম বই ‘শরীর স্বাস্থ্য জিজ্ঞাসা’। পরের বই ‘রোগটা যখন ক্যানসার’। এই বইয়ের একটি উদ্বোধন অনুষ্ঠান আমি করি সেই সময়ের ময়দানের বইমেলার ইউবিআই অডিটরিয়ামে। তারপর থেকে টানা ১৯ বছর বইমেলায় আমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠান হতো বহু জ্ঞানীগুণী মানুষের উপস্থিতিতে এবং এই ব্যাপারে প্রত্যক্ষ মদত ও সহযোগিতা থাকত সুধাংশুদার। আমার আবদারে উনি উদ্বোধন অনুষ্ঠানের একটি বিজ্ঞাপনও করে দিতেন প্রথম সারির দু-একটি দৈনিক পত্রিকায়। অনুষ্ঠানটি তখন সরাসরি দে’জ-এর ব্যানারে হতো না, হতো অভিনয় পত্রিকার ব্যানারে। নিবেদনে থাকতেন প্রখ্যাত নাট্যকার অমল রায়। কয়েক বছর পর থেকে অবশ্য দে’জ-এর নামেই অনুষ্ঠানটি হতো। সুধাংশুদার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পর থেকেই বুঝে গিয়েছিলাম, উনি গিল্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তি। এই মেলাকে সফল করার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করতেন, এখনও করেন। তবে এখন দে’জের নয়া ব্রিগেড তাঁর পাশে থাকায়, কাজটা অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছে। তখন সুধাংশুদার পরিচিতি ছিল ‘মাঠ বাবু’ হিসেবে। মেলার শুরু থেকে শেষ অবধি যে কোনও সমস্যায় মুশকিল-আসান ছিলেন উনি। শুধু পরিশ্রমী নন, অসম্ভব ধৈর্যশীল এবং ঠান্ডা মাথার মানুষ এই ভদ্রলোক। আমার অনেক আবদার উনি রেখেছেন, এখনও রাখেন। এই ঘর থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হায় চিরজল’ প্রকাশ করার ব্যাপারে প্রধান উদ্যোগী ছিলাম আমি। এবং এই ব্যাপারে উনি আমাকে সব রকম স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এমনকি ওঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে আমি ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে প্রথম আলাপ করিয়েও দিয়েছিলাম। আমার অনুরোধে বেশ কয়েকজন গুণী লেখকের বইও উনি সানন্দে প্রকাশ করেছিলেন এবং এই বইগুলোর প্রকাশ পর্বের দেখভাল করার পুরো দায়িত্বটাই আমি স্বেচ্ছায় ওঁর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। উনি সানন্দে এবং নিশ্চিন্তে আমার উপর সেই দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৪৪: বাংলা সিনেমার দুই বর্ষীয়ান অভিনেতা: রঞ্জিত মল্লিক এবং দীপঙ্কর দে

ছোটদের যত্নে: শিশুকে টনসিলের সমস্যা থেকে দূরে রাখতে চান? মেনে চলুন শিশু বিশেষজ্ঞের এই সব টিপস

