প্রযোজক: মণি রত্নম, সুহাসিনী মণি রত্নম, এ. সুভাষকরণ
অভিনয়: বিক্রম, জয়রাম, কার্তিক, ঐশ্বর্য, তৃষা
পর পর দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার গ্রাফিক্সযুক্ত রূপকথা দেখতে দেখতে যখন ভারতবাসী ক্লান্ত, সেই সময় বিশিষ্ট পরিচালক মণি রত্নম যা করে দেখালেন তাতে সাহিত্য, রূপকথা, কল্পনা, ইতিহাস, সিনেম্যাটিক এক্সপ্রেশন— সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। এই ছবির গল্প সাহিত্য নির্ভর, যা কিনা ইতিহাসাশ্রয়ী। ১৯৫৫ সালে কল্কি কৃষ্ণমূর্তির লেখা বিখ্যাত উপন্যাস পোন্নিয়িন সেলভানের আশ্রয়ে এর চিত্রায়ণ হয়েছে। ছবির শুরুতেই আজ থেকে হাজার বছর আগের সময়কাল ও দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোর অঞ্চল নির্দেশিত হয়েছে। যদিও দেখানোর ভঙ্গি গল্পকে আরও প্রায় পাঁচশো বছর পিছিয়ে দিয়েছে। সম্রাট রাজরাজ চোল এখানে পোন্নিয়িন সেলভান। ছোটবেলায় তাঁকে কাবেরী নদী বা পুনিয়ানে ডুবে যাওয়া থেকে উদ্ধার করা হয়। তাই তিনি পুনিয়ানের ছেলে (সেলভান) অর্থাৎ পোন্নিয়িন সেলভান। রাজা সুন্দর চোলের দুই পুত্র, আদিত্য কারিকালান (বিক্রম) ও অরুণমোজি বর্মন (জয়রাম রবি) ও এক কন্যা কুন্দবাই (তৃষা)।
আদিত্য কারিকালান সাম্রাজ্য বিস্তার ও পাণ্ড্যদের দমনে ব্যস্ত থাকলেও, তাঞ্জোর প্রাসাদে কী চলছে তা জানতে তার বন্ধু কার্থি বা বল্লভারায়ণকে (কার্তিক শিবকুমার) পাঠান। কার্থি সেখানে গিয়ে দেখেন রাজা সুন্দর চোল অসুস্থ এবং মহামন্ত্রী পর্বতেশ্বর অন্য মন্ত্রীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত যে, কোনও ভাবে রাজপুত্র আদিত্য কারিকালানের জায়গায় রাজার ভাইপো মধুরান্তক চোলকে বসানোর জন্য। পুরো তাঞ্জোর প্রাসাদ জুড়ে ষড়যন্ত্রের আবহ।
এ দিকে, তাম্বি (জয়রাম সুব্রমণ্যম) নামের একজন বিষ্ণুভক্ত যিনি নিজেকে মহামন্ত্রী পর্বতেশ্বরের স্ত্রী নন্দিনীর (ঐশ্বর্য রাই) পাতানো ভাই বলে পরিচয় দেন তিনিও গুপ্তচরবৃত্তিতে নিযুক্ত। রাজা সুন্দর চোল তাঁর এই অসুস্থতার সময় সন্তানদের পাশে চান। কুন্দবাই উপস্থিত হয় ও তাঁর তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বুদ্ধির প্রয়োগ করতে থাকেন সর্বত্র। বড় রাজপুত্র আদিত্য কারিকালান পেশীশক্তি ও বুদ্ধিমত্তায় অদ্বিতীয় হলেও তাঁর প্রথম জীবনের না পাওয়া প্রেম নন্দিনী (ঐশ্বর্য রাই) এখন তাঁর কাছে হাহাকারে পরিণত হয়েছে। নন্দিনী পরস্ত্রী, রাজমন্ত্রীর স্ত্রী, স্ত্রীধর্ম পালন তাঁর কাছে প্রধান নয় বরং মনে মনে চোল সাম্রাজ্যের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে সিংহাসনে বসার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
এ দিকে, তাম্বি (জয়রাম সুব্রমণ্যম) নামের একজন বিষ্ণুভক্ত যিনি নিজেকে মহামন্ত্রী পর্বতেশ্বরের স্ত্রী নন্দিনীর (ঐশ্বর্য রাই) পাতানো ভাই বলে পরিচয় দেন তিনিও গুপ্তচরবৃত্তিতে নিযুক্ত। রাজা সুন্দর চোল তাঁর এই অসুস্থতার সময় সন্তানদের পাশে চান। কুন্দবাই উপস্থিত হয় ও তাঁর তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বুদ্ধির প্রয়োগ করতে থাকেন সর্বত্র। বড় রাজপুত্র আদিত্য কারিকালান পেশীশক্তি ও বুদ্ধিমত্তায় অদ্বিতীয় হলেও তাঁর প্রথম জীবনের না পাওয়া প্রেম নন্দিনী (ঐশ্বর্য রাই) এখন তাঁর কাছে হাহাকারে পরিণত হয়েছে। নন্দিনী পরস্ত্রী, রাজমন্ত্রীর স্ত্রী, স্ত্রীধর্ম পালন তাঁর কাছে প্রধান নয় বরং মনে মনে চোল সাম্রাজ্যের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে সিংহাসনে বসার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