শারদীয়ার গল্প-৬: পর্‌সতার

দে’জ পাবলিশিংকে এই মানুষটি কোনওদিনই কর্পোরেট হাউস বানাতে চাননি। লেখক ক্রেতা পাঠক প্রকাশক, সবার জন্য অবারিত দ্বার এই হাউসের। এ যেন এক বৃহত্তর যৌথ পরিবারের মিলনমেলার ক্ষেত্র। এখানকার যাঁরা স্টাফ, তাঁদের সঙ্গে সুধাংশুবাবুর সম্পর্ক মালিক-শ্রমিকের নয়, পরিবারের সদস্যদের মতো। তাঁদের বিপদে-আপদের সবসময় উনি পাশে থাকেন। শুধু দাদার কথাই বা বলব কেন, বৌদিও কম যান কিসে! সরাসরি এই প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে তিনি কোনওদিনই যুক্ত ছিলেন না, আজও নেই। কিন্তু দে’জ পরিবারের কারও কোনও সমস্যা হলে তিনি সরাসরি আমাকে ফোন করে পরামর্শ চাইতেন কিংবা আমার চেম্বারে তাঁকে পাঠাতেন। দে’জের আজকে এই যে গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা, তার পিছনে কিন্তু সুধাংশুদার দুই দাদারও অবদান আছে। আর আছে তাঁর লক্ষণসম সহোদর সুভাষচন্দ্র দে ওরফে বাবুর। অত্যন্ত লো প্রোফাইল, প্রচার বিমুখ, সদা হাস্যময় এই মানুষটি দে’জের কাউন্টার ঘণ্টার পর ঘণ্টা সামলান। বহু দিন ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়াও করতে পারেন না। প্রকাশনা জগতের কোনও মালিকপক্ষকে এ ভাবে দিনের পর দিন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করতে আমি দেখিনি। শুধু বই বিক্রি নয়, এঁদের ঘরে যে হাজার হাজার বিভিন্ন ধরনের বই রয়েছে, তার সুলুক সন্ধান এক নিমিষেই পাওয়া যায় এই মানুষটিকে প্রশ্ন করলেই। কোন বই কোন তাকে রয়েছে, কোন বই আউট অফ প্রিন্ট, সব এক নিমেষে বলে দিতে পারেন আমাদের বাবু।
আরও পড়ুন:

‘ওগো তুমি যে আমার…’— আজও তাঁর জায়গা কেউ নিতে পারেনি/২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১২: সে এক ‘বউঠাকুরাণীর হাট’ [১০/০৭/১৯৫৩]

ইংলিশ টিংলিশ: সবাই যদি বলে ‘very beautiful’, তুমি বলে দ্যাখো ‘ravishing’ বা ‘magnificent’!

বটবৃক্ষের মতো দে’জ পরিবারকে যিনি আগলে রাখেন, সেই সুধাংশুদা কিন্তু অসুখ-বিসুখের ব্যাপারে ভীষণ ভীতু মানুষ। একাধিকবার অপারেশন হয়েছে ওঁর। একবার তো মুখের ভিতর ক্যানসার সাসপেক্ট করে বায়োপসি করা হল আমারই তত্ত্বাবধানে, আমার বন্ধু প্রখ্যাত ক্যানসার সার্জেন ডাঃ প্রবীর বিজয় করকে দিয়ে। আমার পরিষ্কার মনে আছে, সমস্ত ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর উনি একদিন আমার শিয়ালদার চেম্বারে আমি যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে থেকেই গিয়ে বসেছিলেন। ভয়ে রিপোর্টগুলো পর্যন্ত খুলে পড়েননি। মানুষটার মধ্যে অদ্ভুত ছেলেমানুষীও আছে। ভালো পোশাক পরে ওঁর কোনও ছবি উঠলে, উনি আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পোস্ট করেন। ভিআইপি মানুষ উনি, নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকেন, সেসবের সচিত্র পোস্টও উনি আমাকে নিয়মিত করেন। মুঠোফোনের দৌলতে আমাদের যোগাযোগটা নিয়মিত। ৭-১০ দিন কথা না হলে, উনি নিজেই আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, ‘কি ডাক্তারবাবু একদম চুপচাপ কেন, আমাদেরকে ভুলে গেলেন নাকি!’ আর অসুখ-বিসুখের ব্যাপারে বলি, উনি বা ওঁর পরিবারের কেউ যে ডাক্তারকেই দেখান না কেন, একবার আমাকে সেসব না জানালে মানসিক শান্তি পান না। আসলে মানুষটি আমাকে বড় বিশ্বাস করেন, ভালোওবাসেন, অযাচিতভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে ভীষণ রকম গুরুত্বও দেন, যা মাঝে মাঝে আমার কাছে বিড়ম্বনার কারণ হয়ে ওঠে। ভাবি, সত্যিই কি এত সম্মানের যোগ্য আমি!

১৬ বছর আগে বইমেলায় আমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠান।

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪১: ঠাকুরবাড়িতে এসে সাহেব খেতেন ভাজা চিঁড়ের সঙ্গে কড়াইশুঁটি

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৩: খালেবিলে, ধানখেতে, পুকুরে, নদীতে ঘুরে বেড়ানো ‘ম্যাজিশিয়ান’ জেব্রা ফিশ ভবিষ্যতে রোগ নিরাময়ে নতুন দিশা দেখাবে

খাই খাই: বাড়িতে বসবে আড্ডার আসর? বানিয়ে ফেলুন ভিন্ন স্বাদের গন্ধরাজ মোমো

এবার বলি দে’জের নয়া ব্রিগেডের কথা। যাদের নিত্যনতুন উদ্ভাবনী শক্তির উপর ভর করে এই রাজ্যের বহু জায়গায় শাখা বিস্তার করতে পেরেছে দে’জ এবং প্রকাশনার জগতে আনছে নিত্যনতুন বিপ্লব। এরা হল বর্তমান প্রজন্মের তিন ভাই। অপু, মুন্না এবং ঋদ্ধি। অপু এবং ঋদ্ধি সহোদর, সুধাংশুদার দুই পুত্র। এবং মুন্না সুভাষচন্দ্র দে অর্থাৎ বাবুর একমাত্র পুত্র। অপু এই সময়ের এক তরুণ প্রকাশক, ভালো নাম শুভঙ্কর দে, কিন্তু কলেজস্ট্রিট পাড়া তাঁকে অপু নামেই চেনে। অপুকে খুব ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমি। ওর বেড়ে ওঠা আমার চোখের সামনেই। কিন্তু ভাবিনি ও প্রকাশনা জগতে এসে একের পর এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটাবে। সব সময় ওর মাথায় গিজগিজ করছে নিত্যনতুন পরিকল্পনা। এই প্রকাশনা সংস্থাটিকে গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে অপুই। নন্দনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য সংগ্রহ প্রকাশ অনুষ্ঠানে ও নিয়ে এসেছিল মুম্বই থেকে নাসিরুদ্দিন শাহকে। গুলজারকেও মুম্বই থেকে উড়িয়ে এনে তাঁর বই প্রকাশের গ্ল্যামারাস অনুষ্ঠান করেছিল সেই নন্দনেই। প্রতিবছর নববর্ষের অনুষ্ঠানে বিষয় ভিত্তিক একটি করে অভিনব পুস্তিকা প্রকাশের পরিকল্পনাটিও ওঁর। অন্য জগতের বেশ কিছু তারকা যেমন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, শান্তনু মৈত্র-সহ অনেককেই লেখালেখির জগতে ওই এনে ফেলল। শুধু ফেলল নয়, ঘটা করে বইমেলায় এবং আরও বিভিন্ন জায়গায় এঁদের বই প্রকাশ অনুষ্ঠান করে প্রকাশনা জগতে হইচই কাণ্ড বাধিয়ে দিল। শুধু দে’জ এককভাবে নয়, অন্য অনেক সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়েও বেশ কিছু ক্লাসিক প্রকাশনা এই ঘর থেকে করেছে। অপুর আরেকটা পরিচয় অনেকেই জানেন না। অপু কিন্তু একজন সুলেখক এবং পুরনো গ্রন্থ সংগ্রাহক। একটু অফবিট লেখা ওর কলমে অসাধারণ খোলে। ওর আরেকটি গুণ হল, ওর বাবার জেনারেশনের যেসব লেখক -সাহিত্যিকরা এই ঘরের সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলা। ওঁর ক্ষেত্রে জেনারেশন গ্যাপ কথাটা খাটে না। অদ্ভুতভাবে ও এই সিনিয়রদের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে চলে। শঙ্খ ঘোষ, নবনীতা দেব সেন, বুদ্ধদেব গুহ, তরুণ মজুমদার, নিমাই ভট্টাচার্য-সহ সকলের সঙ্গেই ওঁর আন্তরিক সখ্য ছিল। আবার অপেক্ষাকৃত তরুণ লেখক প্রচেত, জয়ন্ত, হিমাদ্রি কিশোর, তমাল বা অন্যদের সঙ্গেও ওঁর দারুণ দোস্তি। বয়সের হিসেবে আমি অবশ্য এই দুই দলের মাঝামাঝিই পড়ি।
আরও পড়ুন:

বাস্তুবিজ্ঞান, পর্ব-১২: গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে দিক জ্ঞান খুব গুরুত্বপূর্ণ / ১