ছোট পুত্র অরুণমোজি সিংহলে ব্যস্ত থাকেন। তাঁর সুখ্যাতির কারণে বৌদ্ধ সংঘের প্রধান তাঁকে সম্রাট অশোকের সিংহাসনে বসার প্রস্তাব দিলে তিনি তা ফিরিয়ে দেন এই বলে যে, তিনি চোল সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি, চোল সিংহাসন তাঁর জন্য অপেক্ষারত। সুন্দর চোলের নির্দেশে চোল সেনারা এবং একই সঙ্গে সিংহল রাজার সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাণ্ড্য সেনারা তাঁকে ধরতে এলে মাঝ সমুদ্রে ভয়ানক প্রতিরোধের পর তিনি সমুদ্রে ডুবে যান। তাঁর মৃত্যু সংবাদ সর্বত্র প্রচারিত হয়। এখানে এমন এক ঘটনা ঘটে যা দেখতে দর্শকদের অবশ্যই হলে যেতে হবে। আর এখানেই এই ছবির প্রথম পর্বের শেষ।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫: সে এক হতভাগ্যের ‘নষ্ট নীড়’ [২৪/০৮/১৯৫১]
নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি / ৩
দশভুজা: আমার দুর্গা
বিক্রম, ঐশ্বর্য রাই বচ্চন, জয়রাম রবি, কার্তিক শিবকুমার, তৃষা, জয়রাম সুব্রমণ্যম, আর সূর্যশেখর, প্রকাশ রাজ সকলেই যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছেন অভিনয় গুণে। মহিলা চরিত্ররা সৌন্দর্যের দ্যুতি না ছড়িয়ে বুদ্ধিমত্তার দ্যুতি ছড়িয়েছেন। রাজনৈতিক পরিসরে নিজস্ব মতামত দিয়েছেন। অস্ত্রশস্ত্র, সেই অস্ত্রের চালনা, যুদ্ধবিদ্যার প্রয়োগকৌশল সময়ানুগ ও যথাযথ। গ্রাফিক্সের বাড়াবাড়ি নেই। যুদ্ধের দৃশ্যে আশি-নব্বইয়ের দশকের সাধারণ ভাব বজায় থেকেছে। তীর ধনুক, বর্শা, কুঠার, তলোয়ার, আগুনের গোলার ব্যবহার করে যুদ্ধকৌশল দেখানো হয়েছে। মনগড়া ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ কোথাও নেই। সামাজিক পরিসর, বাজার হাট, দোকানপাট, বেশভূষা, গয়না, কথা চালাচালি, গুপ্তচরদের লোকজনের সামনে কথা বের করার জন্য কপট কলহ, শিব বেশি শক্তিশালী, মহান না বিষ্ণু — এই সব বিষয়ের প্রয়োগ অসাধারণ দক্ষতায় প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্য নির্ভর।
আর আশ্চর্য ভাবে দেখো কত ডিটেলিং বোঝানোর কোন চেষ্টাই নেই সুশিক্ষিত পরিচালকের। ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অনুষঙ্গ সাবলীল ভাবে দেখানো হয়েছে। দেখলে দেখো, বুঝলে বোঝো, নাহলেও অসুবিধা নেই, গল্পের গতি দর্শককে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখবে। রবি বর্মনের ক্যামেরার কাজ এবং মণি রত্নম এবং এলাঙ্গো কুমারভেলের চিত্রনাট্য আসল কাজ করে দেখিয়েছে। ভারতের বিভিন্ন দুর্গ ও কেল্লা, বনে, জঙ্গলে, এমনকি তাইল্যান্ডেও এর শ্যুটিং হয়েছে। বড় বড় সেট বানিয়ে কারিগরি দেখানোর প্রয়াস কম। এই ছবির আবহসঙ্গীত নির্মাতা ও সুরকার এ আর রহমান। পৃথিবী বিখ্যাত সচেতন সুরকার তিনি, তাই হাজার বছরের পুরোনো দক্ষিণ ভারতীয় রাজমণ্ডলের পরিবেশ চয়নে বেশি করে আবহসঙ্গীতে সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়েছেন, গানের প্রয়োগ কম করেছেন। আবহসঙ্গীতের সঠিক পরিবেশনা গল্পকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
আরও পড়ুন:
শারদীয়ার গল্প-৩: আলোকসংশ্লেষ
বাইরে দূরে: অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টাল দুনিয়া— সোয়ার্ভস্কি
ছোটদের যত্নে: আপনার সন্তান কি প্রায়ই কাঁদে? শিশুর কান্না থামানোর সহজ উপায় বলে দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু
নৃত্য শৈলী এখানে পৃথক উল্লেখের দাবি রাখে। নৃত্য পরিবেশিত হয়েছে কোথাও কৃষ্ণ-কংসবধ পালা, কোথাও কালীর রূপের প্রকাশের মাধ্যমে। নাচের অঙ্গভঙ্গিমাও পুরোনো শৈলীকে স্মরণ করায়, প্রত্যেকেই যেন কোনও প্রাচীন মন্দির, নগরী, জনপদের মানুষ প্রতিরূপের প্রকাশ, যা সমমাত্রিক নয়, কোথাও যেন একটা বাধো বাধো ভাব অথচ নৃত্যরত। ভরতনাট্যম দেখিয়ে দর্শকদের বোকা বানানোর প্রয়াস নেই। ভারতীয় সাহিত্য ও ইতিহাসের একটা পর্বকে স্মরণ করিয়ে এই ‘পিএস : ১’ চলচ্চিত্র প্রেমীদের মনে স্থায়ী আসন গড়তে চলেছে। আর তাই ২০২৩-এ দ্বিতীয় পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম আমরা সবাই।