ষাট পেরিয়ে: অ্যালঝাইমার্সের যত্ন বেশ চ্যালেঞ্জের, সঠিক পরিচর্যায় ধৈর্যশীল, সহনশীল, সংবেদনশীল এবং কৌশলী হতে হবে

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন: ডায়াবেটিস থাকবে দূরে, জেনে নিন কোন ফল কতটা পরিমাণে খাবেন, আর কোনটা খেতে হবে সাবধানে, দেখুন ভিডিয়ো

দে’জ-এর নতুন বিপণন কেন্দ্র এখন কলেজস্ট্রিটের বর্ণপরিচয়ের প্রথম তলে। বেশ ঝাঁ চকচকে করে সাজানো এই কেন্দ্রটি। একটা কর্পোরেট লুকও যেন আছে। এখানে স্বল্প পরিসরে বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠান করার ব্যবস্থাও রয়েছে। অপুর নেতৃত্বে প্রতিমাসেই একাধিক অনুষ্ঠান এখানে হয়ে চলেছে এবং সেগুলো ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারও হচ্ছে। একটা পরিকল্পিত মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়ে দে’জের নয়া ব্রিগেড ধীরে ধীরে এগোচ্ছে এবং এ ব্যাপারে অপুর পাশে রয়েছে ওর দুই ভাই— মুন্না ও ঋদ্ধি। সোশ্যাল মিডিয়াকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যবহার করে ওঁরা আরও বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছতে চাইছে। ওঁদের এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল করোনার প্রথম পর্ব থেকেই। সেই সময় একদিন হঠাৎ মুন্নার ফোন। বলল, ‘জেঠু, আপনি গতবার বইমেলায় প্রকাশিত আপনার বইগুলো নিয়ে তিন মিনিটের একটা ভিডিও ক্লিপিং করে আমাকে পাঠাবেন।’ পাঠালাম। ওটা ও ফেসবুকে পোস্ট করল এবং অভূতপূর্ব পাঠক সাড়া পাওয়া গেল। ওয়েবসাইটের ব্যাপারটা আবার ঋদ্ধি বেশ ভালো বোঝে। দে’জের সব বই এখন ডিজিটালাইজেশন হয়ে গিয়েছে। শুরু হয়েছে ওঁদের নিজস্ব ওয়েবসাইটের পথচলা। ক্লিক করলেই দে’জের পুরো গ্রন্থ সম্ভার একের পর এক আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। এই নয়া ব্রিগেড খুব পরিকল্পিতভাবেই দে’জকে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিচ্ছে এই রাজ্যের নানা জায়গায়। অংশ নিচ্ছে জেলা এবং গ্রামীণ বইমেলাগুলোতেও।
আরও পড়ুন:

ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৪৪: বসুন্ধরা এবং…

ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৭: রঙের খেলা আর উইসকনসিনের আঁকাবাঁকা ফাঁকা রাস্তা—জীবনীশক্তিকে আরও উসকে দেয়

দশভুজা: দু’শো বছর আগে হলে তিনি ইঞ্জিনিয়ারের বদলে সতী হতেন

তার থেকে বড় কথা হল, দে’জের যে আন্তরিকতার ঐতিহ্য রয়েছে, লেখক পাঠককে সম্মান করার এবং গুরুত্ব দেওয়ার ঐতিহ্য, সেটা এঁরাও বহন করে চলেছেন। এই জেনারেশনের হয়েও এঁরা কেউ উদ্ধত নয়, অহংকারীও নয়, বাপ-জেঠা-ঠাকুরদার বহু কষ্টার্জিত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার যে এঁদের হাতেই। এঁদের হাত ধরেই তো ৫০ থেকে দে’জ পৌঁছে যাবে ১০০ বছরে। সেদিন দেখার জন্য আমি নিশ্চয়ই থাকব না, কিন্তু থাকবে এই রাজ্য তথা দেশের অগণিত বাঙালি পাঠক। তাঁদের সবার শুভেচ্ছা এবং আশীর্বাদ হোক দে’জের আগামী দিনের পথ চলার সঙ্গী।
* ডাক্তারের ডায়েরি (Doctor’s diary) : ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya) পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছরভর।

Skip to content